সুস্থ থাকতে যেসব খাবারের প্রয়োজন
পুষ্টিবিদ নুর ই জান্নাত ফাতেমা
প্রায় আঠার কোটি মানুষের বাস মাত্র ১ লাখ ৪৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের বাংলাদেশে। অনেকেই এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে দেশের জন্য বোঝা মনে করতে পারেন। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা এবং উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বিশাল জন-সম্পদে রূপান্তরিত করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।
শিক্ষাখাতে প্রতিবছর বাজেট বরাদ্দ থেকেছে সর্বোচ্চ। স্বাস্থ্যখাতেও বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রতিবছর। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনে জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের পুষ্টির চাহিদা পূরণে কাজ করে যাচ্ছে। শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের ভিটামিন এ এর অভাবজনিত অন্ধত্ব প্রতিরোধের লক্ষ্যে প্রতি ছয় মাস অন্তর পালিত হচ্ছে জাতীয় ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন।
গর্ভবতী মায়েদের রক্ত স্বল্পতা দূরীকরণের জন্য বিনামূল্যে আয়রন ফলিক এসিড ট্যাবলেট সরবরাহ করা হচ্ছে। মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্তন্যদানকারী মায়েদের পুষ্টি (পুষ্টিকর খাবারের)প্যাকেট বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। এরকম শত শত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে জনগণের পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য।
সাফল্যও এসেছে এসকল কার্যক্রমের মাধ্যমে। তথাপি এক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ রয়ে গেছে আরো বিস্তর। ১৯৭০ বা ৮০ দশকে এদেশে অপুষ্টির হার ছিল আশঙ্কাজনক। সেসময় সম্পদের অভাব, খাবারের অপ্রতুলতা এবং দারিদ্র্য ছিল অপুষ্টির মূল কারণ। কিন্তু বর্তমানে দেশের মানুষের আর্থিক সঙ্গতির সাথে সাথে রাষ্ট্রের সক্ষমতা ও পৃষ্ঠপোষকতা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে।
এখন অভাব, দারিদ্র্য বা সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে মানুষ অপুষ্টির শিকার হয় না, অপুষ্টির শিকার হয় এবিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও সচেতনতার অভাবে। বর্তমানে অশিক্ষিত-তো বটেই, শিক্ষিত সমাজেও রয়েছে পুষ্টি সম্পর্কে অনেক অসচেতনতা ও ভ্রান্ত ধারণা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রয়োজনীয় সচেতনতাই পারে এদেশ থেকে অপুষ্টির অভিশাপ নির্মূল করতে।
সাধারণ অর্থে পুষ্টি একটি প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ায় খাদ্য গ্রহণ, পরিপাক, শোষণ, আত্তীকরণ ও অপাচ্য অংশ দেহের বাইরে নিষ্ক্রান্ত হয় তাকে পুষ্টি বলে। তবে এই খাদ্য হতে হবে সুষম মাত্রার, অর্থাৎ যে খাবারে দেহের ক্ষয়পুরণ, বৃদ্ধিসাধন ও এগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় সকল উপাদান সঠিক পরিমাণে থাকবে তাকেই পুষ্টিকর খাবার বলা যাবে।
প্রতিদিন আমরা যে সকল খাবার খাই কার্যকারিতার ভিত্তিতে তাদেরকে প্রধানত ছয় ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: শর্করা, আমিষ, স্নেহ, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি। শর্করা জাতীয় খাবার দেহের জন্য শক্তির যোগান দেয়, মূলত দেহের শক্তি চাহিদার প্রাথমিক উৎস এই শর্করা। পরিপাক শেষে শর্করা জাতীয় খাবার হতে গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, ল্যাক্টোজ, গ্যালাক্টোজ অথবা এসবের সরল পলিমার উৎপন্ন হয়। এসব কার্বোহাইড্রেট দেহকোষে শ্বসন প্রক্রিয়ায় জারিত হয়ে কার্বন ডাই অক্সাইড, পানি ও শক্তি উৎপন্ন করে।
বাড়তি কার্বোহাইড্রেট গ্লাইকোজেন বা স্টার্চ হিসেবে দেহে বিশেষ করে যকৃতে জমা থাকে এবং প্রয়োজনের সময় দেহে দ্রুত শক্তির যোগান দেয়। ভাত, রুটি, আলু ইত্যাদি শর্করা জাতীয় খাবার। মাছ, মাংস, ডিম, ডাল,শিম-বীজ ইত্যাদি আমিষ জাতীয় খাবার। পরিপাক শেষে আমিষ হতে বিভিন্ন এমাইনো এসিড ও এর পলিমার উৎপন্ন হয়। আমিষ দেহের ক্ষয়পূরণ ও বৃদ্ধিসাধনে সহায়তা করে। উল্লেখ্য যে. ডিমের সাদা অংশ আমিষ জাতীয় কিন্তু কুসুমে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন, খনিজ লবণ ও চর্বিসহ অন্যান্য উপাদান।
তেল ও চর্বি স্নেহ জাতীয় খাবার। খাদ্যের অনেক উপাদান আছে যেগুলি পানিতে দ্রবণীয় নয় কিন্তু তেল বা চর্বিতে দ্রবণীয়, যেমন ভিটামিন এ। এ জাতীয় খাবার পানিতে ধুয়ে নিলে বা রান্নার পর সংশ্লিষ্ট উপাদান খাদ্যে আর থাকে না। কিন্তু তেল বা চর্বিতে দ্রবণীয় হওয়ায় তেল বা চর্বি যোগ করলে সংশ্লিষ্ট খাদ্য উপাদান অক্ষত থাকে। ফলে ওই উপাদান দেহের গ্রহণোপযোগী হয়। তাছাড়া এরা খাবারকে সুস্বাদু ও মুখরোচক করে। তেল বা চর্বিজাতীয় খাবার হতে প্রচুর পরিমাণে শক্তি উৎপন্ন হয়। কিন্তু এদের শ্বসন প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ। স্নেহ জাতীয় খাবারের বেশিরভাগই চর্বি হিসেবে দেহে সঞ্চিত থাকে এবং দেহকে মেদবহুল স্থূলকায় পরিণত করে। এতে দেহের কর্মক্ষমতা কমে যায় ও দেহে নানা ধরনের রোগ দানা বাধতে থাকে।
দেহের জরুরি প্রয়োজনে স্নেহ জাতীয় খাবার শক্তির উৎস হিসেবে অতটা কার্যকরী নয়। এরা দেহে শক্তির সেকেন্ডারি সোর্স হিসেবে কাজ করে। আর প্রাইমারি সোর্স হিসেবে কাজ করে শর্করা। দেহে সঞ্চিত শর্করা নিঃশেষ হলে তবেই চর্বি হতে শক্তি উৎপাদন শুরু হবে। অনেকে দেহের ফিটনেস ধরে রাখতে কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করে থাকেন। তাদের মনে রাখতে হবে যে দেহে সঞ্চিত শর্করা নিঃশেষ হবার পরে মূলত চর্বি বার্ন হবে। তাই কায়িক শ্রম বা ব্যয়াম যাই হোক না কেন চর্বি কমানোর জন্য তার মাত্রা হতে হবে একটু বেশি। তবে সবথেকে ভাল এ জাতীয় খাবার কম খাওয়া বা একেবারেই পরিহার করা।
খাদ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ভিটামিন। এযাবৎ আবিষ্কৃত ভিটামিনের সংখ্যা দুই শতাধিক। তন্মধ্যে ভিটামিন এ, বি, সি, ডি ও কে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিনের প্রয়োজন খুব অল্প পরিমাণে হলেও তা অপরিহার্য। ভিটামিন শাকসবজি ও ফলমূলে পাওয়া যায়, তবে আলাদাভাবে ভিটামিন জাতীয় কোন খাবার হয় না। একেক খাবারে একেক ভিটামিন পাওয়া যায়। যেমন: সবুজ শাক (কলমিশাক, পালংশাক, পুইশাক, ডাটাশাক, লাউশাক, সজনেপাতা ইত্যাদি) ও হলুদ ফলে (আম, কাঁঠাল, পেঁপে ইত্যাদি) ভিটামিন এ পাওয়া যায়।
ভিটামিন বি পাওয়া যায় পটলে। সি পাওয়া যায় আমলকী, লেবু, জাম্বুরা (বাতাবিলেবু), কমলালেবু, কাঁচামরিচ ইত্যাদিতে। তেল ও চর্বিতে ভিটামিন ই এবং ডি থাকে। কলিজা ও মাছের চর্বিতে থাকে ভিটামিন কে। বিভিন্ন ভিটামিনের কার্যকারিতা বিভিন্নরকম। যেমন: ভিটামিন এ দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখে, সি এবং ডি হাড় ও দাঁত মজবুত করে, কে রক্ত জমাট বাধতে সাহায্য করে।
অনেকে একমাত্র খাদ্য লবণকে খনিজ লবণ বলে ভুল করে থাকেন। আসলে খাবার লবণ হতে আমরা শুধুমাত্র সোডিয়াম পেয়ে থাকি। কিন্তু আয়রন, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, জিঙ্ক ইত্যাদি খনিজ লবণ দেহের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ যা অন্যান্য উৎস হতে পাওয়া যায়। যেমন: তেঁতুল, খেজুর, কালজাম, কচুশাক ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণ আয়রন থাকে যা গর্ভবতী মায়েদের জন্য অপরিহার্য। দুধে পাওয়া যায় ক্যালসিয়াম যা দাঁত ও হাড় মজবুত করে।
পানির অপর নাম জীবন। খাদ্যের প্রত্যেকটি উপাদান কার্যকরী হবার জন্য প্রয়োজন পানি। তাছাড়া খাদ্যের অপাচ্য অংশ পানির সাথে মিশে মূত্র আকারে দেহের বাইরে নিষ্ক্রান্ত হয় ও দেহকে ক্ষতিকর উপাদানের প্রভাব থেকে রক্ষা করে। পানির উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। এক কথায় বলা যায় দেহকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখতে হলে প্রতিদিন কমপক্ষে তিন লিটার পানি পান করা উচিত, তবে তা অবশ্যই বিশুদ্ধ হতে হবে।
আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় উপরিউক্ত ছয় প্রকার খাবারের প্রত্যেকটি উপাদান সঠিক পরিমাণে নিশ্চিত করতে হবে। এর যে কোন একটি বাদ পড়লে দেহের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে এবং অসুস্থতা এগিয়ে আসবে। সুষম খাবার শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য যেমন অপরিহার্য, দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টির জন্যও এর কোন বিকল্প নেই। সুস্থ দেহের কর্মক্ষম নাগরিক দেশ ও জাতীর জন্য এক বড় সম্পদ। এ সম্পদ গড়ে তোলা এবং তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং বর্তমান সরকার যে এই দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
মতামত উপস্থাপন করেছেন- প্রাভা হেলথের পুষ্টিবিদ নুর ই জান্নাত ফাতেমা