স্ট্রোক নিয়ে যত কথা

ডা. মো. শফিকুল ইসলাম
2021-01-22 01:27:30
স্ট্রোক নিয়ে যত কথা

প্রতীকী ছবি

স্ট্রোক নিয়ে অনেক মিথ আছে।  অনেকে স্ট্রোক হলে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল হাসপাতালে যায়, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে যায়।  কারণ, বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন স্ট্রোক একটি হার্টের অসুখ।

স্ট্রোকের বেসিক আসলে স্ট্রোক কী? কত ধরনের আছে? কী কী লক্ষণ হলে বুঝবো বা এর প্রতিকার কী?- এসব বিষয় জানতে হবে। যাইহোক, আমি কথা বলব বেসিক ওভারভিউ নিয়ে।

স্ট্রোক সার্জারিকে আমি আসলে সার্জারি না বলে বলি স্ট্রোক ইন্টারভেনশন। ইন্টারভেনশন মানে সবকিছুই আর কী, মানে স্ট্রোক হলে এটাকে কীভাবে ইন্টারফেয়ার করবো।

স্ট্রোকের বেসিক এক লাইন একটা কথা বলে নিই। আমরা জানি যে, স্ট্রোক আসলে হার্টের থেকে আলাদা। হার্ট অ্যাটাক মানে শুধু হার্টের রক্তনালী বন্ধ হয়ে গেলেই হার্ট অ্যাটাক হয়। কিন্তু ব্রেইনের ক্ষেত্রে বিষয়টা আসলে ডাইভার্স। ব্রেইনের রক্তনালী বন্ধ হয়ে গেলেও যেমন স্ট্রোক হয়, রক্তনালী ছিঁড়ে গেলেও স্ট্রোক হয়।

রক্তনালী বন্ধ হয়ে গেলে যে স্ট্রোক হয় তার ঘটনা অনেক বেশি। প্রায় ৮৫ ভাগ। রক্তনালী ছিঁড়ে গেলে যেটা হয় সেটা প্রায় ১৫ ভাগ। তো আমরা রক্তনালী বন্ধ হয়ে যাওয়াকেই বেশি হাইলাইট করবো কারণ এটা অনেক বেশি। এটা দেরিতে যে চিকিৎসা সারা বিশ্বব্যাপী হচ্ছে সেটা ডায়ামেট্রিক সেটার রেজাল্টও অনেক বেশি।

আর হেমোরেজিক স্ট্রোক সেটা আমরা অনেকদিন থেকেই করছি, অপারেশন করছি, এটার একটা পর্যায়ে অলরেডি আমরা আছি। তো ইস্কেমিক স্ট্রোক যদি এখন আমরা বলি। ইস্কেমিক স্ট্রোক মানে বেসিক আমি যদি সহজ ভাষায় বোঝাতে চাই, ব্রেইনে যে চারটা রক্তনালী আছে, চারটা রক্তনালী গিয়ে ব্রেইনকে নারিশ করে। সামনে দুইটা, পেছনে দুইটা। এরা বিভিন্নভাবে ব্রাঞ্চ হয়ে ব্রেইনে ছড়ায় যায়। এক দিয়ে ভালো, আল্লাহই আসলে সব প্রটেকটিভ সিস্টেম দিয়ে রাখেন।

এই চারটা রক্তনালী একটা আরেকটার সাথে পরস্পর সংযুক্ত।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একটা বড় রক্তনালী আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু ওই রোগীটা ভালো আছে কারণ ওদের ইন্টারকানেকশনটা একটা চলে যাওয়ার পরও বাকি তিনটা রক্তনালী যেই রক্তনালীটা বন্ধ হয়ে গেছে ওই টেরিটোরিটা মেইনটেইন করছে। তো ইস্কেমিক স্ট্রোক ব্রেইনের যেকোনো একটা রক্তনালী, একটা বড় অংশ বা ব্রেইনের বড় টেরিটোরিকে সাপ্লাই করে এরকম রক্তনালী যদি বন্ধ হয়ে যায় আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে যত দ্রুত সময়ে ওই রক্তনালীটা খুলে দেওয়া যায়। এজন্যই কিছু নিউমোনিকস বের করা হয়েছে।

এরকম হওয়ার সাথে সাথে আমরা রোগীটাকে হসপিটালে দ্রুত পাঠাব। হাসপাতালে আসার থে সাথে আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে রক্তনালী খুলে দিবো। কিন্তু আমার শর্ত হচ্ছে রক্তনালী খুলে দেওয়ার আগে ব্রেইনের ওই পার্টটা যাতে ড্যামেজ না হয়। ড্যামেজ হওয়ার আগে যদি রক্তনালী খুলে দিই তাহলে ওই রোগীটা পরের দিন হেঁটে বাড়ি যাবে। 

এটা আমরা দুইভাবে করতে পারি। একটা হচ্ছে থ্রম্বোলাইসিস বলি, ক্লগ বার্স্টিং ড্রাগ যে ড্রাগ দিয়ে ক্লগটাকে গলায় ফেলা হয় সেটা আমরা শিরায় ব্যবহার করতে পারি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধমনীতেও ব্যবহার করা যায়।

আমরা শিরা ধমনী বুঝি। ভেইন ও আর্টারি। করে আমরা যখন লাইসিস করলান রক্তনালী খুলে গেলো এবং এটা ভালো হয়ে গেলো। এটা অনেক ক্যালকুলেশন আছে, অনেকে বলে সাড়ে ৪ ঘন্টা, অনেকে বলে ৬ ঘণ্টা।  তবে বেসিক্যালি সাড়ে ৪ ঘণ্টা-৬ ঘণ্টার পর শিরায় দেওয়া হয় না। শিরায় যত দ্রুত আসে তত ভালো। এরপরে আসলে রোগীর অবস্থার ওপরে, অবস্থা বলতে আমি ক্যালকুলেট করবো আমি এখন ইন্টারভেন করছি ফাইন এটা জটিল কোন সমস্যা না। এটা করার সময় রোগীর ব্রেইন ভায়াবল আছে কি না।

এটা সাধারণ। এটার জন্য এক্সপার্ট বা বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নাই। আমি রক্তনালীটা খুলে দিলাম, তার আগেই যদি ওই টেরিটোরিটা ড্যামেজ হয়ে যায়। তাহলে রক্তনালী খুলে লাভ হবে না। বরং আরো ক্ষতি হয়ে ওখানে রক্তক্ষরণ হবে। তো আমাকে দেখতে হবে ব্রেইনটা যদি ভায়াবল থাকে আমি রক্তনালীটা খুলে দিবো।

একটা হচ্ছে আইভি থ্রম্বোলাইসিস, যেটা আমি বলেছি। এটা আসলে এভারেজ সেটআপ দরকার।  আমি চাইলে আমি জেনারেল লেভেলে বা আমার যদি একটা এভারেজ সেটআপ থাকে আমি তার চেয়ে রিমোট এরিয়াতে এটা করতে পারি। আমার জানা হলো। বি ফাস্ট এটা আসলো, একটা সিটি স্ক্যান করলাম। আমি নিশ্চিত হলাম যে রক্তক্ষরণ হয়নি। রক্তনালী বন্ধ হয়ে গিয়েছে আমি থ্রম্বোলাইটিক ড্রাগ দিবো আর কী। এটাই হার্টের সাথে পার্থক্য।  হার্টে রক্তক্ষরণ হয় না। তো আমাকে এটা আসলে নিশ্চিত হওয়ার দরকার রক্তক্ষরণ হয়নি এটা জানলে আমি থ্রম্বোলাইসিস ড্রাগ দিবো বা আরো ইকোস্পিন টাইপের ওষুধ যেটা আমরা সবাই জানি আসলে এটা দিবো। আর যদি আমি ঢাকায় থাকি বা আমি বড় শহরে থাকি যেখানে আমার সেটআপ অনেক ভালো। যেমন হার্টে রিং পড়ে। এখন হার্ট অ্যাটাক হলে আমরা ইমিডিয়েট রোগীকে কিউর করে নিয়ে আসতে পারি। তো আমরা ওইরকম সেন্টারে গেলাম যেখানে ভালো ব্যবস্থা আছে। রোগী আসার সাথে সাথে সিটি স্ক্যান বা এনিসিলিয়ারি সব পরীক্ষা করে নিয়ে গেলাম। গিয়ে আমি ধমনীর মাধ্যমে যেখানে রক্তটা জমাট বেঁধে আছে।

এখানে স্লাইডে আমি একটা জিনিস একটু বোঝানোর চেষ্টা করছি, ওইখানে দেখা যায় একটি ছেলের মাথা দিয়ে রক্ত পড়ছে সে হয়তো এক্সিডেন্ট করছে। তো এটা যদি আমাদের কারো সন্তানের হয় আমি কিন্তু সব কিছু ভুলে দৌড়াতে থাকবো যে আমি কীভাবে আমার ছেলের মাথার এই ব্লিডিংটা বন্ধ করা যাবে। এইটা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি জরুরি বিষয়। তো সেরকম নিচে আমরা যেটা জানি না এটা যদি আমরা জানি, আমরা স্ট্রোকটাকে ইগনোর করি। কারণ আমরা জানি না যে, স্ট্রোক কতটা ভয়াবহ। প্রতি সেকেন্ডে ২২ লক্ষ নিউরন ড্যামেজ হয়। তো আমার একটা বড় রক্তনালী বন্ধ হয়ে গিয়েছে যেটা আমি দেখানোর চেষ্টা করছি যদি ওইটা আমি ইন্টারভেন না করি টোটাল ডটের টেরিটোরি ড্যামেজ হয়ে যাবে।

রোগীটা স্থায়ীভাবে প্যারালাইসিস হবেন বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো মারাও যান। তো আমি যদি জানি যে, স্ট্রোকটা এতটা ভয়াবহ। 

এই সময়ে এটাও জানি যে, প্রতি ৫ জনের ১ জন স্ট্রোকের ঝুঁকিতে আছেন। পুরো জীবনের যেকোনো সময় হতে পারে। এতকিছু জানার পরে আমি তখন উসাইন বোল্টের মতো দৌড়াতে থাকবো যদি আমার কেউ বা আমার কোনো আত্মীয় হেমিপ্লেজিয়া বা মুখ বাঁকা হয়ে আমার সামনে আসে আর কী।

আমি সবকিছু ভুলে রোগীটাকে নিয়ে ছুটবো আর কী।

স্ট্রোক হওয়ার সাথে সাথে আমরা যারা একটু এ বিষয়ে এক্সপার্ট তারা বুঝতে পারবো যে ডানদিকের সিটি স্ক্যানটি অলরেডি কালো হতে শুরু করেছে। তো এই রোগীকে যদি আমি চিকিৎসা করতে না পারি বা না করি তো ওরকম বড় একটা কালো দ্যাট মিনস ওই পার্টটা ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে। ওই পার্টটা ড্যামেজ হয়ে রোগীর একটি পার্মানেন্ট ডিজাবিলিটি নিয়ে আসবে। আর নিচের মাঝখানের স্লাইডটা আসলে আমাদের করা। আমাদের একজন রোগী উনি আসছিলেন লাকিলি। ওই সাদা অংশ দেখা যাচ্ছে ওখানে ব্লাড সাপ্লাই কমে গেছে রক্তনালী বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য আমরা ধমনীর মাধ্যমে গিয়ে ক্লগটা বের করে নিয়ে আসতে পারছি যার জন্য তার রক্তনালী খুলে গিয়েছে। পেশেন্ট ৩/৪ দিন পর হেঁটে বাড়ি গেছেন। হি ইজ ফাইন।

পরে ছবিটা আমাদের দেশের কোনো একজনের উনিও অ্যাটাক করছেন। অ্যাটাক করার পর উনি আসলে ইন টাইম আসতে পারেননি কারণ উনি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছিলেন। আল্টিমেটলি ওই টোটাল জায়গাটা কালো হয়ে গিয়েছে। সেই কালোটা আমরা দেখছি ড্যামেজ। এই ড্যামেজ হওয়া নিয়ে আরেকটা জিনিস বলে নেই। এরকম ড্যামেজ হলে আমরা যেহেতু রক্তনালী খুলতে পারি নাই ড্যামেজের কোয়ান্সিকোয়েন্স হিসেবে ব্রেইনটা ফুলতে থাকে বলে জানেন সেক্ষেত্রে আমরা হাড্ডিটা খুলে রাখার একটা সার্জারি অনেক সময় করে থাকি ব্রেইনকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য।

আল্টিমেটলি নিচের সিরিজের রোগীটা কিন্তু আমরা ধরে রাখতে পারিনি। উনি মারা গেছেন। তার মানে যথাসময়ে আমরা মাঝখানের রোগীটা বা প্রথম রোগীটার ক্লগটা বের দিছি ফলে ভালো হয়ে গেছেন কিন্তু পরের রোগীটা আমরা বাঁচাতেই পারিনি। তো এই হচ্ছে ইস্কেমিক স্ট্রোকের ইন্টারভেনশন এটা এতটাই যুগোপযোগী, টাইম ডিমান্ডিং বা গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা ইন্সিডেন্স আমরা দেখি আমরা ক্লিনিক্যাল প্রাকটিজিং এতই বেশি এবং এটার পেছনে আমরা ছুটছি নিউরোলজিস্ট, নিউরোসার্জনসরা এটা সারা দেশে ছড়ায় দেওয়ার জন্য কাজ করছি এবং এটার রেজেল্টটা এতটাই রিওয়ার্ডিং এবং দিস ইজ দ্য ট্রিটমেন্ট।  এটাই হচ্ছে একিউট ইস্কেমিক স্ট্রোকের ট্রিটমেন্ট। যার মাধ্যমে অনেক রোগীকে আমরা ভালো করতে পারি। এদের অনেকের বা এদের সবাই আসলে একটি ফ্যামিলির আর্নিং মেম্বার। যদি ভালো হয়ে যায় পরিবারের হাল ধরবে আর যদি ভালো না হয় এই লোকটাই পরের দিন থেকে পুরো পরিবারের বোঝা হয়ে যাবে। তাই আমি এবসট্র্যাক্ট আবারও বলি, একিউট ইস্কেমিক স্ট্রোকের রোগী আমরা যদি এই লক্ষণ দেখার সাথে সাথে হসপিটালে আনি, আমরা যদি প্রোপার টাইমে ইন্টারভেন করি, থ্রম্বোলাইসিস ক্লগটা ভেঙ্গে দিলাম, থ্রম্বাটোমিক ক্লগটাকে বের করে দিলাম তাহলে এই রোগীটা পরের দিন হেঁটে বাড়ি যাবে বা যেতে পারে। আর যদি এটা করতে ব্যর্থ হই তাহলে এই রোগী স্থায়ীভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে।  অথবা এদের কেউ কেউ মারাও যাবে।

শেষ কথা: আমরা জানি সবাই, স্ট্রোক প্রিভেন্টেবল অসুখ। ৮০ ভাগ স্ট্রোক প্রিভেন্ট করা যায়। বাকি ২০ ভাগ যেটা চিকিৎসা করা যায় সেটাও সম্ভব এবং প্রিভেন্ট করার সব থেকে বড় অস্ত্র, সবথেকে বড় অস্ত্র নিয়মিত হাঁটুন,  সুস্থ থাকুন। নিয়মিত হাঁটুন,  সুস্থ থাকুন।


আরও দেখুন: