সেলফোনের অপব্যবহারে অভিশপ্ত মানবসভ্যতা
প্রযুক্তি হলো দুদিকে ধারালো তলোয়ার, যার অপব্যবহার বিপর্যয় টেনে আনতে পারে
সাড়ে ৩শ’ বছর যাবৎ বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রযাত্রা অবিরাম গতিতে বেড়েই চলেছে। অনন্য সাধারণ আবিষ্কারে মানুষ সভ্যতাকে এক অনবদ্য রূপ দিয়েছে। প্রস্তর যুগ বা আদি যুগ থেকে আমরা আজ কোথায় এসে পৌঁছেছি, তা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি কল্পনাতীত।
আমরা যদি চিন্তা করি ট্ৰাইলোবাইটস, ডাইনোসরসহ বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তির কথা; একই সঙ্গে পৃথিবী থেকে প্রাচীন অনেক ফলদ এবং ঔষধি বৃক্ষের বিলুপ্তির কথা; তাহলে অবশ্যই আমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, মানবজাতি বা মানুষের বিলুপ্তি কি হঠাৎ করে ঘটে যাবে না?
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে পৃথিবী যেমন গতি পেয়েছে, তেমনি পরিবেশদূষণ, বিভিন্ন জীব ও উদ্ভিদের বাঁচার জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এক পর্যায়ে তারা হয়তো জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলবে। কার্ল মার্কসের সূত্রানুযায়ী উন্নতির একটা চরম ধাপ আছে, সেই শেষসীমায় পৌঁছার পর অধগতি অবশ্যম্ভাবী। এটাই হলো প্রকৃতির নিয়ম। হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রাচুর্য-দরিদ্রতা ইত্যাদি একে অন্যের সঙ্গে জড়িত।
আজকের প্রবন্ধে যে আবিষ্কার নিয়ে কথা বলতে চাই, তা হলো, যোগাযোগমাধ্যম। শুধু বৈপ্লবিক নয়, অতিবৈপ্লবিক পরিবর্তন এখানে হয়ে গেছে। যোগাযোগ বলতে বাস, ট্রাক, রেল, বিমান বা রকেটের যোগাযোগ আমি বোঝাতে চাচ্ছি না। বলতে চাইছি, টেলিযোগাযোগের কথা।
১৯৮০ সালের কথা। মস্কো অলিম্পিকের সময় বাইরের শহরগুলো থেকে বিদেশিদের মস্কো যাওয়ার ভিসা ছিল বন্ধ। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে বিদেশি ছেলেদের এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতে ভিসা বা ডিন অফিসের অনুমতি নিতে হতো। ১৯৭৯ সালের জুন মাসে বিয়ে করে, ’৮০ সালের জানুয়ারিতে অদেসা চলে আসি এমএসসি ও পিএইচডি স্কলারশিপ নিয়ে। অলিম্পিক চলাকালে যোগাযোগ অর্থাৎ টেলিযোগাযোগের অগ্রগতির সুযোগ নিয়ে চট্টগ্রামে অবস্থানরত প্রিয়তমার সঙ্গে কথা বলার জন্য এক রবিবার সকাল ৮টায় সমুদ্রবন্দর অদেসার টেলিফোনের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে একটা কল বুক করি। না খেয়ে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে যেটুকু সুযোগ পেলাম, অদেসা-মস্কো, মস্কো-লন্ডন, লন্ডন-ঢাকা সংযোগ দেওয়া সম্ভব, কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইন সংযোগ হচ্ছে না। সাংঘাতিক মন খারাপ করে হোস্টেলে চলে যাব। যখন ফিরে আসব তখন যে বয়স্ক ভদ্রমহিলা কলটা বুক করেছিলেন তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি উপদেশ দিলেন। বললেন, অলিম্পিকের পরে মস্কো টেলিফোন অফিসে গিয়ে কল বুক করলে অবশ্যই আমি কথা বলতে পারব। যথারীতি সেভাবে ডিন অফিসের অনুমতি নিয়ে ২২ ঘণ্টা ট্রেনে চড়ে মস্কো এসে সরাসরি টেলিফোন অফিসে গিয়ে কল বুক করে ৮ ঘণ্টা অপেক্ষার পর একই জবাব ঢাকা-চট্টগ্রাম সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। বিষণ্ণ মনে পুনরায় ২২ ঘণ্টা ট্রেন ভ্রমণ শেষে অদেসায়। কিন্তু বিজ্ঞানের অনবদ্য আবিষ্কারের ফলে আজ টেলিযোগাযোগ কী অসম্ভব অগ্রগতি সাধন করেছে। উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশ থেকে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে আপনি কথা বলতে পারেন। এমনকি বিনাশ্রমে প্রিয় ব্যক্তি বা সন্তানের ছবিও দেখতে পারেন।
বিজ্ঞানের অপব্যবহারে ধরুন টেলিফোনের কথা অর্থাৎ মোবাইলের কথা। ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশনের কথা। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট ৮টা ১৫ মিনিটে হিরোশিমায় যে আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটেছিল, সেখানে তাৎক্ষণিক সর্বোচ্চ কল্পনাতীত তাপমাত্রার সৃষ্টি ছাড়াও অদ্যাবধি তেজষ্ক্রিয়তার কিছু রেশ রয়ে গেছে। সেটা একবার ঘটেছিল। মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন একটা ক্রনিক পদ্ধতি, যা সবাইকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিপ্লোম্যাটিক বক্তব্য দায়িত্ব এড়ানোর শামিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্য, Serious health effects like cancer are unlikely from mobile phones and their base stations. Based upon the consensus view of medical and scientific communities. কিন্তু এ পি জে আবদুল কালামের ভাষায়, Technology is meant to simplify our lives, but excessive dependence on it has complicated our lives. অর্থাৎ প্রযুক্তির আবিষ্কার এবং ব্যবহার হওয়া উচিত ছিল আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ করার জন্য, কিন্তু প্রযুক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা আমাদের জীবনকে জটিল করে তুলেছে।
শুধু তাই নয়, আমার কাছে মনে হচ্ছে, প্রযুক্তি হলো দুদিকে ধারালো এক তলোয়ার, যার অতিমাত্রায় ব্যবহার এবং অপব্যবহার দুদিকে ধারালো অস্ত্রের মতোই বিপর্যয় টেনে আনতে পারে।
শুরুতেই ধরি রিংটোনের কথা। প্রত্যেকেই তার রুচিসম্মত অদ্ভুত রিংটোন বা গান বা আজান বা কোরআন তেলাওয়াত সংযুক্ত করেন। কেউ কেউ জাতীয় সংগীত দিতে ভুল করেন না, যেখানে জাতীয় সংগীত বাজলে সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করার উচিত। নিজের কাছে রুচিসম্মত হলেও অনেকের কাছেই তা রুচিবিবর্জিত। তা ছাড়া কোনো জরুরি সভায়, নিমন্ত্রণে, ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করার সময় সাধারণত ভদ্রতার খাতিরে হলেও Silent Mode-এ রাখা উচিত। তাও অনেকেই করেন না।
আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল ১৮৭৬ সালের ১০ মার্চ প্রথম যে টেলিফোনে তার বন্ধু থমাস ওয়াটসনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, যার বাণিজ্যিক রূপ লাভ ও অনন্য আবিষ্কার বিবেচনায় তিনি নোবেল পেয়েছিলেন। আজ যদিও তা সেকেলে, কিন্তু মূল ভিত্তি ওটাই। সত্যিকার অর্থে মোবাইল প্রথম বাজারজাত করা হয় নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে, যা যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়, যেটা সত্যিই মোবাইল (বহনযোগ্য) এবং কম দামি, প্রয়োজনীয় মাধ্যম এবং যা জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
বাংলাদেশে আনুমানিক ১২ কোটির মতো সিম বাজারজাত করা হয়েছে। যেহেতু কেউ একাধিক সিম ব্যবহার করেন, সেক্ষেত্রে ১১ কোটি লোক যদি সেলফোন ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে ১৬ বছরের নিচের শিশুরাও কমপক্ষে ২ কোটি নিয়মিত সেলফোন ব্যবহার করছে। তা ছাড়া এখন বাচ্চাদের খাওয়ানোর সময় টেলিভিশনের পরিবর্তে সেলফোনের বিভিন্ন প্রোগ্রাম দেখানো হয়।
সেক্ষেত্রে শুধু ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন নয়, এত ক্ষুদ্র পর্দায় দেখার জন্য চোখের Accommodation-এর সমস্যা হয়। সাধারণত বিজ্ঞানীদের মতে, ১৬ বছরের নিচে কারও সেলফোন ব্যবহার করা উচিত নয়।
সাধারণত একটি কল গ্রহণ করলে ২০ সেকেন্ডের বেশি কথা না বলাই শ্রেয়। যদি ৩ মিনিট কথা বলা হয়, তাহলে পরবর্তী ২০ মিনিট সেলফোন ব্যবহার না করা উচিত । মনে রাখতে হবে, ২০ মিনিটের অধিক সময় কথা বললে মস্তিষ্কের তাপমাত্রা ১০২ ডিগ্রির ওপরে উঠে যায়, যা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে কম্পনের সৃষ্টি করে।
রেডিয়েশনের ধরন সাধারণত Non lonizing এবং lionizing. lonizing radiation সাধারণত চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহৃত হয়, চিকিৎসা ও রোগ নিরূপণের জন্য। বিদ্যুত্বাহী তার, রাডার, বিদ্যুৎচালিত যোগাযোগ যানবাহন, কম্পিউটার, বেইস স্টেশন ও সেলফোনে ব্যবহৃত হয় Non lonizing radiation. মোবাইল ফোনের ভয়াবহতা হলো, বেইস স্টেশন, রিসিভার এবং মোবাইল সুইচ সেন্টার সব জায়গা থেকেই রেডিয়েশন নির্গমন হয়। সাধারণত মোবাইল ফোন ব্যবহারে ক্লান্তি বা অবসাদ, মাথাব্যথা, নিদ্রাহীনতা, স্মরণশক্তি হ্রাস, কানে শো শো বা ভো ভো করা, জয়েন্ট ব্যথা অর্থাৎ কব্জি, কাঁধ, কনুই, সর্বোপরি কানে শোনারও যথেষ্ট ক্ষতি করে। মোবাইল ফোন বিমানে নিষিদ্ধ, হাসপাতালের যেসব জায়গায় ইলেকট্রো মেডিকেল যন্ত্র ব্যবহৃত হয়, সেসব জায়গায় অর্থাৎ অপারেশন থিয়েটার, আইসিইউ, সিসিইউ, এমনকি যে রোগীর শরীরে পেসমেকারের মতো ডিভাইস বসানো আছে, সেখানেও নিষিদ্ধ। যানবাহন চলমান অবস্থায়, চালকের জন্য মোবাইল ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। আন্তর্জাতিক গবেষণার ফল, গাড়ির দুর্ঘটনা বর্তমানে চারগুণ বেশি হয়েছে শুধু চালকের চলমান অবস্থায় মোবাইল ব্যবহারের কারণে। সর্বোপরি মস্তিষ্কে কোকেনের মতোই আসক্তি সৃষ্টি করে ফেইসবুক।
সর্বশেষ জেনে রাখা ভালো—
১, ফোনে কথা বলার সময় একাধারে ৩ মিনিটের বেশি কথা না বলে অন্তত ১৫ মিনিট বিরতি দিয়ে কথা বলা
২. রেডিয়েশন কমাতে সরাসরি হ্যান্ডসেটের পরিবর্তে হেডফোন বা হেডসেট ব্যবহার করা
৩. মোবাইল ফোনে চার্জ কম থাকা এবং চার্জে লাগানো অবস্থায় কথা না বলা
৪. শিশুদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন দূরে রাখুন
৫. রাস্তা পারাপারের সময় মোবাইল ফোনে কথা না বলা
৬. হাতের কাছে ল্যান্ডফোন থাকলে মোবাইল ফোন ব্যবহার না করা
৭. আইসিইউ এবং ওটিতে মোবাইল ফোন ব্যবহার না করা
৮. যত্রতত্র অ্যান্টেনা ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা
৯. মোবাইল ফোনসেটের উৎপাদনকারী কর্তৃপক্ষের উচিত Specific Absorption Rate (SAR) উল্লেখ করা, যাতে গ্রাহকরা তা দেখে রেডিয়েশনের মাত্রা সম্পর্কে জানতে পারেন।
এর বাইরে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের কিছু ব্যাপার বিজ্ঞানের অধগতির কারণ হিসেবে দাঁড়াতে পারে। এটা ধরে নেওয়া যায়, বিজ্ঞান যদি এক্সপ্লোসিভ বা বিস্ফোরক শক্তি উৎপাদন করতেই থাকে তবে আজ হোক কাল হোক বিজ্ঞান বিকশিত হতে পারে এমন সমাজ টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ বিষয়টি বড় আকারের এবং ভিন্ন আঙ্গিকের, ফলে এর সুদৃঢ় উত্তর দেওয়া অত্যন্ত কঠিন। তবে প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ বলে এর জবাব খোঁজা প্রয়োজন।
এ বিপদ অনেক দূরবর্তী কিছু নয়; কয়েক বছরের মধ্যেই তা হুমকি হয়ে দেখা দেবে। কিন্তু সেসব কিছু নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত নই। আমি আরও বড় ব্যাপার নিয়ে ভাবছি। এমন কি কোনো সমাজ হতে পারে, যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও সে স্থিরতা পাবে যা অতীতে অনেক সমাজে বিদ্যমান ছিল? নাকি আত্মঘাতী বিস্ফোরক তৈরি করাই এদের অমোঘ নিয়তি? এ প্রশ্নগুলো আমাদের বিজ্ঞানের জগতের বাইরে নিয়ে আসে ন্যায়, আদর্শ, নৈতিকতা ও বৃহত্তর জনমানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তখন জরুরি হয়ে পড়ে। (সূত্র: বিজ্ঞানই অপবিজ্ঞানের প্রতিষেধক, বার্ট্রান্ড রাসেল, রতন তনু ঘোষ সম্পাদিত)।
মহাত্মা গান্ধীর ভাষায় সাতটি মৃত্যুসম পাপের একটি হলো Science without humanity. যোগাযোগ-বিপ্লবে মোবাইল ফোনের আবিষ্কার মানবিকতাবিবর্জিত নয়। কিন্তু মোবাইলের অপব্যবহার এত বেড়ে গেলে, যেমন ট্র্যাপ করা, মিথ্যা ফেসবুক আইডি খোলা, প্রতারণা করা, হুমকি-ধমকি দেওয়া এসবই মানবসভ্যতাকে যেমন অভিশপ্ত করেছে, মোবাইলকেও অভিশপ্ত করেছে।
আলফ্রেড নোবেল ডিনামাইট আবিষ্কার করেছিলেন মাটির নিচে সম্পদ অনুসন্ধান করার জন্য, নিমিষের মধ্যে পুরনো দালান বা ব্রিজ ধ্বংস করার জন্য। উনি যখন দেখলেন ডিনামাইট দিয়ে মানবসভ্যতা ও মানবতা ধ্বংস হচ্ছে, তাই তার উইল অনুযায়ী নোবেল পুরস্কারের সূচনা হলো। ফ্রেডরিক নোবেল একজন প্রকৌশলী, রসায়নবিদ, এমনকি ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ইমানুয়েল নোবেলের ছেলে হয়ে, মানবতার জন্য বিজ্ঞান, সমাজের জন্য অর্থনীতি, মানুষের জন্য সাহিত্য এবং শান্তির জন্যই বিশ্ব বিবেচনায় এনে সব সম্পদের বিনিময়ে নোবেল প্রাইজ দিয়ে গেলেন। তার স্বপ্ন কি বাস্তবায়ন হবে?