অশ্রু

ডা. হামীম ইবনে কাওছার
2021-06-14 23:13:29
অশ্রু

আমি শুনেছি। তিনি আমার রুগী-কাম বন্ধু। আমি তাকে সাপোর্ট করেছি।

কিছুক্ষন আগে তার স্ত্রী চোখ লুকাচ্ছিলেন যাতে আমি তাকে না দেখতে পারি। এখন, আমি চোখ লুকাচ্ছি যাতে তাদের দুজনের কেউই আমার অশ্রুসজল চোখ না দেখতে পারেন! (গত পর্বের পর..)

(৭) আমি একটু ঘুরে বসলাম। তিনি আবার শুরু করলেন। কিন্তু, একটা অবাক হবার মত কান্ড ঘটলো। আমি স্কুলে একটা মেয়েকে পছন্দ করতাম। তার নাম ক্যামেলিয়া কাবেরী। সে আমার ক্লাসে পড়তো। চোখাচোখি হতো, কিন্তু কোনোদিন কথা হয় নি। আমি ভাবতাম, যদি কোনোদিন আমি ভালো কিছু করতে পারি, তাহলে সেদিন তাকে যেয়ে আমার ভালোবাসার কথা বলবো। মেয়েটি আমার চোখের ভাষা পড়তে পারতো। স্কুলে সবাই জানতো যে আমি ডাক্তার মেরে জেলে আছি। কিন্তু কেউ দেখতে আসে নি। একদিন, স্কুল শেষে সেই মেয়েটি দেখতে এলো। সাথে নিয়ে এলো তার নিজের হাতে বানানো মাফিন। কিছুক্ষন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার হাতে মাফিনের প্যাকেট দিয়ে বললো, এটা খেয়ো। তোমার জন্য বানিয়েছি। আমি তার হাতটা ছুঁয়ে দিলাম। বলেই তিনি শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। আর আমি নিঃশব্দে!

(৮) জেল থেকে ছাড়া পেলাম। আমি সে শহর থেকে চলে এলাম। একা একা থাকবো বলে। সেখান থেকে কাজ শুরু করলাম। ত্রিশ বছর পর আমার নিজের কোম্পানি হলো, আমি কোম্পানির মালিক। আমার স্ত্রীকে বিয়ে করলাম। এরপর আমার প্রোস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়লো। আমি জানি আমি বেশিদিন হয়তো বাঁচবো না। ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু ইদানিং আমার ক্যামেলিয়াকে খুব মনে পড়ছে। আমি আমার সেই পুরোনো শহরে ফিরে যেয়ে তাকে খুঁজেছি। শুনেছি সে কিছদিন পরেই শিকাগো চলে গিয়েছিলো। তারপর আর কিছু জানি না। ডক্টর, আমি মারা যাওয়ার আগে আরেকবার তার হাতটা ছুঁতে চাই। সে আমার বড় আপন ডাক্তার! তার গলা কাঁপছে। আমি নীরব। পিন পতন নীরবতা, সাইলেন্স! আমি নিজেকে গুছিয়ে নিলাম। তাকে বললাম, তুমি তাকে খোঁজার চেষ্টা করো। দরকার হলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দাও। তার আত্মীয়-স্বজন খুঁজে বের কোরো।

(৯) ছয় সপ্তাহ পরে তিনি এলেন পরের ভিজিটে। এসে আমাকে খুঁজছেন। আমি গেলাম। বললেন, তোমার সময় হবে। কিছু নতুন খবর আছে। আমি আগ্রহী হলাম। তার সাথে বসলাম। তিনি বললেন, আমি পত্রিকায় তার শেষ নাম (ফ্যামিলি নাম) দিয়ে খুঁজেছি। তার বিয়ের সংবাদ পড়েছি খবরের কাগজে। তার নাম এখন পরিবর্তন হয়েছে বিয়ের পরে। তবে সেই পরিবর্তিত নাম দিয়ে দেখেছি সে এখন ক্যালিফোর্নিয়া থাকে। আমি সেই নাম দিয়ে তার ফোন নম্বর বের করেছি। তারপর তাকে ফোন করেছি। সে ফোন ধরেছে। আমাকে চিনতে পেরেছে। প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগের কথা, তার সব মনে আছে, ডাক্তার! সে ধারণা করেনি যে আমি এখনো বেঁচে আছি। সে লেখাপড়া করে স্কুলের শিক্ষক হয়েছিল, একজন পুলিশ কর্মকর্তার সাথে তার বিয়ে হয়েছিল, সেই পুলিশ কর্মকর্তা কর্মরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পরে সে আবার বিয়ে করে। তার দুই মেয়ে এখন, একজন বাচ্চা হবার সময় মারা গেছে। আমি তার ই-মেইল পেয়েছি। প্রতিদিন পাগলের মত ইমেল করছি গত দুই সপ্তাহ! আমি তাকে বললাম, তুমি যাও, তার সাথে যেয়ে দেখা করে আসো ক্যালিফোর্নিয়ায়। তিনি মাথা নাড়লেন। বললেন, তাকে সামনা-সামনি দেখলে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না। আমি তাকে আমার অশ্রু দেখাতে চাই না!

(১০) সবাই তাকে বিষন্নতার চিকিৎসা করতে চেয়েছে, যৌন-অক্ষমতার চিকিৎসা করতে বলেছে। কিন্তু, কেউ তার জীবনের গল্পটা শুনতে চায় নি। আমি শুনেছি। তিনি আমার রুগী-কাম বন্ধু। আমি তাকে সাপোর্ট করেছি। তিনি তার অনুভূতির মূল্য পেয়েছেন আমার কাছ থেকে, সাহস পেয়েছেন। সেখান থেকেই তিনি উদ্যোগী হয়ে ক্যামেলিয়াকে খুঁজে বের করেছেন। তিনি এখনো প্রতিদিন কাঁদেন, তবে বিষন্নতার কান্না নয়, ক্যামেলিয়াকে ফিরে পাবার কান্না।

উনার আনন্দ-অশ্রুতে ভিজে থাকে আমার অনুভূতি, আমার বেঁচে থাকা। আচ্ছা, বিরহের অশ্রু আর মিলনের অশ্রু কি এক? তাদের কেমিক্যাল কম্পোজিশন?  আপনি কি অশ্রুর রসায়ন জানেন? আপনার নিজের অশ্রুর, অথবা তার?


আরও দেখুন: