সাইক্লট্রন যন্ত্র নিয়ে ‘অসম্পূর্ণ সত্য’ নির্ভর মনগড়া রায়

ডা. আজমল কবির সরকার
2021-06-25 21:43:34
সাইক্লট্রন যন্ত্র নিয়ে ‘অসম্পূর্ণ সত্য’ নির্ভর মনগড়া রায়

ডা. আজমল কবির সরকার

ওয়েবসাইট র‌্যাঙ্কিং ও প্রমোশনাল সাইট অ্যালেক্সা’র রিপোর্ট অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ের দৈনিকটির অনলাইন ভার্সন দেশের পঞ্চম শীর্ষ-পঠিত সাইট আর পত্রিকাটির দৈনিক মুদ্রণ সংখ্যা উইকিপিডিয়ার মতে আড়াই লাখের বেশি। তো এমন একটি পত্রিকা যখন ‘কাজে লাগবে না তবু ৮০ কোটির যন্ত্র কেনা হচ্ছে ১৪৫ কোটিতে’- এমন শিরোনামে একটি রিপোর্ট করে তাও আবার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের লোগো ব্যবহার করে, তখন স্বভাবতই সংবাদটি অনেকের চিত্তাকর্ষণ করবে। ঘটনাক্রমে আমিও সংবাদটি পড়ার সুযোগ পেয়েছি।

পাঠ শুরু করা মাত্র দুটি বিষয়ে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে। এক. সংবাদটির লেখক অথবা সংকলনকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা কী হতে পারে। দুই. পত্রিকাটিতে প্রযুক্তি বিষয়ক রিপোর্টের গুণগত মানরক্ষা করার প্রয়োজন আদৌ অনুধাবন করা হয় কিনা।

এই রিপোর্ট জানাচ্ছে- দেশে বর্তমানে দুইটি সাইক্লট্রন যন্ত্রের সক্ষমতা ৯৮ শতাংশ অব্যবহৃত। কারণ সাইক্লট্রন উৎপাদিত এফ-১৮-এফডিজি ব্যবহার করে পরীক্ষা করতে সক্ষম এমন পেট-সিটি (PET-CT) মেশিন সারা দেশে সর্বমোট আটটি আছে। একই সঙ্গে রিপোর্টটি অনেক তথ্য জানাচ্ছে না, জানাতে পারছে না অথবা জানাতে চাইছে না। সেই তথ্যগুলো জানতে পারলে সহজেই বোঝা যাবে যে কেন এই রিপোর্টটি আসলে একটি ‘অসম্পূর্ণ সত্য’।

১. সরকারি পর্যায়ে এফডিজি উৎপাদনকারী সাইক্লট্রনটি কাজ শুরু করেছে বিগত এক বছর যাবৎ। এফডিজি ব্যবহারে সক্ষম এই আটটি পেট-সিটি মেশিনের সবগুলো কেবল ঢাকা জেলার গণ্ডিতেই স্থাপিত, যার মধ্যে পাঁচটি মেশিন সরকারি অর্থাৎ তুলনামূলক স্বল্পব্যয়ে ক্যানসারের পরীক্ষা করা যায়।

২. সারাদেশে ক্যানসার রোগীর দৈনিক কী পরিমাণ পেট-সিটি পরীক্ষা প্রয়োজন? ২০১৩’র এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে প্রতিবছর দুই লাখ লোকের ক্যানসার ধরা পড়ে। ধরা যাক, কেবল ক্যানসারের শুরুতেই পেট-সিটি করা হবে। তো, এই আটটি মেশিনের বর্তমান সক্ষমতা দিয়ে বছরে আট থেকে নয় হাজার লোকের পেট-সিটি স্ক্যান করা সম্ভব। তাহলে বাকি এক লাখ ৯০ হাজার ক্যানসার রোগীর কী হবে?

অদ্যাবধি আমাদের দেশের শ্রদ্ধেয় অনকোলজিস্টবৃন্দ যে পরিস্থিতিতে চিকিৎসা দিয়ে চলেছেন, তার তুলনা করা যায়- ‘চোখ, হাত-পা বেঁধে টেকনাফ থেকে সাঁতার দিয়ে সেন্টমার্টিন যাত্রা’র সঙ্গে। তবে আশার কথা হলো, সরকারের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মযজ্ঞে এসব দুর্দিনের অবসান শীঘ্রই হতে চলেছে।

ক্যানসার নির্ণয়ে পেট-সিটি মেশিন বসানো যাবে এমন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সারাদেশে বর্তমানে ১৫টি এবং এগুলোর মধ্যে রোগীর সার্ভিস রেকর্ডের আলোকে চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহকে অগ্রাধিকার দিয়ে একসঙ্গে কর্মপোযোগী করা হচ্ছে।

৩. সাইক্লট্রন যন্ত্রের সক্ষমতা কি আসলেই অব্যবহৃত? জনাব রিপোর্টার গণিতের পরাকাষ্ঠায় আরোহন করে পাঠককে দেখাচ্ছেন দুইটা সাইক্লট্রন উৎপাদিত এফডিজি দিয়েই দৈনিক চার হাজার রোগীর পরীক্ষা করা সম্ভব। পরিতাপের বিষয় উনি পদার্থবিজ্ঞান বোঝেন এমন কোনো লক্ষণ এই রিপোর্টে নেই। বরং, একজন জ্যেষ্ঠ সচিব অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে যখন তাকে বিষয়টা বোঝাতে চেয়েছেন, তবুও তিনি বুঝতে পারেন নাই। বাধ্য হয়ে তাই, আবারও বলছি, বাস্তবতা হলো- এফ-১৮-এফডিজি তেজষ্ক্রিয় হওয়ার কারণে তার ধর্মই হচ্ছে ১১০ মিনিট পর পর পরিমাণে অর্ধেক হয়ে যাওয়া।

এদিকে একজন রোগীকে এটা প্রয়োগ করে স্ক্যান করার আগে যেমন একঘণ্টা অপেক্ষা করাতে হয়, তেমনই স্ক্যান করতেও আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা, কখনো আরও বেশি সময় লাগে। তাই হাজার সদিচ্ছা থাকলেও দৈনিক আট কর্মঘণ্টায় একটা মেশিনে ১০ থেকে ১৫ জনের বেশি স্ক্যান করানো সম্ভব নয়। তদুপরি বাস্তবতা হলো যারা রোগীর স্ক্যান করছেন, তাদের occupational radiation exposure একটি নির্দিষ্ট মাত্রা রয়েছে যা কাজের পরিমাণ অর্থাৎ রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ হতে থাকে।

৪. ইস্যু যখন এফডিজি বিতরণ। ধরা যাক, মহাখালী তে একটি পেট-সিটি মেশিন রয়েছে এবং শাহবাগ যেখানে সরকারী সাইক্লট্রনটি অবস্থিত, সেখান থেকে সকাল ৮টায় এফডিজি-বাহী গাড়ি রওনা হলো। যানজটের এই রাজধানীতে একটি কর্মব্যস্ত দিনে এই পরিবহনের জন্য কী পরিমাণ সময় লাগতে পারে? সেই সময়টুকু পার হলে মহাখালীতে কতটুকু এফডিজি পৌঁছবে? তারও এক কাঠি ওপরে গিয়ে এই রিপোর্টে বলার চেষ্টা করা হচ্ছে- শাহবাগের উৎপাদন দিয়ে ময়মনসিংহ এবং চট্টগ্রামের চাহিদা মেটানোর কথা। আসলে সেটাও সম্ভব হবে যদি হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়। এখানে প্রশ্ন থাকবে, আপনার কি মনে হয় যে, সরকারি পরিকল্পনা যারা করেন, তারা সেই বিকল্প পদ্ধতির খরচ ও মুনাফা বিবেচনা না করেই ময়মনসিংহ এবং চট্টগ্রামে আলাদা সাইক্লট্রন বসানোর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন? এদিকে, সকাল ৮টায় এফডিজি-বাহী গাড়ীটিকে রওনা করানোর জন্য সাইক্লট্রন অপারেটরের দলটি কিন্তু আরও দুই ঘণ্টা আগে কাজ শুরু করে দিয়েছেন।

কাজেই, এফডিজি উৎপাদনের যে পরিমাণকে এই রিপোর্টে চার হাজার রোগীর জন্য যথেষ্ট বলা হয়েছে, তা দিয়ে খোদ রাজধানীতে ৪০ থেকে সর্বোচ্চ ১০০ জন রোগীর স্ক্যান করা যেতে পারে। এক সাইক্লট্রন’র উৎপাদন দিয়ে ১৫০-২০০টি পেট-সিটি মেশিন চালানোর ঐকিক নিয়ম দুঃখজনকভাবে পদার্থবিজ্ঞানের এই অধ্যায়ের জন্য প্রযোজ্য নয়।

অপরদিকে, ময়মনসিংহ এবং চট্টগ্রামে আলাদা সাইক্লট্রন স্থাপিত হলে ওই দুইটি জেলার প্রতিটির সঙ্গে যে ছয়টি করে জেলা সংলগ্ন রয়েছে, তাদেরকেও পর্যায়ক্রমে পেট-সিটি পরীক্ষা সেবার আওতায় আনার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

৫. কোনটি আগে কেনা প্রয়োজন- সাইক্লট্রন নাকি পেট-সিটি? রিপোর্টটিতে মোটাদাগে এবং চড়া গলায় বলা হচ্ছে পেট-সিটি মেশিন না থাকলে এফডিজি উৎপাদনকারী সাইক্লট্রন কেনার প্রয়োজন নেই। অথচ বাস্তবতা হলো এই দুই বস্তু একই সঙ্গে প্রয়োজন আর তাই একই প্রজেক্টের আওতায়, একই সঙ্গে স্থাপন করার জন্য চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন কাজ করে যাচ্ছে।

৬. নতুন সাইক্লট্রন কি শুধুই বাড়তি খরচ? রিপোর্টটি পড়ে এটাই মনে হয়েছে যে, সরকারের কয়েক কোটি টাকা সাশ্রয় করার জন্যে নেত্রকোনা বা কক্সবাজার থেকে রোগী মাত্র দুই-এক হাজার টাকা বাস ভাড়া খরচ করে ঢাকায় এসে পেট-সিটি পরীক্ষাটি করে গেলেই তো ভালো হয়। তবে আশার কথা বোধসম্পন্ন নাগরিকেরা এভাবে চিন্তা করেন না। চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহে একটি করে মেডিকেল সাইক্লট্রন স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ১৪টি জেলাকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ক্যানসার চিকিৎসার আওতায় আনার পথটি যেমন অনেকাংশে সুগম হবে, তেমনই অনেকগুলো অত্যন্ত দক্ষ ব্যক্তির কর্মসংস্থান তৈরি হবে।

৭. ‘জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে পেট-সিটি যন্ত্রই নেই’ মর্মে যে তথ্যটি রিপোর্টে এসেছে এটির বিপরীতে এটাও জানা প্রয়োজন যে, কেবল উক্ত প্রতিষ্ঠানের রোগীদের সেবা প্রদানের জন্যেই প্রতিষ্ঠানের ২০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে একটি ভবন নির্মিত হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তত্ত্বাবধানে সরকারিভাবে পেট-সিটিসহ আরও অনেক উচ্চ-প্রযুক্তির পরীক্ষা করার সুবিধা অচিরেই উন্মুক্ত হতে চলেছে।

৮. কেনা-কাটার অনিয়ম সংক্রান্ত অভিযোগ প্রসঙ্গে। রিপোর্টের মূল উদ্দেশ্য যদি এই অনিয়মের অবহিতিকরণ হয়, তবে রিপোর্টের ব্যাপ্তি সেটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকা বাঞ্ছনীয় এবং তথ্য-প্রমাণ থাকলে সেগুলো আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তুলে দেওয়াও যেতে পারে।

পরিশেষ। যে উপাদানকে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞবৃন্দ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় মনে করে কাজ শুরু করেছেন, সেখানে একটা ‘অসম্পূর্ণ সত্য’ নির্ভর মনগড়া রায় দিয়ে জাতীয় পর্যায়ের একটি গণমাধ্যমে অহেতুক জনবিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সকল দায়ী ব্যক্তিকে প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিমূলক প্রক্রিয়ার আওতায় এনে সতর্কবার্তা প্রদান করা উচিত।

লেখক: ডা. আজমল কবির সরকার

পিএইচডি গবেষক

সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি


আরও দেখুন: