ফেরোমোন: যৌনতার ঘ্রাণ

অনলাইন ডেস্ক
2021-05-22 07:38:03
ফেরোমোন: যৌনতার ঘ্রাণ

পুরুষের শরীর থেকে নিঃসৃত ফেরোমোন নিয়ে মেয়েদের উপর অনেক ধরণের গবেষনা হয়েছে।

(১)

ফেরোমোন হলো একটি রাসায়নিক বস্তু যা এক প্রাণীর শরীর থেকে নিঃসৃত হয় এবং এর ঘ্রান শুধুমাত্র সেই একই প্রজাতির প্রাণী অনুভব করতে পারে। এটি মূলত একটি হরমোনের মত কিন্তু এটি শরীরের ভিতরে নিঃসৃত না হয়ে বাইরে নিঃসৃত হয়। যেহেতু এটি শরীরের বাইরে নিঃসৃত হয়, এটিকে একটো-হরমোন ও বলে। এক প্রাণীর শরীর থেকে নিঃসৃত হয়ে এই রাসায়নিক বস্তু শুধুমাত্র সেই একই প্রজাতির অন্য প্রাণীর শরীরে উত্তেজনা তৈরী করতে পারে বা তার ব্যবহারে পরিবর্তন আনতে পারে।

এই বস্তু ঘাম, নিশ্বাস, প্রস্রাব, বা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে নির্গত হতে পারে। একই প্রজাতির অন্য প্রাণী ভোমেরো-ন্যাজাল অঙ্গ দিয়ে এই ঘ্রান শুকতে পারে। কাজের ধরণের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন রকম ফেরোমনে আছে, যেমন: সেক্স ফেরোমোন, এলার্ম ফেরোমোন, সিগন্যাল ফেরোমোন, ট্রেইল ফেরোমোন ইত্যাদি। আজকে মূলত সেক্স ফেরোমোন সম্পর্কে লিখবো।

(২)

সেক্স ফেরোমোন প্রায় সব প্রাণীই নিঃসরণ করে। সাধারণত স্ত্রী-প্রাণী এটি নিঃসরণ করে। এর মাধ্যমে সে পুরুষ-প্রাণী কে তার উর্বরতার তথ্য পৌঁছে দেয়। সাধারণত স্ত্রী-প্রাণীর যে সময় ওভুলেশন বা ডিম্বস্ফুটন হয়, তখন সে এই ফেরোমোন নিঃসরণ করে পুরুষ প্রাণীকে প্রজননের আহবান জানায়। প্রাণী জগতে পুরুষ যে কোনো স্ত্রীর সাথে প্রজননে আগ্রহী হলেও সকল স্ত্রী-প্রাণী সকল পুরুষ-প্রাণীর সাথে প্রজননে আগ্রহী হয় না। এই প্রজননের সঙ্গী মূলত স্ত্রী-প্রাণীই নির্ধারণ করে।

স্ত্রী-কুকুর তার যোনিপথে মিথাইল হাইড্রোক্সি-বেনজয়েট নিঃসরণ করে পুরুষ কুকুরকে ডিম্বস্ফুটনের তথ্য প্রদান করে এবং প্রজননে আগ্রহ প্রকাশ করে। এই ঘ্রান শুধু পুরুষ কুকুর-ই শুঁকতে পারে, অন্য প্রাণী পারে না। অনেক পোকা-মাকড়, এবং এককোষী প্রাণী, যেমন ব্যাকটেরিয়াও ফেরোমোন নিঃসরণ করে। বংশ বিস্তার ছাড়াও কোষ-কোষ সংযোগ (সেল-সেল কমিউনিকেশন)-এ এরা ফেরোমোন ব্যবহার করে। এক ব্যাকটেরিয়া আরেক ব্যাকটেরিয়ার কাছে বিভিন্ন রকম তথ্য প্রদানের জন্য ফেরোমোন ব্যবহার করে।

(৩)

সেক্স ফেরোমোন-এর ব্যবহার মূলত প্রাণিকূলে বেশি। মজার ব্যাপার হলো ইঁদুর এই ফেরোমোন নিঃসরণের মাধ্যমে তার নিকটাত্মীয়কে তার সাথে প্রজননে নিরুৎসাহিত করে। আত্মীয়তার ভিত্তিতে স্ত্রী-ইঁদুর এমন ফেরোমোন নিঃসরণ করে যা তার নিকটাত্মীয়কে তার সাথে প্রজননে নিরুৎসাহিত করে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই এমন ইঁদুর কে প্রজননে উত্তেজিত করে। এর মাধ্যমে এরা অনেক বংশানুক্রমিক অসুখ-বিসুখ এড়াতে পারে। এই সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করে অনেক সময় মানুষ ফাঁদ তৈরী করে।

এই ফেরোমোনের ঘ্রান শুকে অনেক প্রাণী ঘ্রানস্থলে এলে তাদেরকে ফাঁদে ফেলে আটক করেন বিজ্ঞানীরা বা শিকারিরা। অনেক সময় পুরুষ প্রাণীও ফেরোমোন নিঃসরণ করে। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার এবং তার আধিপত্যের সীমানা নির্ধারণ করে দেয় যাতে সেই সীমানার মধ্যে অন্যপুরুষ প্রাণী প্রবেশ না করে।

(৪)

মানুষের সেক্স ফেরোমোন নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, কিন্তু এখনো এর ভূমিকা সম্পর্কে পুরো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় নি। ধারণা করা হয় যে মানুষের ভোমেরো-ন্যাজাল অর্গান পুরোপুরি বিকশিত হয় না, এ কারণে ফেরোমোনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। ধারণা করা হয় মানুষের শরীরের ফেরোমোন নিঃসৃত হয় লালা, ঘাম, প্রস্রাব, দুধ, এবং ভ্যাজাইনাল নিঃসরণে। কিন্তু, গবেষনা সবচেয়ে বেশি হয়েছে বগলের ঘামের ফেরোমোন নিয়ে।

বগলের ঘামে যে ফেরোমোন থাকে তা মূলত রাসায়নিক গঠনে স্টেরয়েড-এর মত। মূলতঃ এনড্রোস্টেডিয়ানন, এনড্রোস্টেনোন, এবং এনড্রোস্টেনল ফেরোমোন হিসেবে কাজ করে। একইভাবে, মেয়েদের শরীর থেকেও ফেরোমোন নিঃসৃত হয়, বিশেষ করে ইস্ট্রাটেট্রাইনল। পুরুষের শরীর থেকে নিঃসৃত ফেরোমোন নিয়ে মেয়েদের উপর অনেক ধরণের গবেষনা হয়েছে। এই গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে পুরুষের শরীর থেকে (বগলের ঘামে) নিঃসৃত ফেরোমোন মেয়েদের শরীরে যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, খোশমেজাজ এবং ফুরফুরে ভাব সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য পুরুষের জন্য প্রস্তুত অনেক পারফিউমে কৃত্রিম ফেরোমন ব্যবহার করা যাতে মেয়েরা সেই ঘ্রানে মানসিক এবং শারীরিকভাবে আকৃষ্ট হয়।

(৫)

মানুষের শরীর থেকে নিঃসৃত ফেরোমোন-এর ঘ্রান ব্যক্তিনির্ভর। এটি নির্ভর করে তার শরীরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, তার খাদ্যাভ্যাস, ত্বকে ব্যাকটেরিয়ার ধরণ এবং পরিমানের উপর। এজন্য মানুষের বগলের ঘ্রান কে বলা হয় তার শরীরের "কেমিক্যাল সিগনেচার"- অর্থাৎ এটি তার নিজস্ব যা অন্যের সাথে মিলবে না। এই গন্ধে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়ে অপরিষ্কার এবং অতিরিক্ত ব্যাকটেরিয়ার প্রাদুর্ভাবে।

গবেষণায় দেখা গেছে ১০০ ব্যবহৃত গেঞ্জির গন্ধ শুকে একজন মানুষ কোনটি তার গেঞ্জি এটি বের করতে পারেন। এমন কি তার স্ত্রী, সন্তানেরাও সেটি পারেন। একই ভাবে মেয়েদের অন্তর্বাসেও থাকে তাদের নিজস্ব কেমিক্যাল সিগনেচার। দুগ্ধপায়িত বাচ্চাও তার মা-কে চিনে নিতে পারে শুধু ফেরোমনের ঘ্রানে। যৌনসঙ্গী নির্ধারণে এই ফেরোমোন ভূমিকা রাখে।

সাধারণত মানুষ এমন ফেরোমনে আকৃষ্ট হয় যা তার নিজস্ব মেজর হিস্টো-কম্প্যাটিবিলিটি কমপ্লেক্স এর থেকে ভিন্ন। এর মাধ্যমে সে তার থেকে জেনেটিক্যালি ভিন্ন ধরণের সঙ্গীর সাথে প্রজননে আকৃষ্ট হয়। এতে বংশানুক্রমিক বৈচিত্র সৃষ্টি হয়, এবং অনেক বংশানুক্রমিক রোগ প্রতিরোধ হয়।

(৬)

মানুষের শরীরে তাহলে সেক্স ফেরোমোনের ভূমিকা কি? তবে কি মানুষ তার সঙ্গী নির্বাচনে চেহারার চেয়েও নিজের অজান্তে ফেরোমোন-এর দ্বারা প্রভাবিত হয়? এ জন্যই কি সবাই সবাইকে পছন্দ করে না, এক জন আরেক জন নিদৃস্ট মানুষকে তার সঙ্গী হিসেবে পছন্দ করে? এই পছন্দের পিছনে কি ন্যাচারাল সিলেকশন এর এলগোরিদম ঢুকিয়ে দিয়েছেন স্রষ্টা? এই ফেরোমোনের গন্ধেই কি আছে আমাদের জেনেটিক ইনফরমেশন এর রাসায়নিক বার্তা?

এর মাধ্যমেই কি আমরা প্রজনেনের জন্য বেছে নেই যে আমাদের নিজেদের চেয়ে ভিন্ন, যাতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বৈচিত্রময় হয়? অনেক রোগ-বালাই থেকে মুক্ত থাকে? অনেক সুন্দরী মেয়ের প্রতি অনেক পুরুষ আকৃষ্ট হয় না কি ফেরোমোনের তফাতের জন্য? আমাদের কি নিদ্রিষ্ট কারো শরীরের ঘ্রান ভালো লাগে, অন্যের ঘ্রান দুর্গন্ধযুক্ত মনে হয়? এই ঘ্রান, এই দুর্গন্ধ, এই ফেরোমোন কি আমাদের সঙ্গী নির্বাচনে অবচেতন মনে কাজ করে? স্রষ্টা কি তাহলে আমাদের সৌন্দর্যের চেয়েও ঘ্রাণে আকর্ষণ বেশি দিযেছেন? যৌনতার ঘ্রান? সেক্স ফেরোমোন?

**

وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

অর্থ: আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। [সূরা রুম: ৩০: ২১]


আরও দেখুন: