বৈষম্য থেকে হতাশা আর হতাশা সৃষ্টি করছে ক্ষোভের

কবিতা খানম
2021-06-22 14:29:16
বৈষম্য থেকে হতাশা আর হতাশা সৃষ্টি করছে ক্ষোভের

কর্মস্থলে যাওয়ার পথে হয়রানির শিকার হন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জেনি

​কিছুদিন আগের একটি ঘটনা আমাকে আলোড়িত করেছে। শুধু আমাকে কেন সচেতন অনেককেই হয়তো আলোড়িত করেছে। লিখব লিখব ভাবছিলাম কিন্তু লেখা হয়ে ওঠেনি। তাই দেরিতে হলেও বিষয়টা নিয়ে একটু আলোচনা করতে চাই। আমরা সব সময় আইনের শাসনের কথা বলি, কিন্তু যারা বলি তারাই আইন মানতে চাই না।

আইনে তো অনেক কিছু আছে কিন্তু আইন প্রয়োগের সময় কমনসেন্স এপ্লাই করতে হয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিতে হয়। পুলিশ যাতে আইনের কাঠামোর মধ্যে থাকে সে কারণেই এই ধরণের কোন অভিযান ম্যাজিস্ট্রেট সমন্বয়ে হয়ে থাকে। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট পরিস্থিতি হ্যান্ডেল করতে পারে নাই।  সেদিনের ঘটনা দেখে মনে হয়েছে যে, কিছুটা ক্ষোভের বিস্ফোরণও ঘটেছে।

​হ্যাঁ, আমি ১৮ এপ্রিল ২০২১ তারিখের ঘটনার কথা বলছি। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি বিভাগের একজন এসোসিয়েট প্রফেসরের (ডা. জেনির) সঙ্গে যে বাক বিতন্ডার ঘটনাটি ঘটেছিল আমি সেই ঘটনার সূত্র ধরেই আজকের এই লেখাটার সূত্রপাত করতে চাচ্ছি। কারণ ঘটনাটি দেখে আমার মনে হয়েছে আমরা পরস্পরকে সম্মান করার অবস্থান থেকে দিন দিন সরে আসছি।

একজন ডাক্তারকে ‘তিনি একজন ডাক্তার’ এটা বিশ্বাস করানোর জন্য কতটা স্বাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপনার প্রয়োজন? তাঁর বয়স, গেটআপ, (মিথ্যা কথা বলছে তা বিশ্বাস করার মতো কি?) এপ্রোন, গাড়িতে থাকা স্টিকার, পরিচালক কর্তৃক প্রদত্ত সনদ সবগুলোই কি ভেজাল মনে হয়েছিল?

ধৈর্যের কতটা পরীক্ষা দিতে হলে এবং নিজেকে কতটা অসন্মানিত মনে হলে তিনি গাড়ি থেকে নামতে বাধ্য হয়েছিলেন? রাস্তায় তাৎক্ষনিকভাবে এর চেয়ে বেশি প্রমাণ হাজির করা কি সম্ভব ছিল?

আমরা অনেক বাবা মা-ই এখনও ছেলেমেয়েদের ডাক্তারী পড়ানোর ইচ্ছা মনের মধ্যে পোষণ করে থাকি। এই ঘটনার পর ডাক্তার ছেলেমেয়েদের বাবা মা নিশ্চয়ই নিরাপত্ত্বাহীনতায় ভুগতে থাকবেন। এই মহামারিতে যারা পরিচয় যাচাইয়ের দায়িত্বে ছিলেন তারাও যেমন জরুরি দায়িত্ব পালন করছিলেন এবং যার পরিচয় নিয়ে বাক বিতন্ডার ঘটনা ঘটেছিল তিনিও জরুরি সেবা প্রদানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু তারপরেও এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কেন ঘটবে? পারস্পরিক সম্মান বোধের অভাব থেকেই এই ধরনের ঘটনার অবতারনা হয়েছে বলে আমার মনে হয়।

​আসলে প্রত্যেকটা প্রফেশনের মধ্যে যে বৈষম্য তৈরি হয়েছে তারই একটা প্রতিফলন সেদিন ঘটেছে। প্রতিটা প্রফেশনের নিজস্ব একটা অধিক্ষেত্র আছে। এই অধিক্ষেত্রের বাইরে আসাকে সীমালংঘন বলে। প্রত্যেকটা প্রফেশনে থাকা লোকজনেরও একটা আত্মমর্যাদা আছে। সেই আত্মমর্যাদা যখন লংঘিত হয় তখনই এই ধরনের ঘটনা ঘটে। প্রফেশনগুলোর মধ্যে এই বৈষম্য তরুণদের মাঝে হতাশা তৈরি করছে।

আর এই হতাশা জন্ম দিচ্ছে বিদ্বেষের। দেশ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করতে হলে প্রত্যেক প্রফেশনের দরকার। প্রশাসন, পুলিশ, বিচারক, শিক্ষক, কৃষিবিদ, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, কৃষক, শ্রমিক সবই দরকার। প্রত্যেকের উচিত প্রত্যেককে সম্মান করা। কারো তার অধিক্ষেত্র লংঘন করা উচিত নয়, যার কাজ যা তাকে তা সঠিকভাবে করতে দেয়া উচিত। একটা ক্যাডারের উচিত নয় আরেকটা ক্যাডারের উপর ক্ষমতা দেখানো, যা আমাদের দেশে হরহামেশাই হচ্ছে এবং তার কারনেই সৃষ্টি হচ্ছে বৈষম্য, তৈরি হচ্ছে হতাশা। যা সুদূর ভবিষ্যতের জন্য মোটেই মঙ্গলজনক নয়।

​সরকারি চাকরিজীবি মানেই সরকারের চাকর এবং জনগনের প্রাপ্য সেবা প্রদানে বাধ্য। প্রশাসন সরকারের প্রতিনিধি। তারা সমস্ত বিভাগের মধ্যে সমন্বয় করবে, শাসন নয়। পুলিশ আইন প্রয়োগ করবে আইনের কাঠামোর মধ্যে থেকে। আইন যখন বে-আইনী ভাবে প্রয়োগ করা হয় বা অপপ্রয়োগ করা হয় তখন সেটা ক্ষমতায় রুপ নেয়। আমার ইউনিফর্ম যদি আমাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তবে আমি অন্যকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতে বলবো কিভাবে?

উপজেলা ইউনিটে প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সবাইকে নিয়ে সমন্বয় করবেন শাসন করবেন না বা তার অধিক্ষেত্রের বাইরে গিয়ে অন্যের আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে এমন কোন কাজ করবেন না। একজন সিনিয়র ডাক্তারের বক্তব্য, তিনি ২৪তম বিসিএসের একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।

উপজেলার একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তার স্ত্রীর ব্লাড প্রেশার মাপার জন্য তাকে তার বাসায় ডেকে পাঠান এবং তাকে তার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রেশার মাপার মেশিন সহ তার বাসায় যেতে হয়। একজন ডাক্তার হাসপাতালেই সেবা দিবে কারো বাসায় গিয়ে নয়। পরিস্থিতি সেরকম হলে ডাক্তার নিজেই সিদ্ধান্ত নিবেন। কারণ হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় বাইরে কারো প্রেশার দেখার জন্য গেলে হাসপাতালে অপেক্ষমান রোগীদের অধিকার বিঘ্নিত হয়, সেটা অন্যায়।

উপজেলায় বসে আপনি যে হুকুম জারি করছেন এবং একজন চিকিৎসককে হয়তো বিভিন্ন কথা ভেবে তার বাসায় যেতে হচ্ছে। ঢাকায় এসে আপনি একজন চিকিৎসককে প্রেশার মাপার জন্য বাসায় নেওয়ার কথা চিন্তা করবেন কী?

মফস্বলে আপনি আপনার গায়ের জোরে অথবা ক্ষমতার জোরে যেটা করছেন তা আপনি অন্য কোথাও করতে পারবেন না। অথচ আইন দ্বারা যদি এটা সমর্থিত হতো তাহলে কিন্তু আপনি সব জায়গাতেই এটা করতে পারতেন।

​ইদানিং শুনতে পাই ছেলেমেয়েরা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সংগে সংগে বিশেষ একটি ক্যাডারে চাকুরি করার উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি নিতে থাকে। অনেক মেধাবী ছেলেমেয়ে টেকনিকেল লাইনে পড়াশোনা করেও বিশেষ ক্যাডারে চাকরি করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে।

সব স্বর্গীয় সুখ কি এখানেই? আমি আগেই বলেছি দেশের উন্নয়নের জন্য সব ধরনের মেধারই প্রয়োজন আছে কিন্তু মেধাবীরা যদি নিজস্ব পথ হারিয়ে বিপথে হাঁটতে চায় তাহলে এদেশ থেকে মেধা পাচার হতেই থাকবে। 

মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে কেন দেশের মেধাবী ছেলেমেয়েরা হতাশায় ভুগবে? কেন কোন বিশেষ ক্যাডারের প্রতি তাদের অনাকাঙ্খিত মোহ বা আসক্তি তৈরি হবে? তাহলে চাকরির সব সুযোগ-সুবিধা, সম্মান কি দু-একটা বিশেষ ক্যাডারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে?

​একজন বাবার কথায় জেনেছি তার বড় ছেলেটি অত্যন্ত মেধাবী এবং তার বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফলও অত্যন্ত ভালো। সে একজন ডাক্তার এবং কার্ডিয়াক সার্জারির মতো একটি জটিল বিষয় নিয়ে সে পড়াশোনা করেছে। অথচ সে যে পোস্টে আছে এবং যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে তার ৫ বৎসরের ছোট ভাই অন্য একটি ক্যাডারে জয়েন করে তার চেয়ে উচ্চতর পদে অবস্থান করছে এবং অধিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। বাবার হতাশা এখানে নয় বাবার হতাশা তার ডাক্তার ছেলের নিরাপত্ত্বাহীনতার কথা ভেবে এবং সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে বৈষম্য রয়েছে সে বৈষম্যের কথা ভেবে।

এই দেশটা সবার, সবাই এখানে সমান অধিকার ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে চায়। তাই সব প্রফেশনেরই সঠিক মূল্যায়ন হওয়া উচিত। আইনকে তার নিজস্ব পথে চলতে দেওয়া উচিত। কখনোই উচিত নয় আইন হাতে তুলে নিয়ে নিজস্ব সুবিধা মতো প্রয়োগ করা। না হলে ইতোমধ্যে যে হতাশায় মেধাবীরা দেশের বাইরে যাওয়ার পথ ধরেছে অদূর ভবিষ্যতে তার কালোছায়া দেশের অগ্রগতির অন্তরায় হতে সময় নিবে বলে মনে হয় না। কারণ হতাশার আত্মগ্লানি থেকে আর যাই হোক ভালো কোন কিছু সৃষ্টি হয় না।

(কবিতা খানমের ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া) 


আরও দেখুন: