উপাসনা: আনুষ্ঠানিকতা, তাত্ত্বিকতা, আত্মিকতা, এবং আরোগ্যতা

ডা. হামীম ইবনে কাওছার
2021-06-29 14:08:59
উপাসনা: আনুষ্ঠানিকতা, তাত্ত্বিকতা, আত্মিকতা, এবং আরোগ্যতা

উপাসনার দ্বিতীয় দিক হলো আত্মিকআত্মউন্নয়ন

(১) আমাদের লোকালয় পূর্ণ উপাসনালয়ে। উপাসকেরা দল বেঁধে স্রষ্টার উপাসনায় মগ্ন। এতে প্রশ্ন জগতে পারে যে স্রষ্টা কি শুধু উপাসনালয়ে-ই থাকেন? তিনি কি আমাদের ঘরে-বাইরে-বাজারে-ধর্মসভায়-রাজপথে-অন্ধগলিতে-সংসদে-সচিবালয়ে থাকেন না? তাহলে, স্রষ্টাকে খুঁজতে আমাদের উপাসনালয়ে যেতে হয় কেন? প্রার্থনার জন্য আমাদের কেন সুনিদৃষ্ট স্থানের প্রয়োজন হয়? আমরা উপাসনালয়ে না গেলে স্রষ্টা কি উপাসনালয় থেকে বেরিয়ে আমাদের কাছে আসতে পারেন না? আমরা যে উপাসনা করি, স্রষ্টার কি সেই উপাসনার খুব-ই প্রয়োজন? তিনি কি তার সৃষ্টির প্রশংসা শুনতে এতটা অনুরাগী?

(২) আমরা খুব সম্ভবত মৃত্যু-পরবর্তী সময়ের অনিশ্চয়তা, সেই অনিশ্চয়তার সময়ে স্রষ্টার কৃপা এবং আমাদের অপরাধের মার্জনা লাভের আশায় উপাসনা করে থাকি। আনুষ্ঠানিক দিক থেকে উপাসনাকে তেমনটিই মনে হয়। কিন্তু, তাত্বিক এবং আত্মিক দিক বিবেচনা করলে উপাসনা আসলে ইহজগতে সুশৃঙ্খল ভাবে জীবনযাপনের একটি সুনিদৃস্ট নীতিমালার ব্যবহারিক প্রয়োগের প্রশিক্ষণ। প্রতিটি ধর্মে পৃথিবীতে কিভাবে সুশৃঙ্খল, নিয়মানুগভাবে এবং অন্যের জন্য ক্ষতিকারক না হয়ে জীবনযাপন করতে হবে সে সম্পর্কে একটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এই নির্দেশনা হল জীবন যাপনের নির্দেশনা, কোনো ধর্মে মৃত্যু পরবর্তী জীবনযাপনের নীতিমালা দেয়া হয়নি। এই নির্দেশনা পালনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া আমাদের যাপিত জীবনে এবং সমাজে প্রতিফলিত হবে। এই নির্দেশনা মেনে জীবন যাপন করার সুদূর প্রভাব হবে মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে। এই নির্দেশনা পালনের প্রভাব যদি যাপিত জীবনে এবং সমাজে পরিলক্ষিত না হয়, তবে এর প্রভাব মৃত্যু-পরবর্তী সময়েও হবে না।

(৩) স্রষ্টার বিধি মেনে উপাসনার জন্য তাহলে আমাদের উপাসনালয়ে যেতে হয় কেন? একটা বাস্তব উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করি। শিক্ষালাভের জন্য আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাই, সেখানে সুনিদৃষ্ট নিয়ম আছে, সময় অনুসারে নিদৃস্ট কর্মসূচি আছে। আমাদের জ্ঞানার্জন এবং অগ্রগতি মূল্যায়নের জন্য শিক্ষক এবং পরীক্ষা আছে। শিক্ষকের কাছে এবং প্রতিষ্ঠানের কাছে আমাদের দ্বায়বদ্ধতা আছে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই আমাদের সহপাঠীদের সাথে পারস্পরিক সহযোগিতার সাথে বড় হতে হয়, সমাজের সুনিদৃস্ট নীতিমালা মেনে চলতে শেখানো হয়।

কোনো উপাসনালয়েই স্রষ্টা থাকেন না। উপাসনালয়ে আমাদের যেতে হয় মূলত দুটি কারণে: আমাদের দৈনন্দিন জীবনে স্রষ্টার নীতিমালা পালনে আমাদের দ্বায়বদ্ধতার সাক্ষ্য দিতে এবং নিজের মনের এবং বিবেকের উপর আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার প্রশিক্ষণ নিতে। যারা পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে যেয়ে নামাজ পড়ি, তারা মূলত একেক ওয়াক্তের মাঝের সময়ে আমাদের যাপিত জীবনে যে স্রষ্টার প্রদত্ত নীতিমালা ভঙ্গ করিনি তার জবাবদিহি করতে অথবা নীতিমালা ভঙ্গ করলে তার জন্য অনুশোচনা করতেই উপাসনালয়ে যাই। আমরা স্রষ্টার কাছে এবং স্রষ্টা প্রদত্ত আমাদের বিবেকের কাছে দ্বায়বদ্ধতা প্রকাশ করতেই উপাসনালয়ে যাই। কিন্তু এই কাজটি তো বাসায় বসে করলেই হতো কিন্তু আমাদের উপাসনালয়ে যেতে হয়, কারণ সেখানে আমাদের সমবিশ্বাসীদের সাথে সাক্ষাৎ হবে, তাদের সাথে কুশল বিনিময় করার সুযোগ হবে। এই দলগত উপাসনায় সুকর্মে উদ্দীপনার সৃষ্টি হবে, ভালো কাজ করার প্রবণতা এবং প্রতিযোগিতার উদ্রেক হবে- এসবের সমষ্টিগত ফলাফল হলো সুন্দর ব্যক্তিগত জীবন, শান্তিপূর্ণ সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবন।

উপাসনার দ্বিতীয় দিক:

(৪) উপাসনার দ্বিতীয় দিকটি হলো আত্মিক। আত্মউন্নয়ন। এই আত্মউন্নয়ন হলো নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ তৈরী করা, নিজের মনের উপর, নফসের উপর, ইচ্ছার উপর, কল্পনার উপর নিয়ন্ত্রণ তৈরী করা। প্রার্থনা একটি ধ্যান প্রক্রিয়া। যেকোনো ধ্যান প্রক্রিয়া চিত্তবিক্ষিপ্ততা নিয়ন্ত্রণ করে। যারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করে না, তারাও ধ্যান করে, ধ্যানের মাধ্যমে পৃথিবীর যাবতীয় কোলাহল থেকে নিজেদের মানসিক এবং আত্মিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে সক্ষম হয়। ধ্যানের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণের উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছে গেলে আমরা এই নিয়ন্ত্রণ অন্যের মনের উপর বিসতৃত করতে পারি। আত্মনিয়ন্ত্রণের এই উন্নমিত পর্যায়ে মানুষ যখন অন্যের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল আয়ত্ত করার ক্ষমতা অর্জন করে, তখন তাঁরা সাধু বা পীর হিসেবে আবির্ভুত হন।

(৫) উপাসনার তৃতীয় দিকটি হলো আরোগ্যতা-সুস্থতা। উপাসনা মূলত এক প্রকার ধ্যান। ধ্যানের মাধ্যমে আমরা যখন আত্মনিয়ন্ত্রণ এর গভীর পর্যায়ে উন্নীত হই, তখন আমাদের শরীরে জৈবিক এবং শারীরবৃত্তিক, এমন কি জীন অভিব্যক্তির উপর-ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। একারণে গভীর উপাসনায় নিমগ্ন মানুষেরা নিজেদের রক্তচাপ, রক্তপ্রবাহ, এমন কি হৃদস্পন্দন-ও স্বেচ্ছায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা গভীর উপাসনায় অভ্যস্ত, তাদের শরীরে অনেক জিনের অভিব্যক্তি এবং এবং জীন অভিব্যক্তির উপর এপিজেনেকি নিয়ন্ত্রণ-ও প্রতিষ্ঠিত হয়।

আমাদের শরীরে বিভিন্ন রোগসৃষ্টির (বিশেষ করে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার) প্রাথমিক উপাদান হলো প্রদাহ বা ইনফ্লামেশন। আমেরিকা, স্পেন এবং ফ্রান্সের গবেষকরা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করেছেন যে ধ্যানের মাধ্যমে ‘প্রদাহ-বান্ধব’ জিনের অভিব্যক্তি হ্রাস করা সম্ভব। তারা পরীক্ষামূলক ভাবে প্রমান করেছেন যে আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ‘প্রদাহ-বান্ধব’ বা প্রো-ইনফ্লামেটরি জিনের এক্সপ্রেশন কমিয়ে ফেলা সম্ভব। এই দুটি জিনের নাম হলো: রিসেপ্টর ইন্টারএক্টিং সেরিন/থেরিওনিন প্রোটিন কাইনেজ -২ (রিপকে-২) এবং সাইক্লো-অকসিনেজ-২ (কক্স-২)। আমরা যারা প্রদাহের জন্য প্রদাহ/ব্যথানাশক ওষুধ খাই, তার কয়েকটি কক্স-২ এনজাইম কে অবদমন করেই ব্যাথানাশ করে।

(৬) আমাদের শরীরের ৮ নম্বর ক্রোমোজোমের দীর্ঘ বাহুতে ১২ টি এক্সনের সমন্বয়ে গঠিত রিপকে-২ জীন। পোনাটিনিব এবং রেগোরাফেনিব নামক দুটি ঔষধ এই রিপকে-২ প্রোটিনের উপর কাজ করে ক্যান্সার নিরাময় করে। কমপক্ষে তিন ধরণের ক্যান্সারের চিকিৎসায় এই দুটি ঔষধ ব্যবহৃত হয়।

আমাদের অনেক জিনের অভিব্যক্তি এপিজেনেটিক্সের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। এপিজেনেটিক্স-এর এই নিয়ন্ত্রণ মূলত মিথাইলেশন বা ডিমিথাইলেশনের মাধ্যমে হয়ে থাকে। যে জীন এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করে তার নাম হিস্টোন ডিএসিটাইলেজ। গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা প্রমান করেছেন যে ধ্যানের মাধ্যমে হিস্টোন ডিএসিটাইলেজ জিনের অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যার ফলে এপিজেনেটিক প্রক্রিয়াযা শরীরের ক্ষতিকারক প্রদাহবান্ধব বিভিন্ন জীনের এক্সপ্রেশন বন্ধ করে দেয়া যায়। এর মাধ্যমে শরীরে বিভিন্ন রোগ, প্রদাহ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমিয়ে ফেলা যায়।

বিজ্ঞানীরা আরো প্রমান করেছেন যে ধ্যানকার্যে আমাদের শরীরের এপিজেনেটিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ক্ষতিকারক জিনের প্রোমোটার অংশের ‘সিপিজি আইল্যান্ড’ হাইপারমিথাইলেশন হয়, এর ফলে এই জিনের এক্সপ্রেশন বন্ধ হয়ে যায় এবং ক্যান্সার প্রতিরোধ হয়। এমন একটি অনকোজিন হলো RAS প্রোটিন যা অনেক ধরণের ক্যান্সারের জন্য দ্বায়ী, এবং ধ্যানে এই জীনের এক্সপেশন নিম্নগামী হয়ে ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।

সেনেসেন্স:

(৭) আমাদের ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধ হয়ে যাবার জৈবিক প্রক্রিয়ার নাম ‘সেনেসেন্স’। গবেষণায় দেখা গেছে যে, বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্রোমোজোমের টেলোমারের দৈর্ঘ্য কমে যেতে থাকে। এই দৈর্ঘ্য কমতে কমতে এক সময়ে কোষ-বিভাজন হবার মত যথেষ্ট দীর্ঘ টেলোমেয়ার থাকে না, তখন আমাদের কোষগুলো মরে যেতে থাকে।

টেলোমারেজ নামক একটি এনজাইম টেলোমারের দৈর্ঘ্য কমে যাবার এই জৈবিক প্রক্রিয়াকে ধীরান্বিত করে। টেলোমারেজ এবং টেলোমারের দৈর্ঘ্যের সাথে আমাদের বয়োবৃদ্ধির সম্পর্ক আবিষ্কার করে ২০০৯ সালে তিনিজন বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এই টেলোমারেজ এনজাইমের কার্যক্ষমতা যত বেশি হবে, ক্রোমোজোম তত কম ক্ষয় হবে, এবং কোষ বিভাজন তত বেশিদিন হবে এবং আমরা অপেক্ষাকৃত বেশি সময় যৌবন ধরে রাখতে পারবো।

এই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করে জাপানের বিখ্যাত প্রসাধন প্রস্তুতকারক ‘শিশিডো কোম্পানি’ মেয়েদের যৌবন ধরে রাখার জন্য টেলোমারেজ সমৃদ্ধ ক্রীম বাজারজাত করেছে কমপক্ষে এক দশক আগেই। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে যে যারা ধ্যান করেন, তাদের টেলোমারেজ এনজাইমের কার্যক্রম অপেক্ষাকৃত বেশি এবং এদের ক্রোমোজোমের দৈর্ঘ অপেক্ষাকৃত বেশি দিন দীর্ঘ থাকে। এর ফলে, এরা দীর্ঘদিন যৌবন ধরে রাখতে পারে।

(৮) উপাসনালয়ে যেয়ে আমাদের প্রার্থনা করার উদ্দেশ্য স্রষ্টার সন্ধান নয়। এর আনুষ্ঠানিক এবং তাত্বিক উদ্দেশ্য হলো, স্রষ্টা প্রদত্ত নীতিমালা আমরা মেনে চলছি কি না তার সার্বিক মূল্যায়ন করা। না মেনে থাকলে তার জন্য অনুশোচনা করা এবং ভবিষ্যতে করার প্রতিজ্ঞা করা, ধর্মীয় নেতার প্রেরণাদায়ক এবং উৎসাহমূলক বাণী শ্রবণ করে নিজের জীবনকে ধর্মীয় নীতিমালার সাথে সম্পৃক্ত রাখা। এর সামাজিক উদ্দেশ্য হলো সমমনা মানুষদের সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাৎ-আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সুন্দর ব্যক্তিগত এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সমাজব্যবস্থা তৈরী করা।উপাসনালয়ে যেয়ে প্রার্থনা করার আত্মিক উদ্দেশ্য হলো নিরবিচ্ছিন্ন পরিবেশে আত্মনিয়ন্ত্রণের কৌশল আয়ত্ত করা এবং নিজের আত্মিক উন্নয়ন সাধন করা।

সর্বশেষ, উপাসনার মাধ্যমে আমরা আমাদের শরীরের জৈবিক, শরীরতত্বীয় এবং জীন-এপিজিন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রোগমুক্তি এবং আরোগ্য লাভ করা। আমাদের সুস্থ্য জীবন, সুস্থ্য এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করা এবং সর্বোপরি মানবউন্নয়নে ভূমিকা রাখা। উপাসনার মাধ্যমে যারা এই যাপিত জীবনে এই উদ্দেশ্য সাধন করতে পারেন, মৃত্যু পরবর্তী সময়ে প্রার্থনা তাদের পরিত্রাণে জন্য ভূমিকা রাখবে। যে উপাসনা যাপিত জীবনে কোনো গুনগত মানের উন্নয়ন করে না, মৃত্যুর পর সেই উপাসনা কোনো কাজে আসা যুক্তি-যুক্ত মনে হয় না।

[বি দ্রঃ বিষয়টি খুব-ই সংবেদনশীল। স্রষ্টা যাদের যথেষ্ট জ্ঞান দিয়েছেন, তারা নিশ্চয়ই এই লেখার তাৎপর্য এবং মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারবেন। ]

হামীম ইবনে কাওছার
ক্যানসাস, যুক্তরাষ্ট্র।


আরও দেখুন: