বাংলাদেশে করোনার কোন টিকা বেশি উপযুক্ত?
স্টাফ সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড ইমিউনোলজিস্ট, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ, যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশে সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ভ্যাকসিন রপ্তানি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। যারা দুটি ডোজ পেলেন, তারা কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও একটি ডোজ গ্রহণকারী অথবা ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় থাকা জনগণ কিছুটা হলেও শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন। এ অবস্থায় সরকার ফাইজার, রাশিয়ার স্পুৎনিক-ভি, চীনের ক্যানসিনো বায়োটেকের করোনা ভ্যাকসিন আমদানির চেষ্টা করছে। পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভ্যারিয়েন্টের কথা মাথায় রেখে একটি কার্যকরি ভ্যাকসিন আমদানি অতি জরুরি।
বাংলাদেশে স্পুৎনিক-ভি ভ্যাকসিনটির অনুপোযোগিতা
বাংলাদেশে সাউথ আফ্রিকান করোনা ভ্যারিয়েন্টের (বি.১.৩৫১) প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের মাউন্ট সেনাই হাসপাতাল এক গবেষণায়, সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে স্পুৎনিক-ভি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখেছে। ডক্টর বেনহুর লির নেতৃত্বে একদল গবেষক স্পুৎনিক-ভি ভ্যাকসিন নেওয়া ১২ ব্যক্তির রক্তে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি সাউথ আফ্রিকান করোনা ভ্যারিয়েন্টের (বি.১.৩৫১) বিরুদ্ধে কতটা কার্যকর তা পরীক্ষা করে দেখতে পান, প্রায় ৬৭ ভাগ ব্যক্তির রক্তে উপস্থিত অ্যান্টিবডি সাউথ আফ্রিকান করোনা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকরি নয়। তবে স্পুৎনিক-ভি ভ্যাকসিনের মাধ্যমে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি ইউকে ভ্যারিয়েন্টের (বি.১.১.৭) বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ কার্যকর।
এমতাবস্থায়, রাশিয়ার তৈরি স্পুৎনিক-ভি ভ্যাকসিন আমদানি করা বাংলাদেশের জন্য কতটা ফলপ্রসূ হবে তা ভেবে দেখার প্রয়োজন।
চীনের ক্যানসিনো বায়োটেকের ভ্যাকসিন
পাকিস্তান, মেক্সিকোসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা যায় ক্যানসিনো বায়োটেকের ভ্যাকসিন প্রায় ৭০ ভাগ কার্যকরি। কিন্তু সাউথ আফ্রিকা অথবা ইন্ডিয়ান করোনা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে এ ভ্যাকসিন কতটা কার্যকরি তার যথাযথ কোনো ট্রায়াল এখনো হয়নি। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করোনা ভ্যারিয়েন্টগুলোর বিরুদ্ধে ক্যানসিনো বায়োটেকের ভ্যাকটিস কতটা কার্যকর তা না জেনে ভ্যাকসিন আমদানি যুক্তিযুক্ত নয় বলে আমি মনে করি।
একটি কার্যকরি ভ্যাকসিন নির্বাচন করার কিছু কারণ আছে। গত মে মাসের ২৫ তারিখ যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজেস কন্ট্রোল অ্যৌান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ১০ হাজার ২৬২ জন ভ্যাকসিনের সবগুলো ডোজ সম্পন্ন করেও করোনা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। তার মধ্যে শতকরা ২৭ ভাগ ব্যক্তির করোনার কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায়নি, ১০ ভাগ ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং ২ ভাগ ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেন। মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫০ মিলিয়ন মানুষ করোনার ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সাউথ আফ্রিকা, ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্টসহ সবগুলো করোনা ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ফাইজার ও মডার্নার ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা প্রমাণিত। সুতরাং, ফাইজারের ভ্যাকসিনটি আমদানি করতে পারলে বাংলাদেশ সবচেয়ে লাভবান হবে। তাই সরকারের উচিত ফাইজারের ভ্যাকসিন আমদানির প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া।
ইদানিং দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো বিজ্ঞানের খবর নিয়ে অত্যুৎসাহী হয়েছে। এটি একটি ভালো দিক। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমগুলো পাঠক আকর্ষণের জন্য বিজ্ঞান রিপোর্টগুলো এতো অতিরঞ্জিত করে, যা সত্যিই অস্বস্তিকর। খুবই সাধারণ মানের একটি জার্নাল ভ্যাকসিন এ গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাকসিনের গবেষণা প্রকাশ পাওয়ার পর পত্রিকাগুলোর রিপোর্ট দেখে বিস্মিত হতে হয়। বলা হলো, পৃথিবীর প্রথম সিঙ্গেল ডোজ এমআরএনএ (mRNA) ভ্যাকসিন হলো গ্লোবের আবিষ্কৃত করোনা ভ্যাকসিন।
এখানে বড় রকমের দুটি ভুল তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথমত, যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. মাইকেল উইকেন্সের নেতৃত্বে করা একটি গবেষণায় দেখা যায়, ফাইজারের এমআরএনএ ভ্যাকসিনের একটি ডোজ করোনা প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। এখানে উল্লেখ্য যে, এই উপসংহার টানা হয়েছে ৮ হাজার ৯০০ মানুষের ফাইজারের করোনা ভ্যাকসিনের একটি ডোজ দিয়ে তার ওপর গবেষণা করে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, একটি ডোজ দিয়েও কম বেশি করোনা প্রতিরোধ সম্ভব। দুটি ডোজ দিলে শরীরে তৈরি অ্যান্টিবডির পরিমাণ বৃদ্ধিসহ আরও অনেক কারণে শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হয়। এ কারণেই মডার্না/ফাইজার দুটি ডোজ সুপারিশ করেছে।
দ্বিতীয়ত, গ্লোব বায়োটেকের ওই প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ইঁদুরে করা সিউডো (pseudo) করোনা ভাইরাস দিয়ে করা ছোট একটি গবেষণা থেকে কোনোভাবেই এ উপসংহার টানা যায় না যে, একটি মাত্র ডোজ দিয়ে প্রকৃত ভাইরাসের বিরুদ্ধে দীর্ঘ মেয়াদী সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব। সুতরাং, বাংলাদেশের করোনা ভ্যারিয়েন্টের প্রাদুর্ভাব সার্বিক দিক বিবেচনায় ভ্যাকসিন আমদানি করলে করোনা মোকাবেলা সহজ ও ফলপ্রসূ হবে।
লেখক: মোহাম্মদ শামছুল আলম
স্টাফ সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড ইমিউনোলজিস্ট ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ, যুক্তরাষ্ট্র
এ লেখায় মতামত একান্ত লেখকের। এর সাথে ডক্টর টিভির কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।