বিশ্ব আলঝেইমার দিবস: সচেতনতা এবং সমর্থনের আহ্বান
বিশ্ব আলঝেইমার দিবস: সচেতনতা এবং সমর্থনের আহ্বান
আজ ২১ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব আলঝেইমার দিবস। প্রতি বছর এই দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আলঝেইমার এবং অন্যান্য ডিমেনশিয়া সম্পর্কিত রোগের প্রতি সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজন করা হয়। এবারের বিশ্ব আলঝেইমার দিবসের প্রতিপাদ্য “ডিমেনশিয়া জানুন, আলঝেইমারকে জানুন”। এই থিমের মাধ্যমে মেমোরির গুরুত্ব এবং এর সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। পরিসংখ্যান তথ্য বলছে সারা বিশ্বে ৫৫ মিলিয়ন মানুষ এই রোগে ভুগছে।
আলঝেইমার কী?
আলঝেইমার একটি মস্তিষ্কের রোগ যা স্মৃতি, চিন্তা এবং আচরণকে প্রভাবিত করে। এটি বয়সের সঙ্গে বাড়ে এবং সাধারণত ৬৫ বছরের পর ঘটে। রোগীর স্মৃতি হ্রাস, জ্ঞানীয় দক্ষতা কমে যাওয়া, এবং দৈনন্দিন জীবনের কার্যক্রমে সমস্যা সৃষ্টি করে। নিউরোলজিস্টদের মতে আলঝেইমার রোগ এক ধরনের বার্ধক্যজনিত ও সুস্পষ্ট কারণবিহীন স্নায়বিক অবক্ষয়মূলক রোগ। এটি হলো ডিমেনশিয়ার একটি সাধারণ রূপ ও মস্তিস্কের ক্ষয়জনিত রোগ। এই রোগে আক্রান্ত হলে মস্তিষ্কের কোষগুলো আস্তে আস্তে মারা যায়। সাধারণত ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে এই রোগ দেখা দেয়। আবার কোনো ক্ষেত্রে কম বয়সী মানুষের মধ্যেও এই রোগ হতে পারে। আলঝেইমার রোগ আক্রান্তরা প্রথমে সামান্য বিভ্রান্ত হয় এবং অনেক কিছু ভুলে যেতে শুরু করে।
আলঝেইমার কেন হয়?
আলঝেইমার রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ এখনও অজানা। তবে ধারণা করা হয়, আক্রান্ত ব্যক্তিদের এক ধরনের প্রোটিনের উৎপন্নের কারণে মস্তিষ্কের কোষ বা সেলের মৃত্যু হয় যার ফলে এই রোগ দেখা দেয়। পারিবারিক ইতিহাস অর্থাৎ অনেক সময় পরিবারের কেউ যদি এই রোগ হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আলঝেইমার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। জেনেটিক কারণেও আলঝেইমার হয় অর্থাৎ কিছু জিন আলঝেইমার রোগের সাথে যুক্ত রয়েছে। পূর্বে মস্তিষ্কে কোন আঘাত পেয়ে থাকলে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বিষণ্ণতা, ধূমপান, হৃদরোগের কারণেও অনেকে আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত হন।
আলঝেইমারের লক্ষণ
আলঝেইমার রোগ একটি দীর্ঘস্থায়ী চলমান অবস্থা। এর লক্ষণগুলি ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। আলঝেইমারের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে ভুলে যাওয়া। তবে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কিছু নির্দিষ্ট আচরণ এবং লক্ষণ প্রদর্শন করে যা সময়ের সাথে সাথে আরও খারাপ হয়। স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া, যেকোন সমস্যা সমাধানে অসুবিধা হওয়া বা সহজ সমস্যা সমাধান করতে না পারা, সময় বা স্থান সম্পর্কে দিশেহারা হয়ে পড়া, আক্রান্ত রোগীর দিন দিন স্বাস্থ্য কমে যাওয়া, এ ছাড়া মেজাজ এবং ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন, বন্ধু, পরিবার এবং প্রতিবেশিদের কাছে থেকে দূরে দূরে থাকা, একা থাকতে স্বাচ্ছন্দবোধ করা।
আলঝেইমারের চিকিৎসা
আলঝেইমার রোগের জন্য কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসা বা ওষুধ নেই। উপসর্গের উপর নির্ভর করে এই চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। প্রাথমিক থেকে মাঝারি আলঝেইমার রোগীর ক্ষেত্রে ডনেপেজিল (অ্যারিসেপ্ট) বা রিভাস্টিগমাইন (এক্সেলন) এর মতো ওষুধ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। এই ওষুধগুলি মস্তিষ্কে উচ্চ মাত্রার অ্যাসিটাইলকোলিন বজায় রাখতে সাহায্য করে যা মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষগুলিকে আরও ভালভাবে সংকেত পাঠাতে এবং গ্রহণ করতে সহায়তা করে। এ ছাড়া বিষণ্ণতা, ইনসোমিয়া, হ্যালুসিনেশনের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন রকমে ওষুধ ও চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে। যেমন- ঔষধ ছাড়াও জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে আলঝেইমারের চিকিৎসা করা হয়ে থাকে, প্রতিদিন পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়া, শান্ত পরিবেশে থাকা ও পর্যাপ্ত ব্যায়াম করা, সুষম, পুষ্টিকর খাদ্যাভাস বজায় রাখা।
আলঝেইমার নির্ণয় পদ্ধতি
আলঝেইমারের কোন প্রতিকার বা চিকিৎসা এখন পর্যন্ত নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া আলঝেইমার রোগের জন্য কোন নির্দিষ্ট পরীক্ষা নেই। মানসিক, শারীরিক, স্নায়বিক এবং ইমেজিং পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসক এই রোগ নির্ণয় করে থাকে।
সমাজের প্রভাব
বিশ্বব্যাপী ৫৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ আলঝেইমার এবং অন্যান্য ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। এই সংখ্যা আগামী দুই দশকে দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই রোগ কেবল আক্রান্ত ব্যক্তির উপরই নয়, বরং তাদের পরিবারের সদস্য এবং সমাজের উপরও বিশাল চাপ সৃষ্টি করে। যত বেশি আমরা এই রোগ সম্পর্কে জানব, তত বেশি আমরা আক্রান্তদের জন্য সমর্থন এবং সহানুভূতি প্রদর্শন করতে পারব।
সমর্থনের প্রয়োজন
আলঝেইমার রোগীর যত্ন নেওয়া একটি কঠিন কাজ। Caregivers বা যত্নশীলদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য এবং সমর্থন ব্যবস্থার প্রয়োজন। পরিবার এবং বন্ধুদের সহায়তা এবং সামাজিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতা রোগীদের সুস্থতা ও সামাজিকীকরণের জন্য অপরিহার্য।
বিশ্ব আলঝেইমার দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এবং সম্প্রদায় আজ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করছে। সেমিনার, কর্মশালা, এবং মেমোরি টেস্ট আয়োজন করা হচ্ছে, যেখানে সাধারণ মানুষ এই রোগ সম্পর্কে তথ্য এবং পরামর্শ পেতে পারবে। বিশ্ব আলঝেইমার দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের সকলের জন্য আলঝেইমার রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনতা বাড়িয়ে, তথ্য শেয়ার করে, এবং একে অপরকে সমর্থন করার মাধ্যমে আমরা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারি। আসুন, আজকের দিনে আমরা আলঝেইমার রোগী এবং তাদের পরিবারের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করি এবং একটি স্বচ্ছ, সহানুভূতিশীল সমাজ গড়ে তুলি।