নিরাপত্তার চাদর ইমিউনিটি: শরীর বনাম রাষ্ট্র
আমাদের শরীরের মত রাষ্ট্রেও আছে চেনা শত্রু, চেনা শত্রুর ছবি, তালিকা
(১) আমাদের জীবনে প্রথম প্রয়োজন অন্ন। অন্নের প্রয়োজন মিটে গেলে দরকার লজ্জা নিবারণ (বস্ত্র), এরপর নিরাপত্তা (বাসস্থান)। মানুষের শরীরকে এক নিরাপত্তার চাদর দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন আমাদের স্রষ্টা, মহান প্রতিপালক। এই নিরাপত্তা ব্যবস্থার নাম ইম্যুন সিস্টেম, বা শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। কিভাবে সাজানো হয়েছে এই ব্যবস্থাকে? মূলত দুটো ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমটিতে করা হয়েছে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা যা চব্বিশ ঘন্টা আমাদের নিরাপত্তা দেয়। একে বলে ইনেট ইম্যুন সিস্টেম। এটি মূলত প্রতিরক্ষা বেষ্টনী যাতে বাইরের ক্ষতিকর কোনো কিছু আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে না পারে। উদাহরণ: আমাদের ত্বক। ত্বক আমাদের সীমানা বেষ্টনী। কিন্তু ত্বকের কিছু কিছু জায়গায় ছিদ্র আছে যেখান থেকে ক্ষতিকর কোনো কিছু ঢুকে পড়তে পারে। তা বন্ধ করার জন্য আছে তরল প্রতিরক্ষা। যেমন: চোখের পানি, মুখের লালা ইত্যাদি। এই লালায় থাকে রোগ প্রতিরোধক্ষম বস্তু, যেমন ডিফেনসিন।
(২) সমস্ত প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙে যদি কোনোভাবে ক্ষতিকর কোনো কিছু আমাদের শরীরে প্রবেশ করে, তা ঠেকানোর জন্য থাকে সৈন্যবাহিনী। কিছু সৈন্য বাহিনী থাকে সদাপ্রস্তুত, যেমন নিউট্রোফিল। নিউট্রোফিল সরাসরি বহিঃশত্রুকে আক্রমণ করে নিঃশেষ করে দেয়। যদি কোনো কারণে শত্রু বেশি শক্তিশালী হয়, তাহলে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কমপ্লিমেন্ট সিস্টেমকে সক্রিয় করে। এই ব্যবস্থায় বড় শত্রুকে (যাকে নিউট্রোফিল খেয়ে ফেলতে পারে না) আক্রমণ করা হয় এবং এর শরীরে অসংখ্য ছিদ্র তৈরী করে দেয়া হয়। ছিদ্র তৈরী হবার কারণে সেই শত্রু বিনষ্ট হয়। যদি কোনো কারণে শত্রুকে রক্তের মধ্যে ধ্বংস করা না যায়, তাহলে তাকে ধরে নিয়ে আসা হয় লিমফ নোডে, সেখানে তাকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বৃহত্তর শক্তির মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়। যদি কোনো কারণে শত্রু দৃষ্টির অগোচরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে তার গায়ে রং লাগিয়ে দেয়া হয়, যাকে বলে অপসোনিন (কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম-এর একটি প্রোটিন অথবা ইম্যুনোগ্লোবিউলিন)- এই রং নিয়ে ভ্রাম্যমান শত্রুকে সুবিধাজনক সময়ের সুবিধাজনক স্থানে আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়।
(৩) শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অন্য একটি অংশের নাম ‘অর্জিত বা একোয়ার্ড ইম্যুনিটি’- এটি মূলত পরিচিত শত্রুকে ধ্বংস করার কাজে নিয়োজিত। একবার শরীরে কোনো শত্রু ঢুকলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাকে চিনে রাখে এবং স্মরণে রাখে যাতে ভবিষ্যতে আবার প্রবেশ করলে তাকে সাথে সাথেই মেরে ফেলা যায়। প্রতিষেধক টিকার মূল ধারণা এখান থেকেই এসেছে। আমাদের এই প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত আছে বিভিন্ন ধরণের সৈন্যবাহিনী। যেমন: নিউট্রোফিল, ম্যাক্রোফাজ। অনেক সৈন্য সার্বক্ষণিক টহলে নিয়োজিত (যেমন: প্রবাহমান নিউট্রোফিল), অনেক সৈন্য অস্থিমজ্জায় প্রস্তুত থাকে, শুধু প্রয়োজন হলেই আসে (রিজার্ভ ফোর্স)- এজন্য লক্ষণীয় যে রক্তে অক্সিজেন বহনকারী রেড ব্লাড সেল এবং প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় নিয়োজিত হোয়াইট ব্লাড সেলের অনুপাত ৫০০:১, কিন্তু অস্থিমজ্জায় এর অনুপাত ঠিক উল্টো। মানে হলো, সার্বক্ষণিক প্রবাহমান টহলদার আছে রক্তে, কিন্তু শরীরে কোনো আক্রমন হলেই কোটি কোটি সৈন্যই মুহূর্তেই অস্থিমজ্জা থেকে বেরিয়ে আসবে রক্তে শত্রুকে মোকাবেলা করতে।
(৪) প্রতিটি রাষ্ট্রেরও একটা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকে। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রায় আমাদের শরীরের মতোই। আসুন, সমাঞ্জস্য দেখি। প্রতিটা রাষ্ট্রের একটি সীমানা বেড়ি থাকে যা সার্বক্ষণিকভাবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। কিন্তু এই সীমানার কিছু কিছু জায়গায় ছিদ্র থাকে, যাকে আমরা সাধারণত "বর্ডার" বা "পোর্ট অব এন্ট্রি" বলি, যেমন বেনাপোল বর্ডার। যেহেতু এখন সীমানাবেড়ী থাকে না, সে কারণে এখানে সৈন্য, কাস্টমস অফিসার থাকেন যাতে কোনো মাদক, চোরাচালানি বা দেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো কিছু না ঢুকতে পারে। ঠিক যেমন করে আমাদের মুখের লালায় থাকে, আমাদের চোখের অশ্রুতে থাকে যাতে শরীরে ক্ষতিকর কোনো কিছু না ঢুকতে পারে এই "পোর্ট অব এন্ট্রি" দিয়ে।
আমাদের শরীরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় টহলদার পুলিশ থাকে যারা সার্বক্ষণিক ক্ষতিকর মানুষের উপর নজর রাখে, যেমন রাখে আমাদের শরীরের নিউট্রোফিল। দেশের কোনো শত্রু যদি বেশি শক্তিশালী হয়, তবে তাকে থানায় নিয়ে যাওয়ায় হয়, রিমান্ডে নেয়া হয়, যেমনটি হয় আমাদের শরীরের লিমফ নোডে। লিমফ নোডগুলো একেকটি থানা। অনেক কুখ্যাত শত্রুকে রাতের অন্ধকারে গুলি করে হত্যা করা হয় (ক্রস ফায়ার?), যেমনটি করে আমাদের শরীরের কমপ্লিমেন্ট সিস্টেমের "মেমব্রেন এটাক কমপ্লেক্স"- যা শত্রুর শরীর ছিদ্র করে ঝাঁঝরা করে দেয়!
(৫) দেশে যখন বড় আকারের ঝামেলা হয় এবং সৈন্যের সংখ্যার চেয়ে শত্রুপক্ষ বড় বা সংখ্যায় বেশি হয়, তখন সেসব জায়গায়‘ওয়াটার ক্যানন’ থেকে গরম এবং রঙিন পানি মারা হয়। এই রঙিন পানি মেরে তাদের ছত্রভঙ্গ করা হয়, আবার বিভিন্ন চেকপোস্টে পুলিশ বসিয়ে রেখে যাদের গায়ে রঙিন পানি লাগানো আছে তাদের গ্রেপ্তার করা যায়। এই রঙিন পানি হলো ‘অপসোনিন’ যা আমাদের শরীরে শত্রুর গায়ে লাগিয়ে দেয়া হয় এবং পরে সুবিধাজনক স্থানে পেলে তাকে ধ্বংস করা হয়। আমাদের শরীরের মত রাষ্ট্রেও ভ্রাম্যমান পুলিশ থাকে কিন্তু দেশে কোনো বিশৃঙ্খলতা তৈরী হলে মুহূর্তে হাজার হাজার সৈন্য, রিজার্ভ ফোর্স, বিজিবি, প্যারামিলিটারি, এবং প্রয়োজনে সেনাবাহিনী নামিয়ে দেয়া হয়। রাষ্ট্রে সার্বক্ষণিক টহলরত পুলিশের চেয়ে প্রস্তুত কিন্তু টহলরত নয় এমন সৈন্যের সংখ্যা অনেক বেশি (ঠিক যেমন অস্থিমজ্জায় অবস্থিত, অপেক্ষারত, সদাপ্রস্তুত আক্রমণবাহিনীর সংখ্যা অনেকগুন বেশি)
(৬) রাষ্ট্রে নিরাপত্তায় থাকে সেনা, বিমান, নৌ- এই সব বাহিনী। তার কারণ- কিছু জায়গায় বিমানে যেতে হয় শত্রুকে মোকাবেলা করতে, কিছু জায়গায় জলপথে। ঠিক একই ভাবে আমাদের শরীরেও কোনো কোনো জায়গায় নিউট্রোফিল আক্রমন করে, কোনো কোনো জায়গায় নিউট্রোফিল যেতে পারে না, সেখানে মনোসাইট যেয়ে পরিবর্তিত হয়ে ম্যাক্রোফাজ-এ পরিণত হয় এবং শত্রুকে আক্রমন করে। এমন করে আছে হিস্টিওসাইট এবং অন্যান্য সৈন্য। আমাদের শরীরের মত রাষ্ট্রেও আছে চেনা শত্রু, চেনা শত্রুর ছবি, তালিকা। প্রতিটি থানায় তাদের ছবি রাখা হয়। একবার অপরাধ করলে তাকে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চিনে রাখে। সে কোথায় যায়, কি করে তার হিসেবে রাখে। কোনো অঘটন ঘটলেই তাকে তাৎক্ষণিক ভাবে গ্রেপ্তার করা হয়, যেমনটি করে আমাদের শরীরের একোয়ার্ড ইম্যুনিটি।
(৭) আমাদের শরীর এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার এই যে মিল, এটা কে কাকে অনুসরণ করেছে? রাষ্ট্র শরীরকে না কি শরীর রাষ্ট্রকে? যদি রাষ্ট্র শরীরকে অনুসরণ করে থাকে, তাহলে শরীরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমং নিখুঁতভাবে কে সাজিয়েছে? এক চোর ধরেই কত পদক পান আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, পান রাষ্ট্রপতি পদক। কিন্তু এই নিরাপত্তা ব্যবস্থার ধারণা তারা কোথা থেকে পেয়েছেন? মানুষের শরীরের এই প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর গবেষনা করে কত জন বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, জানেন না কি? এ পর্যন্ত তেরো বার নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে প্রায় ত্রিশজন বিজ্ঞানীকে মানুষের শরীরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করে তা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য। তারা তো শুধু ‘ডিসকভার’ করেছেন, ‘ক্রিয়েট’ করেন নি। গবেষণার মাধ্যমে ‘ডিসকভার’ করেই তারা পেয়েছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মর্যাদা - নোবেল পুরস্কার। আর যিনি এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছেন, যিনি এর মূল পরিকল্পনাকারী, যিনি তৈরী করেছেন এর নীল নকশা, এবং এর ওয়ার্কিং গাইডলাউন - তাকে আপনারা চেনেন না কি? তার সাথে আপনাদের পরিচয় হয়েছে না কি?
(৮) রাষ্ট্রপতির পদক পাওয়া পুলিশকে চিনলেন, নোবেল পুরস্কার পাওয়া বিজ্ঞানী কে চিনলেন, যারা কেউই এই নিরাপত্তা ব্যবস্থার ‘ক্রিয়েটর’ নন, তারা শুধু ‘ডিজকভারার’! আমরা ডিজকভারার কে চিনি, পদকপ্রাপ্তকে চিনি, কিন্তু আমরা ‘ক্রিয়েটর’ কে চিনি না। আপনি কি এমন কোন বিজ্ঞানীকে চিনেন যিনি এমন সুচারুভাবে আপনার শরীরকে নিরবিচ্ছিন্ন নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দিতে পারতো?
ফাবি আইয়্যি আলাইয়ি রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান?
তুমি তোমার স্রষ্টার কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করবে?
বিঃ দ্রঃ লেখাটি সহজবোধ্য এবং সংক্ষেপ রাখার জন্য বিজ্ঞানের অনেক কিছু অতি সরলীকরণ করা হয়েছে অথবা সংক্ষিপ্তকরণ করা হয়েছে। কিন্তু, আমি চিন্তার পোঁকা আপনাদের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিলাম, এই পোকা ‘চিন্তাশীলদের’ ঘুম হারাম করে দেবে, ইনশাআল্লাহ।
শুধু এই বিষয়ের উপর-ই একটি বিস্তারিত বই লেখা সম্ভব। আপনারা পড়াশুনা করে বই লিখবেন। আমার বই লেখার সময় নেই।
হামীম ইবনে কাওছার
ক্যানসাস, যুক্তরাষ্ট্র।