যত দোষ, গ্যাস্ট্রিক ঘোষ: বাড়ছে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি

ডা. ইকবাল মাহমুদ
2021-05-20 09:23:02
যত দোষ, গ্যাস্ট্রিক ঘোষ: বাড়ছে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ইকবাল মাহমুদ, এমডি (কার্ডিওলজি)

একদিন আমার মেন্টর শ্রদ্ধেয়  (Ibrahim  Chowdhury) ইব্রাহিম স্যারকে বললাম, স্যার, আমরা তো ইমার্জেন্সি রোগী বেশি দেখি। কিছু আউটডোর ইসিজি দেখতে পারলে ভালো হতো। স্যার বললেন, আমি তো ইসিজি রিপোর্ট করি না। আমি বললাম- স্যার, তাহলে কী করা যায়?

স্যার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, শনিবার কি ফ্রি থাকেন? (স্যার ছোট-বড় সবাইকে আপনি করে বলেন)। তাহলে আমি শনিবারে কিছু ইসিজি রাখবো; আপনি বিকালে এসে রিপোর্ট করবেন। যেগুলো কনফিউশান লাগে রেখে দিবেন। পরে আমি দেখে দেব। আমার জন্য এরচেয়ে ভালো সুযোগ আর কি হতে পারে?

আমি শনিবার স্যারের ইসিজিগুলো দেখা শুরু করলাম। প্রতি শনিবারে কমপক্ষে ৫০টি ইসিজি থাকে, কখনো আরো বেশি থাকে। স্যারের সব কিছু খুব সিস্টেমেটিক, গোছানো থাকে। যদিও রোগীগুলো আউটডোর, মানে ভর্তি রোগী না। তাও আমরা কোনো ইমার্জেন্সি রোগী পেলে হাসপাতাল এন্ট্রি থেকে রোগীর ফোন নাম্বার নিয়ে ফোন করতাম। এটা স্যারের প্রটোকল।

একদিন একটা ইসিজি পেলাম, যেটা দেখে মনে হয়েছে রোগীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে আমি ল্যাব এন্ট্রি থেকে নম্বর নিয়ে রোগীকে ফোন দিলাম। ফোন রিসিভ করলেন রোগীর ভাই।

আমি উনাকে বললাম, আপনার ভাই কোথায়? উনার কি বুকে ব্যথা আছে? উনি বললেন ব্যথা অল্প, তবে বুকে খুব জ্বালাপোড়া। আমি বললাম, উনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। আপনি উনাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ভর্তি করান। উনি ওই পাশ থেকে যা বললেন, তা শুনে আমার নিজেরই হার্ট অ্যাটক হওয়ার জোগাড়।

উনি চট্টগ্রামের লোকাল ভাষায় অনেকটা এভাবে বললেন, ‘কিয়ের হার্ট অ্যাটাক? ইতে দুইজ্যা ফুয়ানা মরিচ দি ভাত হাইয়্যেতো, হিতারলাই বুক জ্বলের (মানে রোগী দুপুরে শুকনা মরিচ দিয়ে ভাত খাইছে, তাই বুক জ্বলতেছে)’।

আসলে, বুকে ব্যথা হলেই সব ব্যথা হার্ট অ্যাটাকের ব্যথা না। আবার সব পেট ব্যথা বা জ্বলা গ্যাস্ট্রিকেরও না। কিন্তু আমাদের প্রচলিত ধারণা, যত দোষ, গ্যাস্ট্রিক ঘোষ।

পেটে ব্যথা গ্যাস্ট্রিক, বুকে ব্যথা গ্যাস্ট্রিক, মাথায় ব্যথা গ্যাস্ট্রিক, পায়ে ব্যথা তাও গ্যাস্ট্রিক। রাতে ঘুম হয় না গ্যাস্ট্রিক, পাতলা পায়খানা গ্যাস্ট্রিক, পায়খানা কষা গ্যাস্ট্রিক। আমরা সব কিছুকেই গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা মনে করি।

এমনকি হার্ট অ্যাটাকের রোগীরা গ্যাস্ট্রিক মনে করে হাসপাতালে আসতে দেরি করে। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়, অনেক রোগী মারা যায়। অনেকের ব্লক খোলার ওষুধ দেওয়ার সময় চলে যায় (এই ওষুধগুলো ব্যথা উঠার ১২ ঘণ্টার মধ্যে দিতে হয়)।

কীভাবে বুঝবো কোনটা হার্ট অ্যাটাকের ব্যথা

১. হার্ট অ্যাটাকের ব্যথা সাধারণত হঠাৎ করে শুরু হওয়া তীব্র ব্যথা।

২. যেটা পুরো বুকজুড়ে হয়।

৩. বুকে চাপ বা বুক ভারী লাগে।

৪. ব্যথা গলা, নিচের থুতনী, বাম বা ডান হাতের বাহুর দিকে যেতে পারে।

৫. ব্যথার সঙ্গে শরীরে ঘাম দেওয়া, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, এসব থাকতে পারে।

৬. এই ব্যথাটা পরিশ্রম বা ইমোশনের সঙ্গে বাড়ে।

৭. বিশ্রাম বা জিহ্বার নীচে স্প্রে নিলে কমে।

৮. সাধারণত ২০ মিনিটের বেশি সময় ধরে থাকে।

মোটামুটি এরকম ব্যথা হলে আমরা এটাকে হার্ট অ্যাটাকের ব্যথা বলে মনে করি। তবে ডায়াবেটিক, বয়স্ক রোগী ও মহিলাদের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের ব্যথা সবসময় এমন নাও হতে পারে।

তবে কী করবেন

১. এই ব্যথার সঙ্গে খাবার বা খালি পেটের সম্পর্ক নাই।

২. শ্বাস বড় নিলে বা এপাশ-ওপাশ করলেও হার্টের ব্যথা বাড়ে বা কমে না।

৩. অনেকের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের বিভিন্ন জটিলতার জন্য খুব শ্বাসকষ্ট, শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া এসব থাকে।

৪. এরকম ব্যথা হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসক বা নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে।

কাদের হার্টের রক্তনালী ব্লকের সম্ভাবনা বেশি

হার্টের রক্তনালী ব্লক হওয়া একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এখানে বংশগত, জীবনযাপনের পদ্ধতিসহ বিভিন্ন ফ্যাক্টর জড়িত। হার্টের রক্তনালী ব্লক যে কারো হতে পারে, তবে কিছু কিছু ফ্যাক্টর এই সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়। যেমন-

১. ধূমপায়ী।

২. ডায়াবেটিসের রোগী।

৩. হাইপ্রেশারের রোগী।

৪. স্থুলতা বা যাদের রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি।

৫. যাদের ফ্যামিলিতে হার্টের অসুখের ইতিহাস আছে।

৬. এছাড়া একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সমবয়সী পুরুষের হার্ট এটাকের সম্ভাবনা মহিলাদের চেয়ে বেশি।

যদি ওপরে বর্ণিত ব্যথার সঙ্গে রোগীর এসব ফ্যাক্টরের এক বা একাধিক থাকে, তাহলে এটা হার্টের ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ফ্যাক্টরের সংখ্যা যত বেশি, হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনাও তত বেশি।

পৃথিবীতে যেসব দেশে হার্ট অ্যাটাকের হার বেশি বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। কম বয়সী মানুষের হার্ট অ্যাটাকের হিসেবে বাংলাদেশ একেবারে প্রথম দিকে। তাই গ্যাস্ট্রিক আর ‘ফুয়ানা মরিচ’ বলে হার্ট অ্যাটাকের ব্যথাকে উড়িয়ে দিতে গেলেই বিপদ। আসুন সবাই সচেতন হই।

লেখক: ডা. ইকবাল মাহমুদ, এমডি (কার্ডিওলজি),

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসাপাতাল।


আরও দেখুন: