চিকিৎসা-ডাক্তার বনাম রোগীর স্বজন

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত
2021-05-19 10:14:55
চিকিৎসা-ডাক্তার বনাম রোগীর স্বজন

চিকিৎসকদের শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে দিতে হবে

রোগী শোনে না ডাক্তারের কথা, সস্তান শোনে না পিতামাতার কথা, কর্মী শোনে না রাজনৈতিক নেতার কথা, ছাত্র শোনে না শিক্ষকের কথা, কর্মচারী শোনে না কর্মকর্তার কথা, ঠিকাদার শোনে না ইঞ্জিনিয়ারের কথা। এই যে স্বেচ্ছাচারিতা এটা মনে হয় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান। একজন চিকিৎসক হিসাবে এটা কিন্তু বহুদিন ধরে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

চিকিৎসক সম্বন্ধে ফরাসি লেখক এবং ইতিহাসবিদ এবং দার্শনিক ভলতেয়ারের একটা উক্তি আছে। উক্তিটি হলো—‘Men who are occupied in the restoration of health to other men, by the joint exertion of skill and humanity, are above all the great of the earth. They even partake of divinity, since to preserve and renew is almost as noble as to create.’ তা ছাড়াও পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ডাক্তারদেরকে সম্মানের চোখে দেখা হয় না। যদিও এর মধ্যে ডাক্তারদের সম্মান আমার চোখে সবচেয়ে বেশি ছিল তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে, পশ্চিম জার্মানিতে যা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে ডাক্তারদের অবস্থান ছিল ঈশ্বরের নিচে, যিশুর উপরে। কোনো রোগী হাসপাতাল থেকে ভালো হয়ে যাবার পথে চিকিৎসক বা টিমকেই শুধু ধন্যবাদ দিতেন না, যাবার সময় ঐ সমাজের রীতি অনুযায়ী তিনটা ফুল এবং আনুষঙ্গিক কিছু উপহার অবশ্যই দিয়ে বিদায় নিতেন। একজন বিদেশি হিসাবে একজন সহকারী চিকিৎসক হিসাবে আমিও কিছু পেতাম। যদি কোনো রোগী মারা যেতেন, তাহলে রোগীর আত্মীয়স্বজন শুধু চিকিৎসার জন্য কতবার যে এসে চিকিৎসকদের ধন্যবাদ দিতেন তা ভাষায় বলার নয়।  তবে বাংলাদেশের ডাক্তারদের ভিতর রাজনীতি ডাক্তার সমাজের মেরুদণ্ডকে ভেঙে দিয়েছে। অধ্যাপক এমএ স্যারের বিএমএ এবং অধ্যাপিকা ফিরোজা বেগম-এর বিএমএ আর এখন নেই। এখন আছে দলীয় বিএমএ । এজন্য ডাক্তারদের প্রথম বিভাজন DAB গঠন করে, তাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্ষমা করবে কিনা জানি না।

১৯৭০ সালের পরে চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্র হিসাবে আমি যা দেখেছি য ডাক্তাররা পেশাজীবী ছিলেন, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিতে আলে তাদের ন্যায্য দাবির কাছে সরকারই মাথা নত করতে বাধ্য হত। এই কিছু আগে ভারতের কয়েকটি রাজ্যে ডাক্তারদের ধর্মঘটের কাছে সরকার এবং জনগ পরাজয় মেনে নিয়েছে। তাই বলে কথায় কথায় ডাক্তাররা ধর্মঘট করবেন সেবা আমি বলছি না। তবে এই মুহূর্তে গ্রামে-গঞ্জে শহরে-উপশহরে যেভাবে ডাক্তারদের লাঞ্ছনা দেওয়া হচ্ছে, সেটা কিন্তু কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। ডাক্তারদের পিঠ এখন দেওয়ালে ঠেকে গেছে। এখন অবশ্যই ডাক্তারদের পেশার প্রতি সম্মান দেখিয়ে হলেও রোগীর আত্মীয়স্বজন, বন্ধু লেবাসধারী অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

ডাক্তাররা যদি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত সব রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে ভালো করতে পারতেন তাহলে হয়তো মানুষ চিকিৎসকদের ফেরেশতা বা দেবতাদের উপরে এবং স্রষ্টার নিচেই স্থান দিতেন। কিন্তু সেটা সম্ভব না।

সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো সম্মান আমরা আশা করি না। কারণ মৌলিক অধিকার হিসাবে অন্য চারটির মতো চিকিৎসা ছিল সরকারের দায়িত্ব এবং চিকিৎসকরা ছিলেন নন-প্র্যাকটিসিং। বাংলাদেশের প্রেক্ষপটে আমরা যেটুকু চাই সেটা হল আমাদেরকে একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে দিতে হবে।

আমাদের সবার মনে রাখতে হবে বর্তমান নবীন চিকিৎসকরা কিন্তু আমাদের মতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায়নি। আমরা যেরকম ডাক্তারি পাস করার পরেই In service Trainee নামে একটি সরকারি চাকুরিতে যোগদান করি, পঞ্চম গ্রেডের বেতনে। অতঃপর ইন্টার্নশিপ শেষ হওয়ার পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চাকুরি পেয়ে যাই। তার পরে নিজেরা নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ি । আমরা কখনো বেকার ছিলাম না।

জনগণ এবং সরকারের ভেবে দেখা উচিত এই মুহূর্তে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৮ থেকে ১০ হাজার করে ডাক্তার তৈরি হচ্ছে। সরকার কোনো অবস্থাতেই এত ডাক্তারের চাকরি দিতে পারেন না, দেওয়া সম্ভবও নয় এবং দেওয়ার কোনো সুযোগও নেই। আমাদেরকে পরিকল্পিত অর্থনীতির মতো বাংলাদেশের চাহিদার তুলনায় কী পরিমাণ ডাক্তার দরকার নির্ণয় করতে হবে।

প্রতি বছর কতজন অবসরে যাবে। কতজনকে নতুন করে চাকরি দেওয়া যাবে, সেই পরিমাণ ডাক্তারই তৈরি করা উচিত। পক্ষান্তরে আমরা যা করছি সেটা হল প্রয়োজনের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।

বাংলাদেশী ডাক্তারদের বাজার কিন্তু বহির্বিশ্বের কোথাও নেই। তা ছাড়াও আমাদের এই ডাক্তাররা যে দেশে বসে ইউএসএ কোয়ালিফাইং টেস্ট, অস্ট্রেলিয়ান কোয়ালিফাইং টেস্ট অথবা বিট্রিশ কোয়ালিফাইং টেস্ট দিয়ে দেশের বাইরে যাবেন সে সুযোগও কিন্তু বিদ্যমান নেই। উপরক্ত সদাশয় সরকারের উচিত সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া। এই নতুন পাম করা ডাক্তাররা পেটের দায়ে মা-বাবার কাছ থেকে টাকা এনে চলতে পারবেন না বলেই দু-তিনটা ক্লিনিকে চাকুরি করে মানবেতর জীবনযাপন করেন। তাদের কারো বেতনই সরকারি ডাক্তারদের প্রাপ্ত বেতনের অর্ধেকের সমান নয়। সেই ডাক্তারদের আবার বিসিএস দেওয়ার চিন্তা থাকে, পোস্ট গ্রাজুয়েট পরীক্ষা দেওয়ার চিন্তা থাকে, সব মিলিয়ে এমন একটি পরিস্থিতিতে তারা জনগণের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন সেটা পৃথিবীর কোনো দেশে কল্পনা করা যায় না।

বই: একান্ত ভাবনা, (পৃষ্ঠা ৬৫-৬৭)


আরও দেখুন: