ঢাকায় ঘরের বাতাসে মৃত্যুঝুঁকি বেশি: গবেষণা
রাজধানী ঢাকা শহর
ঢাকায় বাইরের বাতাসের চেয়েও বিপজ্জনক ঘরের ভেতরের বাতাস। বাইরের চেয়ে ঢাকার ঘরের বাতাসে মৃত্যুঝুঁকি বেশি রয়েছে বলে জানিয়েছেন বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্য গবেষক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত হোসেন। তাঁর নেতৃত্বে একদল গবেষকের যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর তালিকায় শীর্ষে থাকা ঢাকার বাহ্যিক বায়ু দূষণের পাশাপাশি গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি হুমকি। এই দূষণের ফলে শ্বাসযন্ত্রের রোগ, হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যানসার, কম ওজনের শিশু জন্মদান, মস্তিষ্ক বিকাশজনিত সমস্যা, মানসিক স্বাস্থ্য অবনতি এবং অপমৃত্যুর মতো গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে বায়ুদূষণ-সংবেদনশীল গ্রুপ- শিশু, বৃদ্ধ ও যাদের আগে থেকে শ্বাসযন্ত্র সম্পর্কিত রোগ, হৃদরোগ ও অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগ আছে।
‘স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার’-২০১৯ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণ বাংলাদেশের চতুর্থ প্রধান মৃত্যুঝুঁকির কারণ এবং এর ফলে প্রতি বছর ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। গৃহের ভেতরের বায়ুতে ক্ষতিকর পদার্থ জমা হওয়ার ফলে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ তারা বেশিরভাগ সময় ঘরের ভেতরে কাটায়।
আরো জানা যায়, অধ্যাপক ও Air Quality, Climate Change and Health (ACH) ল্যাবের প্রধান ড. সাখাওয়াত হোসেনের নেতৃত্বে পরিচালিত ‘Characterizing Indoor Air Quality and Identifying Factors Influencing Air Quality at Home Microenvironment in Dhaka City’ শীর্ষক একটি গবেষণা সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘ইন্ডোর ইনভাইরন্টমেন্টস’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত গবেষণায় ঢাকায় প্রথম বারের মতো ব্যাপকভাবে ৪৩টি গৃহের অভ্যন্তরে PM,দূষণের মাত্রা নির্ণয় করা হয়েছে এবং বায়ুমান উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, গৃহের গড় দূষণ মাত্রা ছিল ৭৫.৬৯ মাইক্রোগ্রাম/মিটার, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা থেকে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। কিছু গৃহে দূষণ মাত্রা ছিল ২০০ মাইক্রোগ্রাম/মিটারের বেশি, যা বাসিন্দাদের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্বের অনেক শহরের তুলনায় ঢাকার গৃহের বায়ু মান অনেক বেশি উদ্বেগজনক।
গবেষণায় দেখা গেছে, গৃহের অভ্যন্তরে বায়ুদূষণের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাইরের দূষিত বায়ুর প্রবেশ। ঘরের জানালা বা অন্যান্য ছিদ্র দিয়ে বাইরের দূষিত বায়ু অনুপ্রবেশ করে এবং অভ্যন্তরীণ বায়ুকে প্রভাবিত করে।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ঘরের ভেতরের বায়ু দূষণের প্রায় ৪০% বাইরের বায়ুর অনুপ্রবেশের কারণে ঘটে। দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে দীর্ঘ সময় ধরে রান্না করা। রান্নার সময় পিএম ২.৫-এর মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে যখন প্রতিবার রান্নার সময়কাল ১.৫ ঘণ্টার বেশি হয়।
এছাড়াও গবেষণায় উঠে এসেছে, যারা নিয়মিত ঘর পরিষ্কার করেন, তাদের ঘরের দূষণ তুলনামূলকভাবে কম থাকে। আরও একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাবক হলো গৃহের আয়তন। গবেষণায় দেখা গেছে, ১২০০ বর্গফুটের বেশি আয়তনের বাড়িতে দূষণের মাত্রা বেশি ছিল।
ড. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মানুষ তার দিনের প্রায় ৬০-৬৫% সময় ঘরের ভেতরে কাটায়। মানুষের দৈনন্দিন বায়ু দূষণের একটি বড় অংশ ঘরের ভেতরে শ্বাস নেওয়ার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। তাই গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ সম্পর্কে সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। আমরা সাধারণত বাহ্যিক দূষণ সম্পর্কে সচেতন থাকি, কিন্তু ঘরের অভ্যন্তরের দূষণ সম্পর্কে অনেকটাই অবহিত নই। যেহেতু ঘরের দূষণকে এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়, তাই দূষণ কমাতে উৎসগুলো চিহ্নিত করে তা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি বলেন, বাইরের দূষিত বায়ু ঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ভেতরে অবস্থানরত মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ায়। তবে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এই দূষণের অনুপ্রবেশ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘বিল্ডিং অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ জার্নালে প্রকাশিত আমার একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, জানালা বন্ধ রাখলে ঘরের ভেতরে বাইরের পিএম ২.৫ দূষণের প্রায় ৬৮ শতাংশ পর্যন্ত প্রবেশ বন্ধ করা যায়। ঘরের ভেতর এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করতে হবে। একটি গবেষণায় আমরা পেয়েছি, হেপা-ফিল্টারসহ এয়ার পিউরিফায়ার ঘরের ভেতরে পিএম ২.৫-এর দূষণ অনেক কমিয়ে দেয়।
গবেষক দলের অন্যতম সদস্য আফসানা ইয়াসমিন বলেন, উৎসগুলো আমরা এখন চিহ্নিত করতে পেরেছি। তাই যখন বাইরে দূষণের মাত্রা বেশি থাকে, তখন ঘরের জানালা বন্ধ রাখার মাধ্যমে বা এসি ব্যবহার করে বাইরের বায়ুর অনুপ্রবেশ রোধ করা যেতে পারে। এছাড়া রান্নার সময় রান্নাঘরের ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং ঘর নিয়মিত পরিষ্কার রাখা দূষণ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তিনি আরও বলেন, বাইরের দূষিত বায়ুর প্রবেশ রোধে ঘরে জানালা ও বায়ুচলাচল ব্যবস্থার উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি, যা ঘরের ভেতরের বায়ুমান উন্নত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। রান্নার সময় দূষণ কমাতে পরিবেশবান্ধব এবং উন্নতমানের চুলার ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত, যা বিশেষত নারীদের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে জনগণকে গৃহস্থালির বায়ু দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করতে ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। সর্বোপরি নীতি-নির্ধারকদের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং কার্যকর সমাধানমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ সমস্যার টেকসই সমাধান সম্ভব। গবেষক দলে আরও ছিলেন আফসানা ইয়াসমিন, ইমরান আহমেদ, মারিয়া হায়দার, মো. কামাল হোসেন এবং মোহাম্মদ আব্দুল মোতালেব।