এই চটকদার মিথ্যা নিউজ দেখে মেজাজ ঠিক রাখা সত্যিই দায়

ডা. ফাতেমা-তুজ-জোহরা
2021-06-25 20:45:36
এই চটকদার মিথ্যা নিউজ দেখে মেজাজ ঠিক রাখা সত্যিই দায়

ডা. ফাতেমা-তুজ-জোহরা

‘কাজে লাগবে না তবু ৮০ কোটির যন্ত্র কেনা হচ্ছে ১৪৫ কোটিতে’- একটি জাতীয় দৈনিকের এই নিউজ পড়ে সত্যিই বিস্মিত হয়ে গেলাম।

দেশে সাইক্লোট্রন যন্ত্র পর্যাপ্ত আছে? সত্যিই? যে দুইটি সাইক্লোট্রন আছে তাই যথেষ্ট?

সাভারে ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিকেল ফিজিক্স (আইএনএমপি) গত তিন বছর যাবৎ পেট-সিটি (PET-CT) স্ক্যানের মাধ্যেম ক্যানসার রোগীর সেবা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু এই সেবা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার পেছনে যে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়, সেই ব্যাকগ্রাউন্ডের গল্প কি এই সাংবাদিক জানেন? নাকি চটকদার শিরোনামে খবর ছাপলেই সেটার কাটতি বেড়ে যায়?

গত তিন সপ্তাহ সাভারে আইএনএমপি-তে পেট-সিটি সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে শুধু এই সাইক্লোট্রনের জন্য। ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে এফডিজি ক্রয় করে সাভারে নিয়ে যাওয়া হয়। ইউনাইটেড এর সাইক্লোট্রন মেশিনে প্রায়ই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। হঠাৎ করে কলাপ্স করতেছে। এফডিজি উৎপাদন করতে পারছে না। ফলশ্রুতিতে অনেক রোগী দেশের দূর-দূরান্ত থেকে সাভারে এসে ফেরত যাচ্ছেন। রোগীদের ভোগান্তি বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত।

এফডিজি’র হাফলাইফ মাত্র ১১০ মিনিট। ঢাকা থেকে সাভার যেতে যতটুকু এফডিজি প্রয়োজন, তার থেকে অনেক বেশি অ্যামাউন্ট আমাদের এফডিজি ক্রয় করতে হয় শুধু অল্প হাফলাইফের জন্য। তার ওপর আছে টেরিবল ট্রাফিক জ্যাম। এই ট্রাফিক জ্যাম উপেক্ষা করে ঢাকা থেকে সাভার যেতে কত লাখ টাকার এফডিজি ঢাকার বাতাসেই উড়ে যাচ্ছে এই হিসাব কি সাংবাদিক রেখেছেন? (বি.দ্র. আমিনবাজের এই লকডাউনে এখন রেগুলার ২/৩ ঘণ্টা করে ট্রাফিক জ্যাম চলছে)।

পেট-সিটি স্ক্যানের খরচ কেন এত বেশি। ইউনাইটেডসহ বাকি সব বেসরকারি হাসপাতালে এই ব্যয় ৫০-৬০ হাজার টাকা। সরকারিভাবে আমরা করছি ২৫-৩০ হাজার টাকায়। সাইক্লোট্রন’র স্বল্পতার জন্য দেশের হাজার হাজার রোগীকে গুনতে হচ্ছে একটা বড় অ্যামাউন্টের টাকা। সাইক্লোট্রন সংখ্যা পর্যাপ্ত হলে এই খরচ আরো কমে আসবে। গবেষণা কাজ উন্মুক্ত হবে। উপকার হবে দেশ ও দশের।

সাভার, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহে সাইক্লোট্রন এখন সময়ের দাবি। রিপোর্টে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে পেট-সিটি স্ক্যান মেশিন নাই, তবুও সাইক্লোট্রন কেনা হচ্ছে।

সাইক্লোট্রন রেডি না করে পেট-সিটি স্ক্যান মেশিন কেন কিনবে? অনসাইট সাইক্লোট্রন প্রস্তুতের পর পেট-সিটি স্ক্যান মেশিন কেনা হবে, তা না হলে পেট-সিটি স্ক্যান আগে ক্রয় করে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকলে সেটা হবে মেশিনের অপচয়।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিদ্যমান দুইটি সাইক্লোট্রন দিয়ে প্রতিদিন ৪,০০০ রোগীর পেট-সিটি স্ক্যান করা সম্ভব। এই রিপোর্ট কোন সূত্রে মেলানো হলো কিছুই বুঝলাম না। শিডিউলকৃত সপ্তাহের আটজন রোগীর পেট-সিটি স্ক্যানই করতে পারছি না আমরা!

ইউনাইটেডের মেশিনে সমস্যা। রোগীদের ক্রমাগত প্রেশারে যখন ক্লান্ত, তখন এই চটকদার মিথ্যা নিউজ দেখে মেজাজ ঠিক রাখা সত্যিই দায়।

আর প্রতিদিন ৪,০০০ পেট-সিটি স্ক্যান করার জন্য যে জনবল লাগবে তা কি আছে আমাদের? সাভারে আমি একা পেট-সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট করছি। সপ্তাহে ১৮/২০টা রিপোর্ট করতে কত সময় আর মনোযোগ প্রয়োজন তা কি উনারা জানেন? এই ৪,০০০ পেট-সিটি স্ক্যান রিপোর্ট করার জন্য কমপক্ষে ডাক্তার প্রয়োজন ৮,০০০। অথচ সারা বাংলাদেশে সর্বসাকল্যে আটজন পেট-সিটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

পেট-সিটি একটি বিশেষায়িত সেবা। এটা কোনো সাধারণ সেবা নয়। এই বিষয়ে যে দক্ষ জনবল প্রয়োজন, সেটা এই রিপোর্টে উল্লেখ নাই। এই কাজে প্রয়োজন বিজ্ঞানী, টেকনোলজিস্ট ও চিকিৎসকের দক্ষ টিম ওয়ার্ক।

ভাই, নিউজ করলে জেনে-শুনে করতে হয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ন্যূনতম নলেজ নিয়ে রিপোর্ট করতে হয়। না পারলে, এই বিষয়ের অভিজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হয়। গুগল ঘেটে সংখ্যা মিলিয়ে ঐকিক নিয়মে গাণিতিক রিপোর্ট করলেই সেটা একুরেট হয়ে যায় না!

দেশের ক্রমবর্ধমান ক্যানসার রোগীর সেবা কার্যক্রম পর্যাপ্ত করার জন্য সাইক্লোট্রন’র সংখ্যা বাড়ানো একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ। এজন্য এই সাইক্লোট্রন প্রজেক্টের ডিরেক্টর এম মনজুর আহসান স্যার যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হাতে নিয়েছেন, এজন্য তাকে সবার পক্ষ থেকে যেখানে সাধুবাদ জানানো প্রয়োজন, সেখানে এ রকম মিথ্যা ও গোজামিলে ভরা রিপোর্ট সত্যিই দুঃখজনক।

আমি নিজে পেট-সিটি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত আছি বিধায় এই মিথ্যা রিপোর্ট বয়কট করলাম।


আরও দেখুন: