ফ্যাসিবাদের সহযোগী দুর্নীতিবাজ ভিসি এখনও স্বপদে বহাল
সিলেটের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (ইনসেটে অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন)
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর থেকে দীর্ঘ ২ মাস ধরে অফিসে উপস্থিত না হলেও স্বপদে বহাল রয়েছেন সিলেটের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই ফ্যাসিস্ট সরকারের ছত্রছায়ায় নানা অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, দলীয়করণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি নিরীহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে তিনি। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভিসির পদত্যাগের দাবি তোলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায়- ‘সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পদে পদে উপাচার্যের অনিয়ম’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটিতে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজগুলোর পরীক্ষা চলাকালে কেন্দ্র পরিদর্শনের নিয়ম আছে। এর বিপরীতে প্রতিবার উপাচার্যের জন্য ৫ হাজার টাকা এবং বাকি সদস্যদের জনপ্রতি সাড়ে ৩ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্র পরিদর্শনে না গিয়েই অর্ধলক্ষাধিক টাকার বিল তুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে উপাচার্য এনায়েত হোসেনের বিরুদ্ধে।
সূত্রটি আরও জানায়, নার্সিং কলেজের পরীক্ষাকেন্দ্র পরিদর্শনের জন্য উপাচার্যের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি আছে। গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ১৩ বার কেন্দ্র পরিদর্শন দেখিয়ে উপাচার্য এনায়েত হোসেনের নামে ৬৫ হাজার টাকা বিল প্রস্তুত করা হয়। এর মধ্যে আয়কর বাদ দিয়ে ৫৮ হাজার ৫০০ টাকা উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগার থেকে তুলে নেন। কেন্দ্র পরিদর্শন না করেই এমন বিল তুলে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
পরিদর্শন কমিটির একজন সদস্য ছিলেন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ শিশির রঞ্জন চক্রবর্তী। তিনি তিনটি কেন্দ্র পরিদর্শন করেছিলেন। তিনি জানান, তিনি যখন তিনটি কেন্দ্র পরিদর্শন করেন, তখন উপাচার্য এনায়েত হোসেন সঙ্গে ছিলেন না।
সপ্তাহের চার দিনই অনুপস্থিত
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী অভিযোগ করেছেন, উপাচার্য হিসেবে এনায়েত হোসেনের সিলেটে সার্বক্ষণিক অবস্থান করার বিধান থাকলেও তিনি সপ্তাহে গড়ে চার দিন ঢাকায় থাকেন। সচরাচর তিনি মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকেন। বাকি সময় চক্ষুবিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক ঢাকায় চেম্বারে রোগী দেখেন। এর বাইরে তিনি যখন সিলেটে অবস্থান করেন, তখন এখানেও চেম্বারে রোগী দেখে থাকেন।
সিলেটে চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি এনায়েত হোসেনের ব্যক্তিগত চেম্বারে এক রোগী চিকিৎসা নেন। তিনিসহ এনায়েত হোসেনের আরেকজন নিয়মিত রোগী নিশ্চিত করেছেন, এনায়েত হোসেন ঢাকার একটি হাসপাতালে, সিলেট নগরের পূর্ব জিন্দাবাজার এলাকার কম্পিউটার অপটিক এবং সিলেটের দক্ষিণ সুরমার পাঠানপাড়া এলাকায় ইনক্লুসিভ আই হসপিটালে নিয়মিত রোগী দেখেন। উপাচার্য থাকা অবস্থায় এভাবে তাঁর চেম্বার করার বিষয়টি একেবারেই অনৈতিক।
দরপত্র প্রক্রিয়ায় নয়ছয়
একটি কোটেশন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দাপ্তরিক ভবনের মেরামতকাজের (সিভিল, স্যানিটেশন, বৈদ্যুতিক কাজ) জন্য আগ্রহী ঠিকাদারদের কাছ থেকে কোটেশন আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ওই কোটেশন আহ্বান করেন মেরামতকাজ সম্পাদন ও তদারকি কমিটির সভাপতি উপাচার্য এনায়েত হোসেন। কোটেশন জমাদানের শেষ তারিখ ছিল ১৮ ফেব্রুয়ারি। সর্বনিম্ন দরদাতা দেখিয়ে এ কাজটি দেওয়া হয় সিলেট নগরের বালুচর এলাকার মেসার্স আফরা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি পণ্য সরবরাহ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে।
একই সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আফরা এন্টারপ্রাইজ ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৩০০ টাকা দর দেখিয়ে কাজ পেয়েছিল। ভ্যাট ও আয়কর বাদে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ৫ লাখ ২৩ হাজার ৫১২ টাকার চেক পায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোষাধ্যক্ষকে এড়িয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়া চেক পাস হয় উপাচার্য এনায়েত হোসেনের স্বাক্ষরে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী চেকে কোষাধ্যক্ষ মো. শাহ আলমের স্বাক্ষর থাকার বিধান রয়েছে।
আফরা এন্টারপ্রাইজকে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজ দেওয়ার কাগজপত্র ঘেঁটে আরও জানা যায়, কোটেশন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবুল কালাম মো. ফজলুর রহমানকে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তবে এ কমিটির সভা কবে হয়েছে, সে তারিখ উপস্থিতি-কাগজে উল্লেখ ছিল না। এ ছাড়া তিন সদস্যবিশিষ্ট ওই উন্মুক্তকরণ কমিটির সভায় চেয়ারম্যান ছাড়া বাকি দুজনই অনুপস্থিত ছিলেন। ফলে সেই উপস্থিতি-কাগজে কমিটির চেয়ারম্যান ছাড়া সদস্যসচিব ও সদস্যের কোনো স্বাক্ষরও নেই।
এদিকে ২ লাখ ৯৯ হাজার ২৫০ টাকার সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে উদয়ন অফসেট প্রেস নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ১৯ হাজার কপি ‘পরীক্ষার মূল উত্তরপত্র’ সরবরাহ করার জন্য চলতি বছরের ৩ জুলাই কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এ-সংক্রান্ত কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ৩ জুলাই দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভা হয়। তবে সাত সদস্যবিশিষ্ট ওই কমিটির সভায় কেবল উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার উপস্থিত ছিলেন। বাকি সদস্যদের মধ্যে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. বদরুল ইসলাম, এমসি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. তৌফিক এজদানী চৌধুরী, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক প্রেমানন্দ দাস, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী জয়নাল আহমদ চৌধুরী এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আরিফ আহমদ অনুপস্থিত ছিলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির কোনো সভা আদতে ডাকা হতো না। সদস্য হিসেবে যাঁদের কমিটিতে রাখা হতো, তাঁদের পাশ কাটিয়ে উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতেন। এ কারণে দরপত্র মূল্যায়ন সভার বিষয়টি কাগজপত্রে থাকলেও বাস্তবে সদস্যদের ডাকা হতো না।
চাকরি নেই, তবু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে
বিশ্ববিদ্যালয়–সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরীর সময়ে ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ২২০ জনকে ছয় মাসের জন্য অস্থায়ীভাবে (অ্যাডহক) নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে মেয়াদ অনূর্ধ্ব ছয় মাস পর্যন্ত বাড়ানো হয়। নির্ধারিত সময় পূর্ণ হওয়ার পর তাঁদের চাকরি নিয়মিত না করে উপাচার্য নিজ ক্ষমতায় একাধিকবার তাঁদের অ্যাডহকে নিয়োগ দেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদিত পদ ছিল ১১২টি। এ অবস্থায় ইউজিসি অস্থায়ীভাবে আর কোনো নিয়োগ না দেওয়া এবং যেসব পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের চাকরির মেয়াদ আর না বাড়ানোর সুপারিশ করে।
ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরীর স্থলাভিষিক্ত হয়ে ভিসি অধ্যাপক ডা. এনায়েত হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেই অ্যাডহকে নিয়োগপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ছাড়া অন্য সবার বেতন–ভাতা বন্ধ করে দেন। একাধিকবার তাঁরা চাকরি স্থায়ীকরণের দাবি জানালেও ইউজিসির সুপারিশের দোহাই দিয়ে উপাচার্য তাঁদের চাকরি স্থায়ী করেননি। তবে এরপরও অ্যাডহকে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়মিত-অনিয়মিতভাবে অফিসে এসে দাপ্তরিক কাজে অংশ নিতে থাকেন। তাঁদের অনেককে দিয়ে উপাচার্য তাঁর নিজের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কাজ করিয়ে নিয়েছেন।
প্রতিষ্ঠাতা ভিসির আমলে অ্যাডহকে নিয়োগ পাওয়া কয়েকজন অভিযোগ করেন, বেতন–ভাতা না দিলেও উপাচার্য এবং রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দিয়ে অধ্যাপক ডা. এনায়েত হোসেন ঠিকই দাপ্তরিক কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের গোপনীয়তা রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ পদেও এমন অনেকে কাজ করছেন। অথচ দীর্ঘদিন ধরে কাগজপত্রে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী নন।
অ্যাডহকে চাকরির মেয়াদ না বাড়ালেও উপাচার্য কেবল ঘনিষ্ঠতার সুবাদে বিলাল আহমদ চৌধুরীকে সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত রেখেছেন। এ ছাড়া একইভাবে তিনি মো. মুহিতুর রহমান রনিকে উপাচার্যের পিএস পদে এবং রাজীব বৈদ্যকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে দায়িত্বে রেখেছেন। কাগজপত্রে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পদে না থাকলেও তাঁদের নামে একাধিক ভাউচারে জ্বালানি ক্রয়, গাড়ি মেরামত এবং আপ্যায়ন বাবদ কয়েক লাখ টাকার বিল তুলে নিয়েছেন।
আরও যত অভিযোগ
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপাচার্যের বিরুদ্ধে ডিন তহবিলের টাকা তছরুপ এবং স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের নানা অভিযোগ আছে। আগের উপাচার্যের আমলে আয়কৃত ডিন তহবিলের (মেডিকেল, নার্সিং ও ডেন্টাল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি বাবদ আয়) প্রায় সাড়ে ১২ লাখ টাকা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে জমা না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। এমনকি ডিন তহবিলের টাকার বিষয়টি তিনি ইউজিসি কিংবা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেও অবহিত করেননি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে উপাচার্য এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের মুঠোফোনে কয়েক দিন একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তিনি সাড়া দেননি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়েও আসছেন না। তাই তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।