দেশে ত্রুটিপূর্ণ সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত ট্রায়ালের যথার্থতা কি?
গত ১৯ জুলাই যখন বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) দেশে সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনটির ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দিলো, তার পরের দিনই আমি এই ট্রায়ালের ব্যাপারে শঙ্কা প্রকাশ করি এবং বিস্তারিত লিখি অনলাইনে।
এরপর চ্যানেল-২৪ এ সকালের ‘সুরক্ষায় প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানে আমি ব্যাখ্যা দেই কেন আমাদের ২ হাজার ১০০ জন স্বাস্থ্যকর্মীর শরীরে এই ভ্যাকসিনটির ট্রায়াল শুরু করা হবে ঝুঁকিপূর্ণ। তখনও সিনোভ্যাক তাঁদের ভ্যাকসিনের ফেইজ-১ ও ফেইজ-২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কোনো ফলাফল কোথাও প্রকাশ করেনি। তখন পর্যন্ত এটা অজানা ছিল যে ওই ভ্যাকসিনটি কতটুকু কার্যকরী। কোন ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সম্বন্ধে পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে তা কোনোভাবেই শেষ ধাপের ট্রায়ালে ব্যবহার করা সমীচীন নয়।
এই ফেইজ-৩ ট্রায়ালটা শুরু হওয়ার কথা ছিল আইসিডিডিআরবির অধীনে ঢাকার সাতটি কোভিড হাসপাতালে। আমার ধারণা ছিল এই ট্রায়ালের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনটির ফেইজ-১/২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফলে সন্তষ্ট, আর এ কারণেই চলছে ফেইজ-৩ ট্রায়ালের চিন্তাভাবনা। আমার দাবি ছিল ট্রায়াল শুরুর আগে যেন অন্তত দুটো বিষয় আমাদেরকে অবহিত করা হয়। যথা: ১. সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনটি কি পর্যাপ্ত পরিমাণ ভাইরাস নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি তৈরি করতে পারে? এবং ২. ভ্যাকসিনটি কি করোনাভাইরাসের বিপরীতে টি-সেল বা ইমিউন সেল রেসপন্স ঘটাতে সক্ষম?
অবশেষে গত সপ্তাহে (১০ আগস্ট) সিনোভ্যাক তাদের ভ্যাকসিনটির ফেইজ-২ ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশ করেছে অনলাইন পোর্টাল MedRxiv.org এ। ফলাফল কোনোভাবেই ততটা সন্তষজনক নয়। ফলাফল থেকে এটা পরিস্কার যে ভ্যাকসিনটি কার্যকারিতার দিক দিয়ে অন্যান্য ভ্যাকসিনের তুলনায় খুবই দুর্বল।
সিনোভ্যাকের ফেইজ-২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো হয় চীনে ৬০০ জন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ্য মানুষের উপর। ভ্যাকসিন দেওয়ার ৭ এবং ২৮ দিন পরে তাদের রক্ত পরীক্ষা করে দেখা যায়, প্রায় ৯৫ ভাগ ভ্যাকসিন গ্রহিতার রক্তে ভাইরাস নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি তৈরি হয়েছে, তবে তার টাইটার ছিল মাত্র ১:২৩.৮ থেকে ১:৬৫.৪ যা কি না কনভালেসেন্ট প্লাজমায় প্রাপ্ত নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি টাইটারের চেয়ে প্রায় ২.৫ থেকে ৭ গুণ কম। এই টাইটার নির্ণীত হয় দুই ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়ার পরে। তাদের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষিত কনভালেসেন্ট প্লাজমায় এন্টিবডির টাইটার ছিল ১:১৬৩.৭। বেশিরভাগ বিজ্ঞানীদের মতে, একটি ভ্যাকসিন কাজ করতে হলে তা দ্বারা উৎপাদিত ভাইরাস নিউট্রালাইজিং এন্টিবডির টাইটার অন্ততপক্ষে কনভালেসেন্ট প্লাজমায় প্রাপ্ত এন্টিবডির টাইটারের সমান হতে হবে।
ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত ফলাফল থেকে দেখা যায়, চীনের আরেকটি ভ্যাকসিন ক্যানসিনোবায়ো এবং অক্সফোর্ডের চ্যাডক্স-১, এই দুটো ভ্যাকসিনই তাদের ফেইজ-১/২ ট্রায়ালে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভাইরাস নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, যার টাইটার ছিল কনভালেসেন্ট প্লাজমায় প্রাপ্ত টাইটারের সমান। অন্যদিকে আমেরিকার মর্ডানা এবং জার্মানির বায়োন্টেক এমআরএনএ ভ্যাকসিনদ্বয়ও তাদের ফেইজ-১/২ ট্রায়ালে পর্যাপ্ত নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি তৈরি করেছে। এ সংক্রান্ত তাদের দুটো পেপার প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন এবং নেচার জার্নালে।
শুধু তাই নয়। অক্সফোর্ড, মর্ডানা, বায়োন্টেক এবং কনসিনোবায়ো, এই চারটি ভ্যাকসিনই ফেইজ-১/২ ট্রায়ালে টি-সেল বা ইমিউন সেল রেসপন্স ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু সিনোভ্যাক তাদের পেপারে উল্লেখ করেছে যে তারা পরীক্ষা করে দেখেনি, তাদের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনটি গ্রহিতার শরীরে টি-সেল রেসপন্স ঘটাতে সক্ষম কি না! ভ্যাকসিন থেকে দীর্ঘমেয়াদী ইমিউনিটি বা সুরক্ষা পেতে হলে টি-সেল রেসপন্স অত্যাবশ্যকীয়। এই ইমিউন সেল রেসপন্সের মাধ্যমেই শরীরে টি-সেলগুলো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয় এবং মেমোরি সেল হিসেবে করোনাভাইরাসকে চিনে রাখে। পরবর্তীতে ভ্যাকসিনপ্রাপ্ত ব্যাক্তিটি যখন করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে আসে তখন ওই মেমোরি টি-সেলগুলো তৎক্ষণাৎ সক্রিয় হয়ে উঠে এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
টি-সেল সরাসরি এবং বি-লিম্ফোসাইটের সহয়তায় রোগপ্রতিরোধে ও ভ্যাকসিনের কার্যকারিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর এ কারণেই একটা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা পরিমাপ করা হয় ভ্যাকসিনটির টি-সেল রেসপন্স ঘটানো এবং নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি তৈরি করার সামর্থের উপর। রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিনটিও এই দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়া প্রদর্শণ করেছে। সিনোভ্যাক কেন তাদের ভ্যাকসিনটির টি-সেল রেসপন্স পরীক্ষা করে দেখেনি তার কোনো ব্যাখ্যা তাদের পেপারে নেই। একটা খোঁড়া ভ্যাকসিনকে কেন তারা ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে নিতে চাচ্ছে তা বোধগম্য নয়। একটা ফেইজ-২ ট্রায়াল করতে সময় লাগে মাত্র ২ মাস। সিনোভ্যাকের উচিত তাদের ভ্যাকসিনটির ফেইজ-২ ট্রায়াল পুনরায় করে টি-সেল রেসপন্সের ব্যাপারটা উদঘাটন করা।
সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনটি একটি নিষ্ক্রিয়-ভাইরাস ভ্যাকসিন। এই ভ্যাকসিনে ল্যাবরেটোরিতে উৎপাদিত করোনাভাইরাসকে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় নিষ্ক্রিয় করে ফেলে তার সাথে মিশ্রিত করা হয়েছে অ্যালুমিনিয়াম হাইড্রোক্সাইড অ্যাডজুভেন্ট। ভ্যাকসিন তৈরির এ পদ্ধতিটি একটি প্রাচীন পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত ভ্যাকসিনের একটা সমস্যা হল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ধরনের ভ্যাকসিন অতটা কার্যকরী হয় না। বিভিন্ন ধরনের অ্যাডজুভেন্ট মিশিয়ে এই ভ্যাকসিনের কার্কারিতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করা হয় যা, সময়সাপেক্ষ।
বর্তমানে উপরোল্লেখিত বেশ কয়েকটি আধুনিক এবং কার্যকর ভ্যাকসিন ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে রয়েছে। এর ভেতর অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনটির ফেইজ-৩ ট্রায়াল প্রায় শেষের পর্যায়ে। তারা আশা করছেন, এই অক্টোবরেই তারা ভ্যাকসিনটি বাজারে নিয়ে আসতে পারবেন। অন্যদিকে মর্ডানা এবং জার্মানির বায়োন্টেক তাদের ভ্যাকসিন বাজারে আনার পরিকল্পনা করছে এ বছরের শেষে আথবা আগামী বছরের প্রথমেই। রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ও তাদের ফেইজ-৩ ট্রায়াল শুরু করছে মধ্যপ্রাচ্য এবং ল্যাটিন আমেরিকায়। সেক্ষেত্রে সিনোভ্যাকের মতো এত দুর্বল এবং আংশিক কার্যকর ভ্যাকসিনের বাংলাদেশে ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের যথার্থতাটা কি?
বাংলাদেশে যদি চীনের কোনো ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করতেই হয়, তবে তা করা উচিত ক্যানসিনোবায়োর ভ্যাকসিনটি দিয়ে। এই ভ্যাকসিনটি এখন তাদের ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য বিভিন্ন দেশে ধর্না দিচ্ছে। সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনটির ভবিষ্যত মোটামুটি অনিশ্চিত!
লেখক: ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম
এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি,
সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য।