স্বাস্থ্যসেবা পেতে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কমানো সম্ভব
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘স্বাস্থ্য খাতে বিদেশমুখিতা কমাতে দেশীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি’ বিষয়ক সেমিনার
স্বাস্থ্যখাতে দেশীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে চিকিৎসায় মানুষের বিদেশমুখিতা কমানো সম্ভব। শনিবার (২৩ নভেম্বর) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা এ পরামর্শ দেন। এ সময় বক্তারা বলেন, কম আত্মবিশ্বাস ও গ্রাহক সন্তুষ্টির অভাবে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার অভাব।
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী। বক্তব্য রাখেন বিএমডিসির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্টার ডা. মো. লিয়াকত হোসাইন, ঢাবির ইন্সটিটিউট অব হেলথ ইকোনোমিক্সের প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আব্দুল হামিদ, বিএসএমএমইউর প্রসূতি ও স্ত্রীরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল, বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিসিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্সের সেক্রেটারি অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মো. জামাল, বাংলাদেশ সোসাইটি অব ইমার্জেন্সি মেডিসিনের সেক্রেটারি জেনারেল ডা. মীর সাদউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি এবং সমরিতা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এবিএম হারুনসহ অনেকে।
মূল প্রবন্ধে ডিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী বলেন, স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশের মাথাপিছু ব্যয় ১১০ মার্কিন ডলার, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে ব্যয় হয় ৪০১ মার্কিন ডলার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ৩০ হাজার ১২৫ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের শতকরা মাত্র ৩.৭৮ ভাগ।
তিনি জানান, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতার কারণে দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী বিশ্বের অন্যান্য দেশের সেবা নিয়ে থাকে। ২০১২ সালে বিদেশে স্বাস্থ্য সেবা নেওয়ায় বাংলাদেশিদের ব্যয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
উন্নত স্বাস্থ্য সেবার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে অবকাঠমোর স্বল্পতা, দক্ষ ডাক্তার, নার্স ও টেকনিশিয়ানের অভাব, সরকারি হাসপাতলে সেবা প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা, উন্নত সেবার জন্য ইন্স্যুরেন্স কভারেজের অনুপস্থিতি প্রভৃতিকে কারণ হিসেবে তুলে ধরেন ডিসিসিআই সহ-সভাপতি। বিদ্যমান অবস্থা উত্তরণে স্বাস্থ্য খাতের রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ার সহজীকরণ, সরকারিভাবে সকলের জন্য স্বাস্থ্য সেবা ইন্স্যুরেন্সের আওতায় নিয়ে আসা, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট সহায়তা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, পিপিপি মডেলে ঢাকায় আন্তর্জাতিক হাসপাতালসমূহের কার্যক্রম শুরু, সহায়ক নীতি সহায়তা প্রদানের উপর জোরারোপ করেন মালিক তালহা ইসমাইল বারী।
সেমিনারে নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক এ কে খান আজাদ বলেন, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার স্বল্পতা, চিকিৎসা ব্যবস্থায় আস্থার স্বল্পতা, সর্বোপরি কমফোর্টের অভাবে অসংখ্য লোক দেশের বাইরে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছে, এগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিতকরণ ও সমাধানের মাধ্যমে রোগীদের বিদেশমুখিতা হ্রাস করা সম্ভব।
তিনি বলেন, যেহেত প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চিকিৎসাবিজ্ঞান সর্বদা পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া, ফলে বর্তমানে আমরা যা আমরা প্রত্যক্ষ করছি, আগামী ২৫ বছর পর এ ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। তাই সেরা প্রযুক্তিগত অগ্রগতি গ্রহণ করার জন্য আমাদের একটি সঠিক পাঠ্যক্রম থাকা জরুরি। দেশে পরিচালিত ল্যাবরেটরিগুলোর মান উন্নয়ন ও বাজেট সহায়তা বাড়ানোর মাধ্যমে চিকিৎসাশাস্ত্রের গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধি ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) শক্তিশালীকরনের উপর জোরারোপ করেন তিনি।
বিএমডিসির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্টার ডা. মো. লিয়াকত হোসাইন বলেন, বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা একটি কার্যকর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারি, যার মাধ্যমে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কমবে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ের মাধ্যমে রিজার্ভ বৃদ্ধি সম্ভব। উন্নত সেবা প্রদানে রোগীদের প্রতি ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিকতা পরিবর্তন একান্ত অপরিহার্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশীয় ডাক্তার ও নার্সদের দক্ষতা উন্নয়নের আন্তর্জাতিকমানের প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট স্থাপনের কোন বিকল্প নেই।
এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিদ্রত একটি মেডিকেল অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন ঢাবির ইন্সটিটিউট অব হেলথ ইকোনোমিক্সের প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। একই সাথে স্বাস্থ্য প্রশাসনকে দক্ষতার সাথে পরিচালনার জন্য সিভিল সার্ভিস থেকে বাদ দিয়ে পৃথক স্বাস্থ্য ক্যাডার এবং জুডিশিয়ারি সার্ভিস কমিশনের মতো স্বাস্থ্যসেবা কমিশন গঠনের উপর জোরারোপ করেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রসূতি ও স্ত্রীরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, আস্থা এই সেক্টরের উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাই আমাদের স্বাস্থ্যসেবাকে স্বাস্থ্যসেবা পর্যটনে রূপান্তর করতে হবে। বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে উন্নত স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের লক্ষ্যে গ্রামীণ পর্যায়ে আরও বেশি মানের হাসপাতাল স্থাপন করা উচিত বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিসিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্সের সেক্রেটারি অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মো. জামাল বলেন, বাংলাদেশ এখন ওষুধ উৎপাদনকারী দেশ। আমরা বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও করি, কিন্তু চিকিৎসাযন্ত্র উৎপাদনে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। এ খাতে আরও ভালো করতে হলে দক্ষ জনশক্তি ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে।
তিনি জানান, বাংলাদেশে এক লক্ষ ৩৪ হাজার চিকিৎসক রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৩৩ হাজার সরকারি চিকিৎসক। তবে এটা সন্তোষজনক যে, এখানে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১০ হাজারের বেশি বিদেশি মেডিকেল শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব ইমার্জেন্সি মেডিসিনের সেক্রেটারি জেনারেল ডা. মীর সাদউদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনা মহামারির সময় কেউ চিকিৎসা নিতে বিদেশে যায়নি। মহামারীর সে সময়ে আমরা পরিস্থিতি সামলাতে পেরেছি, এটা স্বাস্থ্যসেবা খাতে আমাদের সক্ষমতা প্রতিফলিত করে।
সেমিনারে বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি এবং সমরিতা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এবিএম হারুনসহ ঢাকা চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দসহ উপস্থিত ছিলেন।