ডা. দেবী শেঠির আঁকিবুকি ও নির্দয় অপেক্ষা
ব্যাগ ভরা অপেক্ষা আর মনভরা উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে থাকি
প্রতিদিন ব্যাক প্যাক ভরে অপেক্ষা নিয়ে হোটেল থেকে বের হই আবার ব্যাগ ভরা অপেক্ষা নিয়ে ফিরে আসি। গন্তব্য একটাই দেবী শেঠির নারায়ানা হৃদয়ালয়।
স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য এখানে এলাম গত মাসের ত্রিশ তারিখ। তার “ভিএসডি ক্লোজার” অপারেশন হবে। ওপেন হার্ট সার্জারি। শুনতে অনেক ভয়ানক কিছু। আসলেও তাই।
এই ভয়ানক ‘কিছু’ একটা নিয়েই আজ অষ্টম দিন যাবৎ ডাক্তার, টেষ্ট, রিপোর্ট নিয়ে দৌড়ের উপর আছি। বলা বাহুল্য স্ত্রীও আমার সাথে সাথে দৌড়াচ্ছে। অপেক্ষা আমাদেরকে ছাড়েনা। এখানে যারা আসে কাউকেই না। সকাল ন’টায় ডাক্তারের চেম্বারে বসে থাকি কখনো তাঁর দেখা মিলে বিকাল চারটায়, কখনো বা বেল দুটায়।
ব্যাগ ভরা অপেক্ষা আর মনভরা উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে থাকি। আর মনে মনে বলি আমাদের দেশেতো এমনটা এতো বেশী হয় না। হলে কত চিৎকার চেঁচামেচিই না হত। অথচ এখানে আমরা সবাই একেবারে চুপচাপ। যদিও এখানকার আশি ভাগ রোগী বাংলাদেশী।
যদিও আমরা সবাই শ্রদ্ধেয় ডাক্তার দেবী শেঠীর আশায় এখানে আসি, জেনে রাখা ভাল তিনি কিন্তু এখন আর বেশীরভাগ অপারেশনে হাত দেন না। তার প্রশিক্ষিত সার্জনগনই ওই কর্ম করেন।
এত্তো রোগী তাছাড়া বয়স হয়েছে। আর কত?
খুব ক্রিটিক্যাল কেস অবশ্য দেখেন। বেশি ব্যস্ত থাকেন সেমিনার সিম্পোজিয়াম নিয়ে।
আরও জেনে রাখা ভাল ভিজিট দিলেই এখন আর তাঁর সাক্ষাত মিলেনা। এতো লোককে দেখা দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভবও না। এনজিওগ্রামের সিডি থাকলে ও অপারেশনের জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচিতরাই কেবল চাইলে তাঁর সাক্ষাৎ পেতে পারেন।
দেখা হলে তিনি খুব নরম ভাষায় পরম আত্মিয়ের মত করে বললেব, “বাবা/মা আমিই তোমার অপারেশন করবো” বাস্তবতার আলোকে তা প্রায়শই সম্ভব হয় না।
প্রেসকিপশনে কয়েকটা দাগ টেনে দিয়ে বলবেন, দূর থেকে এসেছো তোমাকে কিছু কনসেশন করিয়ে দিলাম।
বাস্তব ক্ষেত্রে সবাই তা পায় না। নিরুপায় লোকজন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কিছু আদায় করে নেন।
আজ মিলে নবম দিন জুতর সুখতালুর অসুখ বাধিয়ে, পকেটের ডলার, রুপি খালি করে ভর্তির যাবতীয় কাগজপত্র জয়জগাড় করে স্ত্রীকে ভর্তি করাতে এসে শুনি সিট খালি নেই। ফোন নাম্বার রেখে দিয়ে বললো, সিট খালি হলেই কল করব।
আবার অপেক্ষা….! এখানে অপেক্ষায় বড়ই নির্দয়। সবসময় পায়ে পায়ে থাকে।
রেস্টুরেন্টে বসে আছি। দুপরের খাওয়া হয়নি এখনো। চুলায় বড় পাতিলে বলক দিয়ে ভাত ফুটছে। বয় বেয়ারা রা খাবার আয়োজনে ব্যস্ত। আমরা মুখোমুখি বসে আছি পরম ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা নিয়ে।
কারোও মুখে কথা নেই।
মুখ শুকিয়ে আছে আরোও আগে থেকেই।
একজন বুড়ো করে সাহার্য প্রার্থী (মহিলা) ভিক্ষার থালা বাড়িয়ে কিছু একটা চাইছে। থালায় মাঝে ফুল দেখা যাচ্ছে, সংগে কিছু টাকাও নিশ্চয় আছে। তার মাথায় ও হাতে ফুল। সত্তুরের কাছাকাছি মহিলাটিকে খুব আপন মনে হল। তার ভাঁজ পড়া মুখের মাঝেও অফুরন্ত প্রাণ। কোন দীনতা চোখে পড়ে না। আমি ওয়ালেট খুলে দেখি সব বড় টাকার নোট। স্ত্রীকে বলি, ছোট টাকাতো দেখছি না।
স্ত্রী বললো, বড় একটাই দাও। মহিলাটি টাকা পেয়ে মুখে চমৎকার হাসি দিয়ে থালাসহ দুহাত তুলে আশীর্বাদ করে চলে গেল। আমার কাছে মনে হল, এই মুহূর্তে এই মহিলা আমাদের থেকে অনেক বেশী সুখী।
০৮/০৯/১৭
আজিজুল হক
ব্যাঙ্গালোর।
খুব ইচ্ছে ছিল বেঙ্গালোরে নারায়ানা হাসপাতালের সার্বিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে আমার অভিজ্ঞতার (প্রায় তিরিশ দিনের) আলোকে একটা দীর্ঘ লেখা লিখবো। নানা ব্যস্ততায় তা আর সম্ভব হয়নি। আজ প্রায় দুবছর পর লিখতে বসে ছোটখাটো অনেককিছুই স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে।
যতটুকু মনে পড়ে দু/একদিন অপেক্ষার পর আমার স্ত্রী হাসপাতালে সিট পেল।
রোগীকে সৌভাগ্যবানই বলতে হবে কারণ কদিন আগেই কোরবানির ঈদ ছিল বিধায় হাসপাতালে রোগীর চাপ একটু কম ছিল তখন ।
শুনেছি সিট পেতেই কারো কারো সপ্তাহ দশ দিন পার হয়ে যায়। এই সময় আপনি হোটেলে বসে কেবল রোগ, রোগী, দেশে ফেলে আসা সন্তান আর নিজ কপালের কথাই ভাববেন আর হোটেলের বিল গুনবেন।
শত শত হোটেল আপনার জন্যই এখানে গড়ে উঠেছে। আপনাকে ধরে রাখার নানা আয়োজনও তাদের আছে। তবে হোটেলের মানের তুলনায় বিল তুলনামূলক ভাবে কম এটাই আপনার জন্য একটা ভাল খবর।
যাইহোক হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর শুরু হল নতুন অপেক্ষা, অপারেশন কখন হবে তার অপেক্ষা। ভর্তি হবার পর অনেক পেশেন্ট কে দেখেছি দশ, পনের এমনকি তারও বেশি দিন অপেক্ষা করতে সিরিয়ালের জন্য। এর কারণ প্রথমত লম্বা কিউ। দ্বিতীয়ত সামান্যতম জ্বর, সর্দি বা অন্য কোন শারিরীক সমস্যা থাকলে অপারেশন হবেনা। তৃতীয় কারণ অপারেটিং সার্জনের সময়ের স্বল্পত৷
চিকিৎসার মাঝপথেই চাকুরী থেকে নেওয়া আমার ছুটি প্রায় শেষের দিকে, তার উপর ছোট ছেলেমেয়ে কে দেশে রেখে এসেছি। চিন্তায় কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না।
আমাদের দেশে সাধারণত এডমিশনের দু'একদিন পরেই অপারেশন করে ফেলা হয়। একটু দেরি কেউই সহ্য করেনা, না ডাক্তার না রোগী।
তবে এ হসপিটালের একটা ভাল দিক হল, আপনি দেনদরবার করে যে টাকা দিয়ে ভর্তি হয়েছেন ভর্তি অবস্থায় একমাস থাকলেও আপনার বিল আর এক টাকাও বাড়বে না।
তাই ভর্তির সময় দেনদরবার টা একটু বেশীই হয়, যা আমাদের মত নিরীহ মানুষের জন্য ছিল অস্বস্তিকর। দেন দরবারের কোন আগা মাথা নেই, ছল চাতুরী করে যে যত কমাতে পারে।
একই ধরনের অপারেশনের জন্য একেক জনের টাকা একেক রকম।
চিপে চিপে সর্বোচ্চ পরিমাণ টাকা তারা হাতিয়ে নেয়।
প্যাকেজের বিষয়ে আমার বিব্রতকর অবস্থা একটু শেয়ার করি, অপারেশনর জন্য ফিট হলে প্যাকেজের অগ্রিম টাকা আগে ডলারে জমা দিয়েই তবে আপনাকে ভর্তি হতে হবে।
শ্রদ্ধেয় শেঠি বাবু আমার ফাইলে অনেক গুলো সংকেতিক চিহ্ন এঁকে দিয়ে বলেছিলেন, আপনার জন্য কিছু কমিয়ে দিলাম (বাংলাদেশে থেকে আসা সকলের জন্যই তিনি একাজটি করে থাকেন)।
সেই আঁকিবুঁকি ফাইল সহ গেলাম দেনদরবার সেকশনে। দুজন লোক পাশাপাশি দুই কক্ষে বসে দক্ষতার সহিত এ একাজটি করে থাকে।
একজন শুনেছি শেঠি বাবুর নিকট আত্মীয়। আমি তার কাছেই গেলাম। ভদ্রলোক কঠিন মুখখানা আরও কঠিন করে কাগজ, ক্যালকুলেটরে এটা সেটা লিখে বিশাল এক অংক ধরিয়ে দিলেন। এতোদিন ধরে খরচের যে তথ্য পাচ্ছিলাম এটা তার থেকে অনেক বেশি। আমাকে বিজ্ঞ জনেরা আগেই পরামর্শ দিয়েছিলেন, দু'তিন দিন এমনকি এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে যতটা সম্ভব বিল কমিয়ে নিবেন।
খুব বেশি দরাদরি আমি কখনওই করতে জানিনা, তাছাড়া আমার হাতে সময়ও বেশি নেই। যত তাড়াতাড়ি দেশে যেতে পারি ততোই মঙ্গল। আমি কঠিন চেহারার লোকটির দিকে নরম চোখে তাকিয়ে শেঠি বাবুর দাগ গুলোর দিকে ঈঙ্গিত করে বললাম, স্যার তো বিল কমিয়ে দিয়েছিলেন।
ভদ্রলোক আরও কঠিন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সেই জন্যই তো কম, তা নাহলে আরও বেশি হত।
বলেই আমার দিকে আরেকবার তাকিয়ে কাগজে কাটাকাটি করে আরও কিছু কমিয়ে দিয়ে বললেন, এর চেয়ে কম হবেনা। এটাই ফাইনাল।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে বিল নিয়ে কাউন্টারের দিকে ছুটলাম। নষ্ট করার মত সময় আমার হাতে নাই। কাউন্টারে গিয়ে আবার ধাক্কা খেলাম। গোপন পকেট থেকে ডলারের বান্ডিল বের করে ভদ্রমহিলার হাতে দেবার পর ভদ্রমহিলা নরম সুরে বললেন, আপনার ব্যাংক ডকুমেন্টস দিন।
হায়, কোথায় পাব ব্যাংক ডকুমেন্টস। সব টাকাতো পাসপোর্ট এ এন্ড্রোস করা নাই। পাসপোর্টে আমার ডলার এন্ড্রোসমেন্ট ছিল সম্ভবত তিন হাজার ডলার। এর বেশি করাতে গেলেও নাকি নানা ঝামেলা হয়।
সরকারি চাকুরীজীবী বলে সমস্যা আরও বেশি। সরকারি চাকুরেদের এ ধরনের কাজে মিথ্যা বলাই নাকি নিয়ম। আমার সরকারি ছাড়পত্রেও ভ্রমনের উদ্দেশ্য ছিল মাজার ও পবিত্র স্থান জিয়ারত। সবাই বাকি তাই-ই করে।
চিকিৎসার জন্য নাকি সরকারি অনুমোদন দেওয়া হয়না।
হাসপাতালে ডলারের অংকে আমার বিল ছিল পাঁচ হাজার ডলারের সামান্য উপরে। কাউন্টারের মহিলা জানাল পাঁচ হাজার ডলারের বেশি বিল জমা দিতে গেলে আইনগত ভাবে প্রোপার ডকুমেন্টস লাগে।
এখন উপায়?
ভদ্র মহিলার সাফ জবাব, ডকুমেন্টস লাগবে নতুবা বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়ার বাইরের অন্য কোন দেশ থেকে ডলার তাদের একাউন্টে পাঠাতে হবে।
বাংলাদেশ থেকে পাঠালে সমস্যা কি?
এর কোনো জবাব তার কাছে নেই।
সারাদিনের নানা ঝক্কি-ঝামেলার পর মাথায় হাজার চিন্তার ভেতর এমন কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। দেশ থেকে কোনভাবে না হয় টাকাটা ম্যানেজ করা যেত, কিন্তু বিদেশে কে আমার জন্য পাঁচ হাজার ডলার নিয়ে বসে আছে?
হতাশা উৎকন্ঠা নিয়ে আবার ছুটলাম দেন-দরবার অফিসে।
এবার অন্য জনের কাছে গিয়ে অতি বিনয়ের সাথে সমস্যার কথা জানিয়ে বললাম, আপনি হয় কিছু টাকা কমিয়ে দিন অথবা কিছু ডলার রুপিতে ক্যাশ নিয়ে পাঁচ হাজার ডলারের নীচে বিল করে দিন।
ভদ্রলোকের দিলে দয়া হল, তিনি বেশি কথা না বলে বিল কমিয়ে পাঁচ হাজার ডলারের নীচে নামিয়ে দিলেন। বিলের এমন ফ্লেক্সিবিলিটি দেখে আমি অবাক হলাম।
বলাবাহুল্য এর আগে নানা পরীক্ষা, নীরিক্ষায় প্রায় এক হাজার ডলার চলে গেছে।
বিল পাঁচ হাজার ডলার জমা দেয়ার পরও রোগীর জায়গা হল সাধারণ ওয়ার্ডে। ওয়ার্ডটি পরিচ্ছন্ন হলেও ছেড়া বিচানা চাদর দেখে আমার মন খারাপ হল। আরও বেশি মন খারাপ হল একই ধরনের কয়েক রোগী প্রায় সপ্তাহ, পনের এমনকি বিশদিন অপেক্ষা করছে তার ডাক্তারের সিরিয়ালের জন্য।
এরমধ্যে আমার বিশ দিনের ছুটি প্রায় শেষ। তাড়াতাড়ি ছুটি বাড়ানোর জন্য নানা কায়দায় আবেদন করলাম। সাথে ডাক্তারকে আমার সমস্যার কথা জানিয়ে তাড়াতাড়ি অপারেশনের জন্য অনুরোধ জানালাম।
ভর্তির দুদিন পর অপারেশনের জন্য ডাক পড়লো। রোগী ও আমি সারারাত করাতের নীচে শুয়ে নির্ঘুম থেকে সকালের জন্য অপেক্ষা করলাম। দেশে সবার সাথে কথা বললাম।
রোগীর রাত থেকে খালিপেটে অপেক্ষার পর বেলা একটায় জানা গেল আজ অপারেশন হবেনা। টাইম ইজ ওভার।
মেজাজটা খুব খারাপ হল। দুশ্চিন্তা আরও একদিন বাড়লো। অবশেষে পরেরদিন অপারেশন হল।
সন্ধ্যায় আইসিইউতে আমাকে রোগী দেখাতে ডেকে নিল। আলহামদুলিল্লাহ, কোন রকম সমস্যা ছাড়া সবকিছু ঠিকঠাক মতই হয়েছে। এরপর দুই দিন আইসিইউ, চার/পাঁচদিন কেবিনে থেকে তারপর হোটেলে গেলাম।
হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিতে গিয়ে আবার ধাক্কা খেলাম। বিলে দেখা গেল আমি প্রায় বার হাজার রুপি তাদের কাছে পাই।
টাকা পাওয়ার জন্য কিঞ্চিৎ আনন্দিত হলেও মন খারাপ হল দেনদরবার কক্ষের লোকের আচরণ ও শেঠি বাবুর সাংকেতিক বিল কমানোর চিহ্নের কথা মনে পড়ায়।
বুঝলাম আমার থেকে বাড়তি টাকাও নেওয়া হয়েছিল।
এমন ভাওতাবাজি, হয়রানী, রূঢ় আচরণ আমার সাথে না করলেও পারতো। বছরে শত শত কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে এই হাসপাতালে আসে। কিন্তু বাংলাদশীদের জন্য কোন সুযোগ সুবিধা এখানে নেই।
যারা নারায়ানা হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন বা যাবেন তাদের উদ্দেশ্যে আমার অভিজ্ঞতা হল:
১) যারা শুনেছেন এখানে সিস্টাররা পরম যত্নে রোগীকে খাইয়ে দেয়, শুইয়ে দেয়, বাথরুমে নিয়ে যায় তাদের জন্য বলছি, কথা গুলো ডাহা মিথ্যা।
ঔষধ খাওয়ানো ছাড়া অন্যা কিছই তারা করেনা। অনেক সময় ঔষধ টেবিলে রেখেই চলে যায়। ডাকলেও পাওয়া যায়না। আমাদের দেশের মত রোগীর এটেনডেন্সই ভরসা।
আইসিইউ থেকে ফেরার পর আমার রোগীর দুই বেডের কেবিনে জায়গা হলেও সেবার মান দেখে সত্যিই হতাশ হয়েছি। সবকিছু আমাকে একাই সামলাতে হয়েছে।
২) যারা শুনেছেন এখানে ওষুধপত্র টাইমলি আদর যত্ন করে খাওয়ানো হয় এটাও পুরোপুরি ঠিক না। আমি আমার এক কেইসেই মারাত্মক দুটো ভুল দেখেছি।
আইসিইউ থেকে কেবিনে আসার প্রথম দিন রাতে সিস্টার এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন (সম্ভবত) দিতে ভায়ালে মিশ্রণ দিতেই দেখা গেল ঔষধের রঙ বিদঘুটে হয়ে গেল। আমি ও সিস্টার একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। সিস্টার কিছু একটা লুকাতে গিয়েও লুকালোনা। বললো ভায়ালের ঔষধে সমস্যা আছে। আমি মেয়াদ দেখলাম ঠিক আছে। সিস্টারও দেখল। কিন্তু ভায়ালের ভেতরে সমস্যা। যদিও এই ঔষধ গুলো রোগীর সাথে ট্রেতে করে আইসিইউ থেকে এসেছে। পরে সিস্টার অন্যা ভায়াল এনে ইনজেক্ট করেছিল।
ভাগ্যিস আমার ও সিস্টারের নজর ছিল বলে সে যাত্রায় বেঁচে গেল। কিন্তু আমি অবাক হলাম এমন ভুল কি করে হয়?
এর পরের দিন রাত এগারোটা হয়ে গেলেও কেউ ইনজেকশন দিল না, যদিও ট্রিটমেন্ট সীটে লেখা ছিল । আমার সন্দেহ হল। এতো তাড়াতাড়ি এন্টিবায়োটিক শেষ হবার কথা না। আমি হোটেলে ফিরে যাবার আগে সিস্টারের কাছে গেলাম। আগের সিস্টার নাই। সিফট শেষ। নতুন সিস্টার সীট দেখে বললো, ও দেয়নি?
আমি বললাম, না।
রাত দশটার ঔষধ বারটায় দেওয়া হল, আমি না বললে দেওয়াই হত না।
৩) অর্ধেকেরও বেশি রোগী বাংলাদেশ ও কোলকাতার হলেও ওখানকার সিস্টাররা প্রায় সবাই কেরালা বা আশেপাশের। ওরা হিন্দি বোঝেনা, ইংরেজি জানেনা বাংলার তো প্রশ্নই উঠেনা। আমাদের দেশ থেকে আসা কম শিক্ষিত লোকদের জন্য এটা মারাত্মক সমস্যা। অনেক রোগীর ক্ষেত্রে আমিই দোভাষীর কাজ করেছি।
ওদের সাথে কমিউনিকেট করা বড়ই জটিল।
তাছাড়া অধিকাংশ সিস্টার নতুন ও অদক্ষ। কম বেতনে কাজ শুরু করে দুই তিন বছর এ হাসপাতালে থেকে অভিজ্ঞ হলে তারা বেশি বেতনে অন্যত্র চলে যায়।
৪) অধিকাংশ রোগী বাংলাদেশ ও কোলকাতার হলেও রোগীর জন্য খাওয়ার মেনু স্থানীয়। যা কোন রোগীই মুখে দিতে পারেনা। 'ইগলি'র মত জঘন্য খাদ্য আমি পূর্বে কখনো খাইনি।
রোগীর খাবারের জন্য আপনাকে ছুটতে অনেক দূরে অবস্থিত মাত্র দুটো বাঙালি হোটেলে অথবা নিজে রান্না করতে হবে। আমার মত একজন এটেনডেন্ট এর জন্য হোটেলই ছিল ভরসা। যদিও রেস্তোরাঁর খাবার রোগীর জন্য মোটেও স্বাস্থ্যকর ছিল না।
৫) সবার ধারণা এখানে ডাক্তার ভুল করেন না। এটাও ভুল ধারণা। মানুষ যত বড়ই হোক ভুল করবেই। আর ভাগ্য বলে একটা কথাতো আছেই।
আমার একমাসে অনেক রোগী ও রোগীর এটেনডেন্টের সাথে প্রায় প্রতিদিনই একবার করে দেখা হত। সব খবর পাওয়া যেত সহজেই।
ওই সময়ের মধ্যে আমার রোগীর মত একই সমস্যায় নিয়ে আসা অন্তত তিনজন রোগীর অপারেশন ব্যর্থ হয়েছে ডাক্তার অথবা ভাগ্যের কারণে।
একটা ঘটনা বলেই শেষ করবো।
একজন পুলিশ অফিসার আমার হোটেলেই থাকেন। রোগী তার ৭/৮ বছরের মেয়ে। আমার মিসেসের মতই 'ভিএসডি' পেশান্ট। তবে গুরতর কিছু না। অপারেশন না করালেও তেমন কোন সমস্যা হত না। এমনকি দেশেও সহজভাবে এ অপারেশন করা সম্ভব ছিল।
ভদ্রলোক ইউএন মিশন শেষ করে দেশে এসে মনের শান্তনার জন্য মেয়েকে নিয়ে নারায়না হাসপাতালে আসেন। আমার মিসেসের একদিন পর মেয়েটির অপারেশন হয়। খুব সহজ অপারেশন 'ডিভাইস ক্লোজার' লাগানো। ওপেন হার্ট সার্জারী ছাড়াই ডিভাইস ক্লোজার দিয়ে ছিদ্র বন্ধের এই সহজ প্রক্রিয়াটি জটিলতা, ভুল চিকিৎসা অথবা ভাগ্যের কারণে মেয়েটার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। মেয়েটির হার্টের ভালব নষ্ট হয়ে যায়। লাইফ সাপোর্টের মাধ্যমে মেয়েটিকে বাঁচিয়ে রেখে প্রথমে পেস মেকার লাগানো হয় অত:পর ওপেন হার্ট সার্জারী করে ছিদ্র বন্ধ করা হয়। আমাদের দেশে যাবার আগেই ভদ্রলোকের দেশে যাবার কথা ছিল, টিকেটও করা ছিল।
ভাগ্য তার সাথে ছিলনা। আমরা চলে আসার সময়েও মেয়েটি আইসিইউ তে ছিল। কবে ছাড়া পাবে নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারছেনা। মেয়েটি যতদিন বেঁচে থাকবে তাকে পেস মেকার নিয়েই বাঁচতে হবে। হসপিটাল কতৃপক্ষ পুলিশ অফিসারটির কাছ থেকে বাড়তি অনেক টাকাও নিয়েছে পেস মেকার ও ওপেন হার্ট সার্জারীর জন্য।
সিড়িতে বা লিফটে মেয়েটির বাবার সাথে যতবার দেখা হত আমার চোখ ততোবারই আদ্র হত।
দেশে ফিরে আসতে আসতে ভাবি, যদি বাংলাদেশের একটি ক্লিনিকে একজন পুলিশ অফিসারের মেয়ের এমন অবস্থা হত তাহলে কি কান্ডই না জানি ঘটতো।
কিন্তু ওখানে ভদ্রলোক একেবারেই নিশ্চুপ। কেবল বললো মেয়েটি যে বেঁচে আছে এটাই আল্লাহর রহমত।
শেষ কথা, ব্রিগ্রেডিয়ার নূর নাহার ফাতেমা ('ল্যাব এইড' এ বসে) এএসডি ও ভিএসডি এর জন্য এশিয়ার একজন বিখ্যাত ডক্তার। শত হাজার রোগীকে ডিভাইস ক্লোজার দিয়ে হার্টের ছিদ্র বন্ধ করেছেন। এখনো করছেন।
খরচ বিদেশ থেকে অর্ধেকেরও কম। আমার মিসেস কে মাত্র তিন হাজার টাকার বিনিময়ে মাত্র পাঁচ মিনিট পরীক্ষা করে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন ব্যাঙ্গালোরের নারায়ানা হাসপাতালে দশদিন ধরে ৬০/৭০ হাজার টাকা খরচ করে নানা পরীক্ষার পর অনেক ডাক্তার মিলে সেই একই সিদ্ধান্ত দিয়েছে।
আমার অভিজ্ঞতায় যা দেখেছি দেশ আর বিদেশের চিকিৎসার পার্থক্যের সার কথা হল, আস্থা ও বিশ্বাস।
আমাদের দেশের দক্ষ সার্জনের অভাব নাই। অভাব শুধু একটা, তা হল, বিশ্বাস আর আস্থা।
দেশের ডক্তার ও চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকেই এ বিষয়ে আবার আগে এগিয়ে আসতে হবে।
(আমার মিসেসের কেসটা একটু জটিল বিধায় ফাতেমা ম্যামই ওখানে রেফার করেছিলেন)। কাল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাব। স্ত্রী হাসপাতালের বিছানায়, আমি ছয় তলার বারান্দায় বসে দেখছি বাইরে চমৎকার নানা রকমের ফুল ফুটে আছে। টেনশনের কারণে এতোদিন এমন চমৎকার ফুলগুলো চোখে পড়েনি। একটু খেয়াল করে দেখলাম এর ভেতর কৃষ্ণচূড়াও আছে।
এখানেও যে কৃষ্ণচূড়া ফোটে
কৃষ্ণ কি আর রাধার জন্য অপেক্ষাতে থাকে?
বৃষ্টি শেষে এখানেও রঙধনুটা উঠে
বিরহী সুর কৃষ্ণ বাঁশী বুকের ভেতর বাজে।
রাধা নেই কৃষ্ণও নেই বাঁশী তবু বাজে
বুকের জ্বলায় আকাশ জ্বলে ছাই হয়েছে কবে!
আজিজুল হক, কুয়েত।
(ফেসবুক ওয়াল থেকে নেওয়া।)