মানব শরীরের বিস্ময়কর বন্ধু কিডনি
ছবি : সংগৃহীত
মাতৃগর্ভে মানবশিশু মায়ের কিডনি ও প্লাসেন্টারের সাহায্যে এবং শরীরের জলীয় অংশ ও ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য রক্ষা করে। তবে জন্মের পরপরই নবজাতকের কিডনি তার কাজ করার সক্ষমতা অর্জন করে।
মানবদেহে সাধারণত এক জোড়া কিডনি থাকে। বড় কলাই আকৃতির কিডনি দুটি দৈর্ঘ্যে ৯-১২ সেন্টিমিটার; প্রস্থে ৫-৬ সেন্টিমিটার ও ৩-৪ সেন্টিমিটার মোটা হয়। মেরুদণ্ডের দুই পাশে কোমরের একটু উপরে এদের অবস্থান।
প্রতিটি কিডনিতে প্রায় ১ মিলিয়ন ছাঁকনি থাকে, যার মধ্য দিয়ে প্রতি মিনিটে প্রায় ১ হাজার ৩০০ মিলিমিটার রক্ত পরিশোধিত হয়। অর্থাৎ কিডনি প্রতিদিন প্রায় ১৭০-১৮০ লিটার পানি ও রক্তের অন্যান্য উপাদান ফিল্টার করে। এর মধ্য থেকে প্রচুর পরিমাণ পানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান কিডনি আবার শুষে নেয়। ফলে একজন সুস্থ মানুষ দৈনিক ১-২ লিটার প্রস্রাব করে থাকেন।
প্রস্রাব (মূত্র) দিয়ে যায় চেনা
স্বাভাবিক প্রস্রাব স্বচ্ছ হয়। তবে ঘোলা হলে তা সংক্রমণজনিত কারণে। আবার প্রস্রাব ক্ষার (Alkaline) হলেও ঘোলা হতে পারে। ফাইলেরিয়া রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রস্রাব দুধের মতো ঘোলা হতে পারে। জন্ডিসে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রস্রাব গাঢ় বা হলুদ বর্ণের হয়। প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বা হিমোগ্লোবিন গেলে, তার রং গাঢ় লাল বা কালো হতে পারে। এর বাইরে কিছু কিছু ওষুধ সেবন বা খাবার গ্রহণেও গাঢ় বা রক্ত বর্ণের প্রস্রাব হতে পারে।
কিডনির কাজ কী
১. শরীর থেকে অপদ্রব্য ও অতিরিক্ত পানি মূত্র তৈরির মাধ্যমে অপসারণ করে। কিডনি শরীরে জলীয় অংশের ভারসাম্য বজায় রাখে। যেমন, খুব গরমের দিনে কিডনি রক্তের লবণ ও জলীয় অংশ শুষে নেয়। ফলে অতিরিক্ত ঘামের কারণে শরীরে পানিশূন্যতা ও লবণের ঘাটতি হয় না। আবার কোনো অনুষ্ঠানে কেউ অতিরিক্ত পানি পান কিংবা বেশি খাবার খেয়ে ফেললে, কিডনি বাড়তি লবণ ও পানি প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়।
২. শরীরে রাসায়নিক দ্রব্যের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে।
৩. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
৪. হাড়ের সুস্থতা নিশ্চিত করে।
৫. কিডনি ইরাইথ্রোপয়েটিন নামক এক ধরনের হরমোন তৈরি করে যা শরীরে রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে।
৬. ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে ইনসুলিন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম ওষুধ শরীর থেকে বের হতে সাহায্য করে। ফলে ওই ওষুধ রক্তে অতিমাত্রায় জমতে পারে না এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে মানুষ রক্ষা পায়।
কিডনির অবস্থান ও সংখ্যা
সাধারণভাবে মানুষের দুটি কর্মক্ষম কিডনি থাকে, যা মেরুদণ্ডের দুই পাশে পাজরের ভেতর ভাগে, ফুসফুসের নিচে অবস্থান করে। কখনো একজন মানুষ একটি মাত্র সুস্থ কিডনি নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে। আবার কখনো একটি সুস্থ স্বাভাবিক কিডনির সাথে আরেকটি ছোট ও অকেজো কিউনি নিয়েও কেউ জন্মগ্রহণ করতে পারে। আবার কারও কারও দুটি কিডনি নিম্নভাগে লেগে থেকে একটি বড় কিডনি আকারে দেখা দিতে পারে (Horshoe Kidney)। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত কোনো উপসর্গ হয় না। পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাফি বা সিটিস্ক্যান করলে ধরা পড়ে।
গ্লোমেরুলাস বা ছাঁকনি
দুই কিডনিতে প্রায় ২ মিলিয়ন ছাঁকনি (Glomerulus) আছে। সরু ও ছোট ছোট রক্তনালি মিলে এ ছাঁকনি তৈরি হয়। এ ছাঁকনি রক্তকে পরিশোধন করে দূষিত পদার্থ প্রস্রাব দিয়ে বের করে দেয় এবং প্রয়োজনীয় উপাদান রক্তে ধরে রাখে।
কোনো সুস্থ ব্যক্তি তার একটি কিডনি অন্যকে দান করলে তার ছাঁকনির সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যায়। তবে কিছুদিন পর ওই ছাঁকনিগুলো আকারে বড় হয়ে যায় ও তাদের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। ফলে দাতা ব্যক্তি একটি সুস্থ কিডনি নিয়েও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন।
কোন জিনিস কিডনির ক্ষতি করে
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, নেফ্রাইটিস, কিডনির পাথর, ইনফেকশন, ব্যথানাশক ওষুধ সেবন, কিছু কিছু অ্যান্টিবায়োটিক, কিছু কিছু হারবাল মেডিসিন, কৃষিজাত দ্রব্যে ব্যবহৃত কীটনাশক, খাদ্যে মিশ্রিত ভেজাল সামগ্ৰী কিডনির ক্ষতি করতে পারে।
কিডনি রোগ কী বংশগত
কিছু কিছু কিডনি রোগ বংশগত হতে পারে। যেমন, পলিসিসটিক কিডনি ডিজিজ (ADPKD) । এ রোগে কিডনিতে জায়গায় জায়গায় পানি জমে যায় (Cyst) এবং কিডনির সাইজ অনেক বড় হয়ে যায়। এ রোগে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয় এবং স্থায়ীভাবে কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে (CKD) । কখনো কখনো এই সিস্টগুলোতে ক্যানসার হতে পারে।
আরেক ধরনের বংশগত কিডনি রোগ আছে, যাকে Alor Syndrome বলা হয়। এ রোগে কানে কম শোনা এবং চোখ পরীক্ষা করলে অস্বাভাবিকতা ধরা পড়তে পারে। এ রোগের ফলে কম বয়সে স্থায়ীভাবে কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে। এর বাইরেও অনেক ধরনের বংশগত কিডনি রোগ আছে।
খাদ্য কী কিডনি রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে
ক্রমাগত অগ্রসরমান ক্রনিক কিডনি রোগ নিয়ন্ত্রণে খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। খাদ্যে আমিষের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে (Low Protein Diety)। যেসব খাদ্যে উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম, ফসফরাস, লবণ, ইউরিক এসিড আছে, সেসব খাদ্য কম খেতে হবে। পানীয় পান পরিমিত হতে হবে।
কিডনিবান্ধব খাদ্য
১. পর্যাপ্ত শাকসবজি ও তাজা ফলমূল খেতে হবে।
২. পরিমিত আমিষ খেতে হবে।
৩. পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। প্রতিদিন মানুষের শরীরে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে যে পরিমাণ বর্জ্যপদার্থ রক্তে জমা হয় তা শরীর থেকে বের করার জন্য প্রতি ২৪ ঘণ্টায় প্রায় দুই লিটার প্রস্রাব হওয়া দরকার। তার জন্য ২৪ ঘণ্টায় আড়াই থেকে তিন লিটার পানীয় পান করা যেতে পারে। প্রস্রাবের বর্ণ যদি পানির বর্ণের হয়, তাহলে বুঝতে হবে শরীরে পানিশূন্যতা নেই।
গর্ভাবস্থায় কিডনি
গর্ভাবস্থায় কিডনিতে রক্ত চলাচল বেড়ে যায়। কিডনির সাইজ বড় হয়। কিডনির ফাংশন (GFR) ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। কিডনির পেলভিস (Pelvis), (Ureter) ফুলে যেতে পারে (Hydronephrosis)। এ স্থানে প্রস্রাব জমে যেতে পারে এবং ইনফেকশন হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। গর্ভাবস্থায় কিডনির আল্ট্রাসনোগ্রাফি করানো হলে দেখা যাবে কিডনি ফুলে আছে (Hydronephrosis)। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এটি গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক পরিবর্তনের একটি অংশ হতে পারে। বড়জোর একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
তবে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, কারও যদি গর্ভকালীন সময়ের পূর্ব থেকেই কিডনি রোগ থাকে, তাহলে গর্ভাবস্থায় ওই কিডনি রোগ বেড়ে যেতে পারে। গর্ভাবস্থায় যদি প্রস্রাবে এলবুমিন, লোহিত বা শ্বেত রক্ত কণিকা পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
বয়স্কদের কিডনি
মানুষের বয়স ৪০ বৎসর হলে তার কিডনি সর্বোচ্চ ওজন প্রায় ৪০০ গ্রাম এবং দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত অর্জন করে এবং তারপর প্রতি ১০ বৎসরে ১০ শতাংশ হারে কিডনির ওজন ও সাইজ কমতে পারে। ৪০ বৎসর বয়স থেকে কিডনির রিজার্ভ ফাংশান কমতে থাকে। কিডনির ফাংশান (eGFR) ফর্মুলার মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়। দেখা গেছে, ৪০ বৎসর বয়স থেকে GFR প্রতি বৎসর ০.৭৫ মিলি/মিনিট/১.৭৩ মিলি করে কমতে থাকে। স্বাভাবিক GFR হচ্ছে পুরুষ ১৩০ মিলি/মিনিট/১.৭৩ মিলি, মহিলা ১২০ মিলি/মিনিট/১.৭৩ মিলি। অতএব কোনো বয়স্ক ব্যক্তির GFR স্বাভাবিকের চাইতে কম হলে অথবা কিডনির সাইজ স্বাভাবিকের চাইতে ছোট হলে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। বড়জোর একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
কোমরে ব্যথা কী কিডনি রোগের কারণ
আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, বেশিরভাগ কোমরে ব্যথা কিডনি রোগের কারণে হয় না। আবার সব কিডনি রোগে কোমরে ব্যথা হয় না।
স্থূলতা ও কিডনি রোগ
স্থূলতা কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। স্থূলতার কারণে এক ধরনের নেফ্রাইটিস হয়, যার ফলে প্রস্রাবে এলবুমিন যায় এবং শরীরে পানি এসে যায়। এ ধরনের নেফ্রাইটিস দুরারোগ্য। আবার স্থূলতার কারণে ডায়াবেটিস হয় এবং ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগ হতে পারে। স্থূলতার কারণে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে এবং উচ্চ রক্তচাপজনিত কিডনি রোগ হতে পারে। স্থূলতার কারণে কোমরে এবং হাঁটুতে ব্যথা হতে পারে এবং ব্যথানাশক ওষুধ সেবনের ফলে কিডনি রোগ হতে পারে।
বাত রোগ ও কিডনি
বেশিরভাগ বাতজনিত রোগে কিডনি আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া বাতজনিত রোগে যে সকল ওষুধ ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর কারণে আকস্মিক কিডনি বিল (AKI) ও ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (CKD) হতে পারে। এজন্য বাতের রোগীদের সাবধানতা জরুরি, নিয়মিত কিডনির চেকআপ করা উচিত।