সেক্স, টেলোমেয়ার এন্ড সেল্যুলার সেনেসসেন্স
টেলোমেয়ারএতে, ত্বক সুন্দর, মসৃন এবং লাস্যময় থাকবে
পৃথিবীতে সবকিছুই একটা বিনিয়োগ। আমরা এই বিনিয়োগের বিনিময়ে লাভ চাই- নগদে অথবা বাকি তে, বর্তমানে বা ভবিষ্যতে, ইহলোকে বা পরলোকে। এই বিনিয়োগের মাধ্যমে লাভ পাওয়াকে ব্যবসাশাস্ত্রে বলে ‘রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট’ বা ‘আরওআই’। বিবাহ এবং দাম্পত্য জীবন একটি বিনিয়োগ- সময়, অর্থ, দেহ, মন এবং আবেগের বিনিয়োগ।
এই বিনিয়োগের রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট কি? বাঙালী সমাজ ব্যবস্থায় বিবাহের রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট শুধু ‘প্রজনন এবং বংশবিস্তার’ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। আসলে, এই বিনিয়োগ হলো দুইজন মানুষের সবচেয়ে বেশি এবং দীর্ঘকালীন বিনিয়োগ। অথচ, মানুষেরা এই বিনিয়োগ থেকে কোনোভাবেই লাভবান হয় না, বিজ্ঞান না জানার কারণে। অজ্ঞতা আর লজ্জায়! এ বিষয় নিয়ে অনেক কিছু লেখার আছে, কিন্তু আমার ধারণা সে জ্ঞান ধারণ করার মানসিক বিত পরিধি বেশিরভাগ মানুষেরই নেই! তবুও, পরীক্ষামূলক ভাবে আমি দুই-একটি কিস্তি লিখি। দেখি কি হয়! বাকি আল্লাহ ভরসা।
(১)
অক্টবর ১৯৯৮। ইন্টার্নশিপ ট্রেনিং শেষ করার ১৯ দিন পর আমার প্রথম চাকুরী শুরু।
আমেরিকান সরকারের অর্থায়নে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় পাঁচ মাসের চুক্তিতে চাকরি শুরু করলাম। ঢাকা থেকে চাকুরীতে জয়েন করে বরিশালে চলে এলাম। চাকরির প্রথম সপ্তাহেই এই সংস্থার অত্যন্ত প্রভাবশালী এক কর্মকর্তা বরিশালে আসলেন। তিনি বাংলাদেশে সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিব। কোনো এক কারণে সচিব পদমর্যাদার মানুষদের অন্য মানুষেরা অসম্ভব ভয় পান। অকারণে ‘সচিব মহোদয়কে স্যার’ বলে সম্বোধন করে। আমার সংস্থার হোমরা-চোমড়ারা তাকে বরিশাল বিমান বন্দর থেকে আনতে গেলেন। তিনি বরিশাল সার্কিট হাউজে উঠলেন। আমি চাকরিতে নতুন, স্বল্পমেয়াদি চাকরি। এমনিতেই তেলাতেলির মানুষ না আমি, এজন্য ওই দৌড়াদৌড়িতে অংশগ্রহণ করলাম না। আমি সন্ধ্যায় আমার উপরস্থদের সঙ্গে প্রাক্তন সচিব-এর সাথে দেখা করতে গেলাম। আমরা সার্কিট হাউজে উনার রুমে ঢুকলাম। জুতা পরে ঢুকবে না খুলে ঢুকবে, তা নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ!
(২)
সচিব সাহেব সোফায় বসা। আমরা পরিচয় দিলাম, বাংলায় কথা বলছি। তিনি ইংরেজিতে বলছেন।
বাংলাদেশে ইংরেজী বলা লোকদের আমরা ভয় পাই। বিদেশী মানুষ বা বিদেশী সংস্থায় কাজ করা বাংলাদেশী এবং সচিব শ্রেণীর মানুষেরা ইংরেজি বলার চেষ্টা করেন। যখন আটকে যান, তার ‘ইউ নো’ বলে ‘তাদের না জানা ইংরেজি শব্দ’ পূরণ করেন। আমরা যেমন অনেক কথা বাংলায় অর্ধেক বলে পরের শব্দ খুঁজে না পেলে বলি, বুচ্ছস তো? আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ সচারচর ইংরেজিতে কথা বলে না। তবে রেগে গেলে সাধারণ মানুষও ইংরেজিতে কথা বলে, রাগের তীব্রতা যত বাড়ে, ইংরেজী ভুল বলার মাত্রাও তত বাড়ে। কিন্তু সচিব মহোদয় রাগ না, হেসে হেসে ইংরেজি বলছেন। কোনো ভুল হচ্ছে না। ইংরেজিতে ঠাট্টা-তামাশা করছেন। উনার ইংরেজি কথাবার্তা শুনে বেরিয়ে আসবো। এমন সময় আমাদের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা উনাকে বললেন, ‘স্যার, আপনি তো অবসরপ্রাপ্ত সচিব কিন্তু আপনাকে দেখে পুরোদস্তুর যুবক মনে হয়। এতো সুস্বাস্থ্য এবং যৌবনের রহস্য কি?"
অবসরপ্রাপ্ত সচিব মহোদয় আমাদের দরজা থেকে বিদায় দিতে দিতে বললেন ‘প্রাকটিস সেক্স এভরি ডে, ইউ উইল রিটেইন গুড হেলথ এন্ড ইয়ুথ’।
(৩)
আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে যৌবন পরাগত হয় কৌষিক বয়স্কতার কারণে। আমাদের কোষের বৃদ্ধ হয়ে যাবার এই পদ্ধতিকে বলে সেনেসসেন্স। ক্রমাগত কোষ বিভাজনের সাথে সাথে আমাদের ক্রোমোজোমের দৈর্ঘ্যে হ্রাস পায়। ক্রোমোজোমের দৈর্ঘ্যের হ্রাসের কারণে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনের ঘাটতি হয় এবং কোষ বিভাজন বন্ধ হয়ে যায়। কোষ বিভাজন বন্ধ হয়ে যাওয়া মানেই মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হওয়া। এক বলা হয় ‘সেলুলার সেনেসসেন্স’। ক্রোমোজোমের এই দৈর্ঘ্যহ্রাস প্রতিরোধ করার জন্য ক্রোমোজোমের প্রান্তে ‘রিপিটেটিভ নিউক্লিওটাইড সিকুয়েন্স’ থাকে যাদের কাজ হলো ক্রোমোজোমের দৈর্ঘ্য যাতে কোষ বিভাজনের সাথে সাথে ছোট হয়ে না যায়। এই নিউক্লিওটাইড সিকুয়েন্স, যাকে বলা হয় ‘টেলোমার সিক্যুয়েন্স’ মূলত ছয়টা নিউক্লিওটাইড-এর পুনরাবৃত্তি। এই ছয়টি নিউক্লিওটাইড হলো TTAGGG, যা প্রায় আড়াই হাজার বার পুনরাবৃত্তি হয় মানুষের প্রতিটি ক্রোমোজোমে। টেলোমারেজ নামের একটি এনজাইম এই টেলোমেয়ার-এর দৈর্ঘ্য সুরক্ষিত করার প্রয়াসে কাজ করে যাতে করে টেলোমেয়ার-এর দৈর্ঘ্য কোষ বিভাজনের সাথে সাথে কমে না যায়। এই টেলোমারেজ এনজাইম এবং এর ক্রিয়াপদ্ধতি আবিষ্কার করার কারণে ২০০৯ সালে এলিজাবেথ ব্ল্যাকবার্ন, ক্যারোল গ্রেইডার এবং জ্যাক জোস্টাক সম্মিলিতভাবে নোবেল পুরস্কার পান।
(৪)
টেলোমারেজ এনজাইম এর কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ বৃদ্ধি করে কোষের বৃদ্ধতা প্রতিরোধ করার উপায় বের করার জন্য বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন। টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্য যদি না কমে, তবে কোষের বিভাজন বন্ধ হবে না, ফলে কোষ বৃদ্ধ হবে না। কোষ বৃদ্ধ না হলেই আমাদের যৌবন ধরে রাখা সম্ভব হবে। এমন বৈজ্ঞানিক গবেষণার উপর ভিত্তি করে অনেক নামকরা কোম্পানি তাদের প্রসাধনীতে টেলোমারেজ এনজাইম ব্যবহার করেন যাতে ত্বকের কোষের ক্রোমোজোমে টেলোমেয়ার এর দৈর্ঘ্য না কমে এবং কোষের বিভাজন যেন বন্ধ না হয়। এতে, ত্বক সুন্দর, মসৃন এবং লাস্যময় থাকবে। টেলোমারেজ সমৃদ্ধ এইসব দামি প্রসাধনী মেয়েদের কাছে অত্যন্ত লোভনীয়। এছাড়া, অনেক খাবার আছে যা টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্য দীর্ঘ রাখতে সাহার্য করে, অনেক খাবার এটাকে খর্ব করে।
(৫)
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক দাম্পত্য সু-সম্পর্ক, নিয়মিত যৌনক্রিয়া এবং মানসিক প্রশান্তির সাথে টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্য এবং টেলোমারেজ এনজাইমের সক্রিয়তা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তারা তাদের গবেষণার ফলাফল ‘সাইকোনিউরোএন্ডোক্রাইনোলজি’ জার্নালে প্রকাশ করেছেন।* তাদের এই গবেষণায় তারা ১২৯ জন মহিলাকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং তারা দেখেছেন, যেসব মহিলারা নিয়মিত যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত ছিলেন, তাদের ‘পেরিফেরাল ব্লাড মনোনিউক্লিয়ার সেল’ এ টেলোমেয়ার-এর দৈর্ঘ্য, যারা যৌনক্রিয়া করেন নি তাদের চেয়ে অর্থপূর্ণভাবে বেশি দীর্ঘ ছিল। তারা অবশ্য টেলোমারেজ এনজাইমের সক্রিয়তায় কোনো ব্যবধান লক্ষ্য করেন নি। তারা গবেষণার উপসংহারে বলেছেন যে ‘সেক্সচুয়াল ইন্টিম্যাসি ইজ এসোসিয়েটেড উইথ লংগার টেলোমেয়ার লেংথ’।
(৬)
মেয়েদের যৌনাকাঙ্খা বয়সের সাথে ব্যাস্তানুপাতিক কিন্তু তাদের বয়স কমিয়ে রাখার অদম্য ইচ্ছে বয়স বৃদ্ধির সাথে সমানুপাতিক।
যৌবন ধরে রাখার জন্য নিয়মিত যৌনসম্পর্ক! এ তো বিনামূল্যে মহৌষধি!
আমার খুব ইংরেজি বলা সেই অবসরপ্রাপ্ত সচিব মহোদয়ের কথা মনে পড়ছে। বিজ্ঞানের ছাত্র না হয়েও তিনি কি সুন্দর বৈজ্ঞানিক কথা বলেছিলেন তেইশ বছর আগে। সবার টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ বৃদ্ধি পাক, হালাল উপায়ে। সবাই বিজ্ঞান মেনে চলুন, ধর্মীয় মতে, বৈধভাবে। সবাই যৌবন ধরে রাখুক! সবাই দীর্ঘজীবী হোক।
একটা প্রশ্ন রেখে শেষ করি। আমাদের মহান প্রতিপালক স্ত্রীজাতির প্রজনন পঞ্চাশে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন, অথচ পুরুষদের দিয়েছেন আমৃত্যু। কেন তিনি এমন করলেন? এর পিছনে স্রষ্টার কি রহস্য আছে? চিন্তাশীলদের জন্যই তো ভাবনা! আপনি ভেবে কি পেয়েছেন? না কি ভাবার সময় পান নি?
হামীম ইবনে কাওছার
ক্যানসাস, যুক্তরাষ্ট্র।