প্রসবজনিত ফিস্টুলার কারণে নিগ্রহের শিকার হাজারো নারী
ফিস্টুলা রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি কম থাকলেও পরিবার ও সমাজে অবহেলার শিকার
প্রসবজনিত ফিস্টুলা সাধারণত বাধাগ্রস্ত প্রসবের কারণে হয়ে থাকে। তবে প্রসবজনিত ফিস্টুলা হওয়ার অন্যতম কারণ অল্প বয়সে বিয়ে, বিয়ের পরপরই গর্ভধারণ, পুরো গর্ভাবস্থায় চারবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করা।
ডক্টর টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছেন ঢাকা মেডিকেলের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. নাজমা হক।
তিনি বলেন, ফিস্টুলা রোগগুলোর মধ্যে প্রথম কারণ হচ্ছে প্রসবজনিত ফিস্টুলা। এছাড়া অপারেশন ত্রুটির কারণেও গাইনোকোলোজিক্যাল ফিস্টুলা হতে পারে।
অধ্যাপক ডা. নাজমা হক বলেন, প্রসবজনিত ফিস্টুলা সাধারণত হয় যে মায়েদের বাচ্চা প্রসব হতে সময় বেশি লেগে যায়। অর্থাৎ প্রসবে বাধা পেয়ে বাচ্চার মাথা দীর্ঘ সময় আটকে থেকে প্রসব থলির টিস্যুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় এবং রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে মুত্রথলিতে ক্ষতের তৈরি করে।
‘এই ক্ষত একসময় ছিদ্র হয়ে প্রস্রাব ঝরতে থাকে। সাধারণত মায়েদের দীর্ঘায়িত সন্তান প্রসবের পর আট থেকে নয় দিন পর মূলত এই ধরনের প্রস্রাব ঝরতে থাকে’ যোগ করেন তিনি।
এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, প্রসবের সময় মায়েরা সময়মতো হাসপাতালে চিকিৎসা না নিতে আসলে এ রোগের ঝুঁকি অনেকাংশেই বেড়ে যায়।
প্রসবজনিত ফিস্টুলার প্রাথমিক উপসর্গ হিসেবে চিকিৎসকরা বলছেন, যোনিপথে প্রস্রাব-পায়খানা ও দুর্গন্ধযুক্ত সাদা স্রাব বের হওয়া। যোনিপথের এবং প্রস্রাবের রাস্তায় বার বার সংক্রমণ হওয়া। শারিরীক সম্পর্ক স্থাপনের সময় ব্যথা অনুভব করা। ঘন ঘন পায়খানা হওয়া এবং পায়খানা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়া। এছাড়াও পায়ুপথের ভেতরের গ্রন্থিতে সংক্রমণের কারণে মলদ্বারের পাশে ফুলে ব্যথা সৃষ্টি করে।
দেশে কয়েক ধরনের ফিস্টুলা রোগী মধ্যে প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি কম থাকলেও পরিবার ও সমাজে অবহেলার শিকার হতে হয় প্রতিনিয়ত।
এদিকে কোভিডের কারণে ঢাকা মেডিকেলের ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টারে সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মতভাবে। সেন্টারটিতে ২০২০ সালে মাত্র ২২ জন রোগী সেবার আওতায় এসেছে। অথচ তার আগের বছরই সেবা নেয় ১৪৭ জন রোগী।
ঢাকা মেডিকেলের ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টারের দায়িত্বে থাকা প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নাসরিন আক্তার ডক্টর টিভিকে বলেন, করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টারে প্রতি বছরে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ রোগী সেবার আওতায় আসতো। কিন্তু করোনার তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় সেবা কার্যক্রম প্রায় বন্ধ।
তিনি বলেন, এ বছরের শুরুতে সেবাটি আবার চালু হলেও এখন তা বন্ধ রয়েছে। আর চলতি বছর সেবা নিয়েছে মাত্র ৬ জন ফিস্টুলা রোগী।
সমস্যা সমাধানে আগে থেকে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জোর তাগিদ দিয়ে ডা. নাসরিন আক্তার বলেন, আগে থেকে প্রতিরোধ করতে হলে প্রথমে আমাদের বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত ২০ বছরের আগে গর্ভধারণ না করা। তৃতীয়ত অবশ্যই পুরো গর্ভাবস্থায় চারবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
অধ্যাপক ডা. নাজমা হক বলেন, রোগ হওয়া থেকে মুক্তির জন্য এন্টিনেটাল চেকআপের সময়েই চিহ্নিত করে প্রয়োজনে হাসপাতালে সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করানো দরকার।
‘বাংলাদেশ ম্যাটারনাল মরটালিটি অ্যান্ড মরবিডিটি সার্ভে’(বিএমএমএস) জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট), আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)-এর ২০১৬ সালের যৌথ পরিসংখ্যান বলছে, দেশে মহিলাজনিত ফিস্টুলা রোগীর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এর সঙ্গে এক হাজার রোগী প্রতি বছর যোগ হচ্ছে নতুন করে। এসব রোগীদের দ্রুতই চিকিৎসার আওতায় আনার আহ্বান বিশেষজ্ঞদের।