অশ্রু

ডা. হামীম ইবনে কাওছার
2021-06-13 02:33:19
অশ্রু

সাড়ে ছয় ফুট লম্বা, তিয়াত্তর বছর বয়সের এই সাদা মানুষটিকে সেনাবাহিনীর জেনারেল মনে হয়। শরীরে বয়সের ছাপ পড়ে নি একদম

(১).  আজকের রোগীর নাম আব্রাহাম কুদ্দুস। সাড়ে ছয় ফুট লম্বা, তিয়াত্তর বছর বয়সের এই সাদা মানুষটিকে সেনাবাহিনীর জেনারেল মনে হয়। শরীরে বয়সের ছাপ পড়েনি একদম। তিনি আমাদের কাছে আসেন প্রোস্টেট ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য। প্রতি ছয় সপ্তাহ পর পর আসেন। একুশ বছর আগে উনার প্রোস্টেট কেটে ফেলা হয়েছে ক্যান্সারের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য। এখন তাকে লিউপ্রোলাইড ইনজেকশন দেয়া হয় বারো সপ্তাহ পরপর। কেমিক্যাল ক্যাসট্রেশন করার জন্য, টেস্টোস্টেরোন লেভেল ১৭ (নরমাল হলো ২০০ এর উপরে), তিনি এসে ঝিম মেরে বসেন, বিধ্বস্ত এবং বিষাদগ্রস্ত মনে হয়। উনার সাথে বায়ান্ন বছর বয়সের উনার সুন্দরী স্ত্রী আসেন। তাকেও বিষন্ন মনে হয়। আগের ডাক্তাররা মনে করেছেন যে কেমিক্যাল ক্যাসট্রেশন করার জন্য এমন হয়েছে। কেউ কেউ এন্টি-ডিপ্রেশনের কথা বলেছেন, উনি রাজি হন নি। আমি বেশ কৌতূহলী হলাম উনাকে জানতে।

(২).  উনার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম। কেন আপনাদের দুজনকেই বিষাদগ্রস্থ মনে হয়? আমি কি কোনোভাবে সহযোগিতা করতে পারি কি না। দুইজনেই চুপ। কোনো কথাই বলছেন না। আমিও চুপ করে আছি। এটাকে বলে "থেরাপিউটিক সাইলেন্স" [এ বিষয় নিয়ে অন্য একদিন বলবো]....কিছুক্ষন পরে ভদ্রলোক মাথা তুলে তাকালেন, হেসে দিয়ে বললেন, আমার স্ত্রীকে এলাকার অন্য যুবকেরা সাহার্য করছে। আমি একটু বিস্মিত হলাম, মানে কি? তিনি সময় নিলেন। ধীরে ধীরে শুরু করলেন। হেসে বললেন, একুশ বছর আগে যখন আমার প্রোস্টেট ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু হয়, তখন থেকেই আমার ইরেক্টাইল ডিজফাংশন। তখন থেকে কোনোভাবেই আমি আর ‘জন’ কে দাড়া করতে পারিনি। তখন আমার স্ত্রীর বয়স ত্রিশের মত। তিনি অনেকদিন বিষয়টা সহ্য করেছেন। কিন্তু এখন আর তিনি পারছেন না, আমার বাসায় এলাকার যুবকেরা আনাগোনা করেন, আমি কিছু বলতে পারি না।

প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে আমি তো এক বিপদে পড়লাম!

(৩). স্ত্রী মুখ খুললেন। বললেন, ওই ক্যামেলিয়া কাবেরী-র কথা বলো। আমি সোজা হয়ে বসলাম। ঘটনার নাটকীয় মোড় নিচ্ছে। হটাৎ ভদ্রলোকের চোখের পানি বেয়ে পড়তে শুরু করলো। আমি তার ঘাড়ে হাত দিলাম, ‘থেরাপিউটিক টাচ’- টিস্যু এগিয়ে দিলাম। তিনি শান্ত হবার চেষ্টা করছেন। আমি ভাবলাম প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফেলি। বললাম, তুমি কি একজন সাইক্রিয়াটিস্ট দেখতে চাও। এমন করে কান্না করছো? তিনি সজোরে মাথা নাড়লেন, না-বোধক উত্তরে! সময় নিয়ে বললেন, তুমি কি আসলে জানতে চাও কি হয়েছে? আমি আসলে প্রতিদিন বাসায় বসে কাঁদি!

(৪). তিনি শান্ত হয়ে বসলেন। তার স্ত্রীর মাথা নিচু। আমার চোখে চোখ রাখছেন না। লজ্জা পাচ্ছেন। আমি যুবক খোঁজা সুন্দরীর চোখের গভীরে তাকানোর চেষ্টা করছি, সুযোগ পাচ্ছি না। আব্রাহাম কুদ্দুস শুরু করলেন। শুনো ডাক্তার। আমি কার সন্তান জানি না। আমাকে এক পরিবার এডপ্ট করেছিল। সেই পরিবারের কর্তা বদরাগী ছিলেন। আমাকে নির্যাতন করতেন। আমি ছোটবেলায় একবার প্যান্টে হাগু করে দিলে উনি আমাকে দিয়ে সেই হাগু খাইয়েছিলেন। আমার যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। সেই বাবা বাড়িতে আসতেন মাতাল অবস্থায়।  আমি ভয়ে থাকতাম। তিনি বাসায় এলে আমি খাটের নিচে লুকিয়ে থাকতাম। কখনো বাড়ির এটিকে উঠে পালিয়ে থাকতাম। স্কুল শেষ হয়ে গেলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম। নেশা করতাম সব ভুলে থাকার জন্য। আমার স্কুলে সবাই জানতো যে আমি নেশা করি। সবাই আমাকে এড়িয়ে চলতো, ঘৃণা করতো। কোনো বন্ধু ছিল না। কিন্তু, তারা জানতো না আমার জীবন কেমন!

(৫). এমন এক দিনের কথা। তখন আমি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। শীতকাল। পুরো এলাকা বরফে ঢাকা। হটাৎ আমার একটা জুতো ছিড়ে গেলো। আমি একটা জুতোর দোকানে যেয়ে দোকানির অজান্তে আমার ছেড়া জুতো পাল্টিয়ে নতুন জুতো পরে বেরিয়ে এলাম। আমার কাছে টাকা ছিল না। দোকানি টের পেয়ে গেলেন। দৌড়ে এসে আমাকে বাইরে থেকে ধরে নিয়ে গেলেন। পুলিশ ডেকে আমাকে জেলে পাঠিয়ে দিলেন। আমি কিছুটা খুশিই হলাম, কারণ আমার আর ঠান্ডায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হবে না। বাড়িতে ফিরে গেলে অত্যাচার সহ্য করতে হবে না। কিন্তু, সমস্যায় বাঁধলো অন্য জায়গায়। আমার উইথড্রয়াল হচ্ছে, নেশা করতে পারছি না। পাগলামি করছি। তারা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখে বললেন যে আমাকে ভর্তি করে ফেলতে। হাসপাতালে ভর্তি হলাম।

(৬). বেশ রাত। ষাটোর্ধ পুরুষ সাইকিয়াট্রিস্ট আমাকে দেখতে এলেন। আমি রুমে একা। আমার তখন বয়স পনের-ষোলো হবে। এই ডাক্তার ভদ্রলোক তার গোপনাঙ্গ আমার শরীরে প্রবেশ করানোর চেষ্টা করছেন। আমি উনাকে সজোরে চড় মারলে উনি ঘুরে মেঝেতে পড়ে যান। হাসপাতালে হৈ-হুস্তুল বেঁধে গেলো। তারা ভাবলেন যে আমার একিউট ম্যানিয়া হচ্ছে। আমাকে জোর করে ধরে ইলেক্ট্রো-কনভেলসিভ থেরাপি দেয়া হলো। আমার কিছুই মনে নেই। এর পর আবার জেলে পাঠিয়ে দেয়া হলো। অনেকদিন জেলে ছিলাম।  কেউ কোনোদিন দেখতে আসে নি। আমার সহপাঠী, পালক বাবা-মা, কেউ না। তিনি হু হু করে কেঁদে উঠলেন। কিছুক্ষন আগে তার স্ত্রী চোখ লুকাচ্ছিলেন যাতে আমি তাকে না দেখতে পারি। এখন, আমি চোখ লুকাচ্ছি যাতে তাদের দুজনের কেউই আমার অশ্রুসজল চোখ না দেখতে পারেন! (চলবে...)


আরও দেখুন: