স্বাস্থ্য খাতে নয়টি চ্যালেঞ্জ

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান
2020-10-03 02:04:24
স্বাস্থ্য খাতে নয়টি চ্যালেঞ্জ

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে ভালো অর্জন রয়েছে। শিশুমৃত্যুর হার কমেছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ একধরনের সন্তোষজনক জায়গায় এসেছে, মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে, টিকাদান কর্মসূচি গতি পেয়েছে ইত্যাদি। এ অর্জনগুলোকে বলা যায় এমডিজি যুগের অর্জন। এখন আমরা আছি এসডিজি যুগে।

আগে আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’। এখন ওই আকাঙ্ক্ষায় নতুন কিছু শব্দ যোগ করতে হয়েছে। এখন আমরা বলছি ‘সবার জন্য সহজলভ্য ও মানসম্মত স্বাস্থ্য’। আগে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ বললে বোঝা যেত দেশের মোটামুটি সব জায়গায় হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র বানালেই হয়ে গেল। এখন কিন্তু আমাদের ‘মানসম্মত ও সহজলভ্য স্বাস্থ্য’ বলতে হচ্ছে। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ বলতে যে আকাঙ্ক্ষার কথা আমরা বলে এসেছি, তা এখনো নিশ্চিত হয়নি। তবে দিনবদলের কারণে আকাঙ্ক্ষাটাকেও এখন আমাদের নতুন করে সাজাতে হচ্ছে।

আগে মোটামুটি একজন ডাক্তার দেখাতে পারলেই হতো। আর এখন চিকিৎসার মান নিশ্চিত করাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আগে মানুষ বেশি মারা যেত ছোঁয়াচে রোগে। সেটি অনেকাংশে আমরা কমিয়ে ফেলেছি। এখন মারা যাচ্ছে অসংক্রামক ব্যাধিতে। এখন আমাদের খাদ্যাভ্যাস, শহরের পরিবেশ, বাতাসের দূষণ—এসব কারণে অসংক্রামক রোগ বেড়ে চলেছে। দেশে হাঁপানি ও ক্যানসারের রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশারে আক্রান্তের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে গেছে। আগে, মানে এমডিজি যুগে মহামারি ছিল কলেরা, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি। সেগুলো সম্পূর্ণ চলে গেছে, তা নয়। তবে এখন পরিপ্রেক্ষিতটা বদলে গেছে। নতুন নতুন রোগ মহামারির আকার নিচ্ছে। এখন মহামারি হচ্ছে ক্যানসার, হার্ট অ্যাটাক এবং ডায়াবেটিস, সড়ক দুর্ঘটনা ইত্যাদি—এগুলো হচ্ছে নতুন যুগের, মানে এসডিজি যুগের মহামারি।

এখন স্বাস্থ্য খরচ অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। সরকারি হিসাবের তথ্য বলছে, আমাদের স্বাস্থ্যের পেছনে যত খরচ হয়, তার ৬৭ শতাংশই মানুষ নিজের পকেট থেকে খরচ করছে। অথচ বৈশ্বিক মান হচ্ছে ৩৪ শতাংশের মতো। তার প্রায় দ্বিগুণ আমরা খরচ করছি। আমাদের কাছে স্বাস্থ্য খরচ একটা বড় বোঝা। স্বাস্থ্যসেবার খরচের বিষয়টি আমরা ঠিকমতো স্বীকার করি না বলে দারিদ্র্য হ্রাসের গতি কমে যাচ্ছে বা দারিদ্র্য বেড়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্যবিমোচন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।
সমস্যাগুলোকে উপলব্ধিতে নিয়ে সমাধান করতে পারলে সার্বিকভাবে জনস্বাস্থ্য ভালো হবে। উৎপাদন ভালো হবে। কারণ, উৎপাদনশীলতার সঙ্গে স্বাস্থ্যের একটা সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। তার মানে একদিকে স্বাস্থ্যে খরচের বোঝাটা না কমাতে পারলে দারিদ্র্য বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে সঠিকভাবে যদি এটি আমলে নিতে পারি, তাহলে প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাবে। তার মানে এ ক্ষেত্রে দ্বিমাত্রিক একটি গুরুত্ব রয়ে গেছে। এই গুরুত্ব শুধু স্বাস্থ্য খাতের লোকজন নয়, বৃহত্তর নীতিনির্ধারকদের সামনেও এটি তুলে ধরা প্রয়োজন।
আমি মনে করি, আমাদের সামনে ৯টি চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

এক. অবকাঠামো ও জনশক্তির মধ্যে ভারসাম্যহীনতা একটা বড় সমস্যা। ধরা যাক, উপজেলায় ১৫০ শয্যার হাসপাতাল করা হলো। কিন্তু জনশক্তি ৫০ শয্যার। অর্থাৎ অবকাঠামো বাড়ানো হলেও জনশক্তি বাড়ানো হয়নি। এতে আমরা দেখাতে পারছি হাসপাতাল হয়েছে, কিন্তু সেখানে সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার এমনও দেখা যাচ্ছে, হয়তো কোনো হাসপাতালে অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন, কিন্তু নার্স নেই। সাপোর্ট ফোর্স নেই। এটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম দুর্বলতা। এ বিষয়টিকে জোরালোভাবে হাতে নেওয়া দরকার।

দুই. স্বাস্থ্য খাতে মানুষের ব্যয়ের বোঝাটা কীভাবে কমানো যায়, তার উপায়ও আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। স্বাস্থ্য খরচ নির্বাহ করতে গিয়ে শুধু দরিদ্র নয়, অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারও নিঃস্ব হয়ে যায়। কারণ, এখন অসুখের ধরনও পাল্টে গেছে। ক্যানসার অথবা ক্রনিক অসুখের কারণে অনেককে ওষুধ খেয়ে যেতেই হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করতে দেওয়ার মতো কিছু অনৈতিক বিষয়ের কারণেও মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। মানুষের নিজের পকেটের টাকায় চিকিৎসাসেবা নেওয়ার সুযোগ করে দিতে পারছি না। কিছু উদ্যোগ অবশ্য সরকারের আছে। অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ বিলি করার বড় ধরনের প্রোগ্রাম আছে। এসব উদ্যোগ সত্ত্বেও সমস্যাটি বাড়ছে বৈ কমছে না। এই সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যায়, সেটি নিয়ে ভাবতে হবে।

তিন. আমাদের শহরগুলোতে স্বাস্থ্য অবকাঠামো তুলনামূলকভাবে অনুপস্থিত। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল একটি রেফারেল হাসপাতাল। সেখানে শুধু গুরুতর রোগীদের আসার কথা। কিন্তু সেখানে গেলে দেখা যাবে আউটডোরে রোগীদের বিশাল ভিড়। এসব রোগীর তো যাওয়ার কথা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। আউটডোরের বেশির ভাগ রোগীই হচ্ছে নগর দরিদ্র। এই নগর দরিদ্রদের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ঢাকায় একেবারেই কম। এ কারণে নগর স্বাস্থ্য নিয়ে নতুন করে ভাবা খুবই প্রয়োজন।

চার. আমাদের রেফারেল সিস্টেমটা কাজ করছে না। রেফারেল বলতে যা বোঝায়, সেটি হচ্ছে, রোগী প্রথমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাবে। সেখানে যদি চিকিৎসক মনে করেন তাঁর পক্ষে এই রোগীর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়, তখন তিনি রোগীকে রেফার করবেন। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না। কারণ, আগের দিনের মতো এই এসডিজি যুগে একটি বড়ি খেয়েই প্রাথমিক চিকিৎসা এখন আর হবে না। ফলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মানোন্নয়ন ঘটাতে হবে। তাহলে রোগী রেফারেল হাসপাতালে আসবে না। তখন রেফারেল সিস্টেম কাজ করতে শুরু করবে।
পাঁচ. মেডিকেল শিক্ষায় আসা মানুষের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানগত পার্থক্য একটি সমস্যা তৈরি করছে। মেডিকেলে যাঁরা পড়তে আসেন, তাঁদের বেশির ভাগই সচ্ছল বা মধ্যবিত্ত পরিবারের। আর বেশির ভাগ রোগী হচ্ছে গরিব। ওই গরিব রোগীর জীবনযাপন সম্পর্কে সচ্ছল ডাক্তারের ধারণা কম থাকে। ফলে ওই ডাক্তার রোগীর অনেক সমস্যা ধরতে পারেন না। মেডিকেল শিক্ষায় নৈতিকতার বিষয়টি অনেকাংশে অনুপস্থিত। নৈতিকতার শিক্ষার পাশাপাশি সমাজবাস্তবতা বোঝার জন্য গবেষণামূলক শিক্ষাও তাদের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

ছয়. সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থা গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু একধরনের আমলাতান্ত্রিকতাও বেশ গভীর। ধরুন ঢাকা মেডিকেল কলেজ বিরাট একটা ফ্যাসিলিটি। তার প্রিন্সিপাল বা পরিচালক খুব একটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। আমলাতান্ত্রিক–ব্যবস্থা তাঁকে সেই স্বাধীনতা দেয় না। তাঁদের কাজে বাইরের হস্তক্ষেপ যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করাও প্রয়োজন।

সাত. জন্মনিয়ন্ত্রণে আমরা সফল হয়েছি, তা বলা যায়। কিন্তু সেই আত্মপ্রশস্তি নিয়ে যদি আমরা ডুবে থাকি, তাহলে কিন্তু বিপদ ঘনিয়ে আসবে। বাংলাদেশ জন্মনিয়ন্ত্রণে যে কারণে সফল হয়েছে, তার অন্যতম কারণ ছিল ক্যাম্পেইন। এ বিষয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে প্রচার চালানোর একটা বিরাট ভূমিকা আছে। এখনো এ বিষয়ে কাজ করার অবকাশ রয়ে গেছে। এখনো আমাদের যে জনসংখ্যা, সেটি আমাদের জমির ওপর তীব্র চাপ তৈরি করেছে। এই চাপের মাত্রা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে হবে। মানে আমাদের জনসংখ্যার নীতির বিষয়ে আবারও সিরিয়াস হতে হবে।

আট. সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে অতি মুনাফাভিত্তিক বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। এটি রোধ করা দরকার। ব্যক্তি খাতে স্বাস্থ্যসেবা থাকবে না, আমি তা বলছি না। ব্যক্তি খাতের স্বাস্থ্যসেবা জনস্বাস্থ্যে বিরাট ভূমিকা রাখছে। অনেক সময় দেখা যায়, সরকারি হাসপাতালের পরীক্ষা–নিরীক্ষার যন্ত্র দীর্ঘদিন অকেজো হয়ে পড়ে আছে। পাশের ক্লিনিকে সেই পরীক্ষা চলছে। ক্লিনিক মালিক ও সরকারি হাসপাতালের সঙ্গে আঁতাত থাকার কারণে এ রকম হয়ে থাকে। আবার দেখা যায়, মেডিকেল কলেজের সামনে অনেক ওষুধের দোকান। সেসব দোকানে সরকারি হাসপাতালের ওষুধ চলে আসে।

বাণিজ্যিকীকরণের কারণে মানের প্রশ্নও বড় হয়ে উঠছে। সুস্থ সেবা দেওয়ার মাধ্যমে যৌক্তিক মুনাফা অর্জনের যে বাণিজ্যিকীকরণ, সেটি ভালো। কিন্তু অতি মুনাফার লক্ষ্যে বাণিজ্য চালানো বন্ধ করা দরকার। অতি মুনাফার বাণিজ্যিকীকরণে সঠিক সময় ধরে রোগীকে দেখা হচ্ছে না, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ও টেস্ট দিয়ে বাহুল্য খরচের দিকে রোগীকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হবে।

নয়. বাংলাদেশের যেটিকে আমরা ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়’ বলছি, আসলে কিন্তু সেটি ‘স্বাস্থ্যসেবা মন্ত্রণালয়’। ওটা হেলথ মিনিস্ট্রি নয়। ওটা আসলে হেলথ কেয়ার মিনিস্ট্রি। প্রকৃতপক্ষে ওটাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করতে হলে শুধু চিকিৎসাসেবা বা স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে আটকে থাকলে হবে না। সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ এসব কারণে বহু অসংক্রামক ব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এসব রোগ যাতে না হয়, তার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়ার নীতি নিতে পারলেই তা যথার্থ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হয়ে উঠবে।

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

[লেখাটি ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত]


আরও দেখুন: