কুমিল্লার শহীদনগর ট্রমা সেন্টারে দেড় যুগেও নেই স্বাভাবিক কার্যক্রম
কুমিল্লার শহীদনগর ট্রমা সেন্টারে দেড় যুগেও নেই স্বাভাবিক কার্যক্রম
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ কুমিল্লার বিভিন্ন সড়কে দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত চিকিৎসার লক্ষ্যে দেড় যুগ আগে দাউদকান্দি উপজেলায় প্রতিষ্ঠা করা হয় ২০ শয্যা বিশিষ্ট শহীদনগর ট্রমা সেন্টার। যদিও এখানে আহত ও পঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা এখনও করা হয়নি। দু’দফা উদ্বোধন হলেও চাহিদা মতো লোকবল নিয়োগ দেয়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম-যন্ত্রপাতি। বর্তমানে জ্বর ও সর্দি-কাশির চিকিৎসা দিয়ে কোনোমতে চলছে জোড়া তালি কার্যক্রম। অথচ এটি চালু থাকলে স্বল্প মূল্যে চিকিৎসেবা পেতো কুমিল্লা অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষ। সূত্রঃ বাসস।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মূলত রাজনৈতিক কারণে হাসপাতালটিকে অচল করে রাখা হয়েছে। তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ট্রমা সেন্টারটি পুরোপুরি চালু করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দাবি জানান তারা। অবশ্য কর্তৃপক্ষ বলছেন সরকার চাইলে এ ব্যাপারে নতুন করে উদ্যোগ নিতে পারে।
বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় সরেজমিনে গিয়ে ট্রমা সেন্টারটি বন্ধ পাওয়া গেছে। পরবর্তীতে আবাসিক কোয়ার্টারে গিয়ে জয়নাল নামের এক স্টাফের সাথে কথা বললে তিনি জানান, সেখানে আউটডোর সেবা চালু নেই। তাই দুপুরের পর কেউ থাকেন না।
পরবর্তীতে একমাত্র আবাসিক চিকিৎসক ডা. নাজমুল হাসান জানান, সেখানে শুধু এনেস্থেসিয়া ও মেডিসিন সেবা চালু রয়েছে। এক্স-রে ও আল্ট্রাসনোগ্রাফিসহ অন্য কোনো চিকিৎসা উপকরণ নেই। আর চব্বিশ ঘণ্টা ইনডোর সেবা চালু থাকার কথা থাকলেও জনবল সংকটে সম্ভব হচ্ছে না। তাই আবাসিকভাবে তিনি সেখানে থাকছেন না। তার দাবি বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও অবগত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ২০০১ সালে চার দলীয় জোট বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর একটি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা হিসেবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দির শহীদ নগরে একটি ট্রমা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে। মুলত তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ওই এলাকার এমপি হওয়ায় সেই দাবি আরও জোরালো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গণপূর্ত বিভাগের অর্থায়নে ৪ একর ৩৬ শতাংশ জায়গায় ৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ব্যয়ে এই ট্রমা সেন্টারটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। জোট সরকারের শেষ মুহূর্তে ২০০৬ সালের ৬ অক্টোবর এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তখন সীমিত জনবল ও চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে চালু হয় এর কার্যক্রম।
কিন্তু জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার মাস খানেক যেতে না যেতেই তখন সরকারের সময়ে অদৃশ্য কারণে বন্ধ হয়ে যায় চিকিৎসাসেবা। এ নিয়ে সমালোচনা ও পত্র-পত্রিকায় বিষয়টি তুলে ধরায় ২০১০ সালের ৩০ এপ্রিল দ্বিতীয়বারের মতো এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মহাজোট সরকারের তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ডা. আ. ফ. ম রুহুল হক এবং স্থানীয় এমপি মেজর (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়া। সে সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. রুহুল হক এক মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ ও যন্ত্রপাতি বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কথা রাখেননি। মাঝে ২০১৪ ও ১৮ সালের নির্বাচনেও এমপি নির্বাচিত হন সুবিদ আলী ভূঁইয়া। এলাকাবাসী একাধিকবার আবেদন করলেও তিনি কোনো উদ্যোগ নেননি। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি এমপি নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর। তিনিও এর দিকে নজর দেননি বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক জানান ড. মোশাররফ হোসেন প্রতিষ্ঠাতা হওয়ায় বৈষম্যের শিকার হয়েছে ট্রমা সেন্টারটি। অথচ এটি সচল থাকলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ কুমিল্লার গৌরীপুর-হোমনা-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর, গৌরীপুর-মতলব-চাঁদপুর ও ইলিয়টগঞ্জ-মুরাদনগর সড়কে আহত রোগীদের আর ঢাকায় রেফার করতে হতো না।
স্থানীয় সাতপাড়া এলাকার মনিরুজ্জামান বাহালুল বলেন- কুমিল্লার আলেখারচর বিশ্বরোড এলাকা থেকে দাউদকান্দির টোল প্লাজা পর্যন্ত অধিকাংশ এলাকাই দুর্ঘটনাপ্রবণ। বিশেষ করে শহীদনগর অংশটিতে বছরে একাধিক দুর্ঘটনার রেকর্ড রয়েছে। অনেক সময় আহত রোগীদের ঢাকায় নেয়ার পথেই প্রাণহানি ঘটছে। আবার অর্থাভাবে অনেকের পক্ষে ঢাকায় নেয়া সম্ভব হয় না। সেই বিবেচনা থেকেই এখানে ট্রমা সেন্টারের জন্য সরকারের আহ্বানে এলাকাবাসী নাম মাত্র মূল্যে জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলো। কিন্তু ট্রমা সেন্টারের সু-উচ্চ দু’টি ভবন হলেও নেই স্বাভাবিক কার্যক্রম।
ভাগলপুরে গ্রামের আফরোজা হেলেন জানান, এ হাসপাতালটিতে বর্তমানে পাঁচ টাকার টিকিট কেটে জ্বর ও সর্দি-কাশির ওষুধ ছাড়া আর তেমন কোনো চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় না। তিনি ট্রমা সেন্টারটিতে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিয়ে পুরোপুরি সচলের দাবি জানান।
দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. হাবিবুর রহমান জানান, হাসপাতালটিতে কনসালটেন্ট, আবাসিক চিকিৎসক, নার্স ও নিরাপত্তা-পরিচ্ছন্ন কর্মীসহ ২৫ জন জনবলের পদ থাকলেও রয়েছে মাত্র ১৫ জন। এর মধ্যে বেশিরভাগ কর্মরত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। মূলত প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও চিকিৎসা উপকরণ না থাকায় হাসপাতালটির এ অবস্থা বলে তার দাবি। তিনিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এটি সচল করার দাবি জানান।
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছেলে এবং দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মারুফ হোসেন অভিযোগ করেন শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ায় আমার বাবার প্রতিষ্ঠিত জনবান্ধব এ প্রতিষ্ঠানটির প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করেছে বিগত সরকার। তিনি শহীদনগর ট্রমা সেন্টারটি সচলের দাবি জানান।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. নাছিমা আকতার বলেন, ট্রমা সেন্টারটিতে আহত ও পঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা হোক তিনিও চান। তবে সীমাবদ্ধতার কারণে এতো দিন তা সম্ভব হয়নি। এটি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অবগত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।