দেশে উইলসন ডিজিজের নতুন ২টি মিউটেশন শনাক্ত
মঙ্গলবার (১৪মে) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) উইলসন্স রোগীদের জেনেটিক পরিবর্তন ও এর স্নায়ু উপসর্গ নিয়ে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হকসহ অন্যরা
দেশে উইলসন ডিজিজের নতুন ২টি মিউটেশন শনাক্ত করা হয়েছে। মঙ্গলবার (১৪মে) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) উইলসন্স রোগীদের জেনেটিক পরিবর্তন ও এর স্নায়ু উপসর্গ নিয়ে গবেষণার ফলাফল প্রকাশকালে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এ সময় বলা হয়, মূলত জেনেটিক ডিসঅর্ডারে কারণে শরীরে অতিরিক্ত কপার জমা হয়ে মস্তিস্ক এবং লিভারের ক্ষতিগ্রস্তকারী রোগ উইলসন ডিজিজ নিয়ে বিশদ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নিউরোলজি বিভাগ এবং এনাটমি বিভাগের যৌথ গবেষণায় নতুন ধরনের বিষয় উঠে এসেছে। এই রোগের চিকিৎসা টার্গেট জিন থেরাপির মাধ্যমে বিএসএমএমইউয়ে করা হচ্ছে বলে জানানো হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হক। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রোভিসি (একাডেমিক) অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, প্রোভিসি (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. মনিরুজ্জামান খান, মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. আবু নাসার রিজভী, বেসিক সাইন্স অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. আহমেদ আবু সালেহ্।
সভাপতিত্ব করেন নিউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া। প্রধান গবেষক হিসেবে ফলাফল উপস্থাপন করেন এনাটমি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. লায়লা আনজুমান বানু ও নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আহসান হাবিব হেলাল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ডা. মিল্টন হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জানানো হয়, উইলসন ডিজিজ একটি জেনেটিক ডিসঅর্ডার যাতে শরীরে অতিরিক্ত কপার জমা হয়। লক্ষণগুলি সাধারণত মস্তিস্ক এবং লিভারের সাথে সম্পর্কিত। লিভার সম্পর্কিত উপসর্গগুলির মধ্যে রয়েছে বমি, দুর্বলতা, পেটে তরল জমা হওয়া, পা ফুলে যাওয়া, ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া এবং চুলকানি। মস্তিস্ক সম্পর্কিত লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে কম্পন, পেশী শক্ত হওয়া, কথা বরতে সমস্যা, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন, উদ্বেগ এবং মনোবিকার ইত্যাদি।
ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. দীন মোঃ নূরুল হক বলেন, আন্তর্জাতিকমানের গবেষণার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় ফান্ড নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হবে। মানবদেহের জন্য কপারের যেমন গুরুত্ব রয়েছে আবার অতিরিক্ত কপার শরীরের জন্য ক্ষতিকর। উইলসন্স ডিজিজের মতো রোগ ও সমস্যা জেনেটিক পরিবর্তনজনিত হওয়ায় এই রোগ এড়াতে রক্তের সম্পর্কের নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বিবাহ না করাই উত্তম।
তিনি বলেন, কিছুদিন আগেই আমি উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়েছি। এটাকে আমি পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমি গবেষণা, শিক্ষা নিয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। ইতিমধ্যে একাধিকবার চিকিৎসক- গবেষকদের নিয়ে মিটিং করেছি। তাদেরকে গবেষণা কাজে মনোনিবেশ করতে বলেছি। উইলসন ডিজিজ মূলতঃ উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। এটি নির্দিষ্ট জিনের পরিবর্তনের ফলে ঘটে যা একটি প্রোটিন তৈরী করার মাধ্যমে শরীর থেকে অতিরিক্ত তামা অপসারন করে। এর ফলে শরীরে বিশেষত মস্তিস্ক, যকৃত এবং চোখে তামা জমা হয়। অতিরিক্ত তামা দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতিই উইলসন ডিজিজের উপসর্গগুলো তৈরী করে। পরিবারের একজনের মধ্যে যদি রোগটি শনাক্ত করা যায়, তখন অন্যান্য সদস্যদেরও পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্তের মাধ্যমে রোগ থেকে মুক্তি সম্ভব। এ রোগটি অবশ্যই পিতামাতা থেকে আসতে হবে। শুধু একজন থেকে আসলেই হবে না, মায়ের থেকেও আসতে হবে এমনকি বাবার থেকেও আসতে হবে। দুই জিন একত্র হলেই সন্তানের উইলসন ডিজিজ হয়। এজন্য আমাদেরকে অবশ্যই খালাতো, মামাতো এবং ফুফাতো বোনের সঙ্গে বিয়ে বন্ধ করতে হবে। তাহলেই এই রোগে আক্রান্ত কমে আসবে।
অনুষ্ঠানে এনাটমি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. লায়লা আনজুমান বানু জানান, গবেষণায় মোট রোগীর সংখ্যা ছিল ৫০ জন, এরমধ্যে পুরুষ ছিল ২৮ জন এবং মহিলা ছিল ২২ জন। তাদের ৬ জন রোগীর মধ্যে ৩টি মিউটেশন পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ২টিই বাংলাদেশে নতুন। তাদেরকে টার্গেট জিন থেরাপির মাধ্যমে বিএসএমএমইউয়ে চিকিৎসা চলছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রতি ত্রিশ হাজার জনে একজন উইলসন ডিজিস রয়েছে। সেই হিসেবে রোগীর সংখ্যা হবে ৬ হাজারের মত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত আমরা প্রায় ২০০ জনের চিকিৎসা দিয়েছি। কারও মধ্যে এই রোগটি শনাক্ত হলে তাকে আজীবন চিকিৎসা নিতে হয়। সঠিকভাবে চিকিৎসা নিলে সারা জীবন ভালো থাকার সুযোগ রয়েছে। চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেলে এ রোগের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তিনি বলেন, পরিবারের একজনের যদি রোগটি শনাক্ত হয়, তাহলে অন্যান্য সদস্যদের পরীক্ষার মাধ্যমে রোগটি দ্রুত শনাক্ত করা গেলে ঝুঁকিমুক্ত থাকা সম্ভব।
নিউরোলজি বিভগের অধ্যাপক ডা. আহসান হাবিব হেলাল বলেন, এই গবেষণায় নিউরোলজি বিভাগের মুভমেন্ট ডিসঅর্ডার ক্লিনিক এবং অন্তঃবিভাগ থেকে রোগীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রোগী থেকে ৩ মিলি লিটার রক্ত সংগ্রহ করে এনাটমি বিভাগের জেনেটিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে এবং এই ল্যাবে জেনেটিক এনালাইসিস করা হয়েছে। তিনি জানান, রোগীদের বয়স সীমা ছিল ৯ থেকে ৬০ বছরের ভেতরে। অধিকাংশ রোগী পাওয়া গেছে ৯ থেকে ৩০ বছরের ভেতরে এবং এর সংখ্যা ছিল ৪৩ জন। গবেষণায় প্রথম জেনারেশনের আত্মীয়দের মধ্যে আক্রান্ত ছিল ৭ জন। এই রোগের কারণে স্কুল ছাড়তে হয়েছে ২৬ জন বাচ্চাকে।
রোগীদের উপসর্গ প্রসঙ্গে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, আমরা যেই রোগীগুলো পেয়েছি, তাদের মধ্যে ভেতরে ঢোক গিলতে সমস্যা ছিল ২৭ জনের, হাত পায়ের কম্পন ছিল ২৮ জনের, হাত-পা শক্ত হয়ে যাওয়া ছিল ২১ জনের, অনিয়ন্ত্রিত ঘাড় মোচড়ানো সমস্যা ছিল ১৪ জনের, অনিয়ন্ত্রিত হাত পা মোচড়ানোর সমস্যা ছিল ১১ জনের, নৃত্যের মতো অনিয়ন্ত্রিত নড়াচড়া ছিল ৪ জনের। রোগটি কাদের হতে পারে, এমন প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, বাবা-মা দুজনেরই যদি এই রোগের জিন থাকে, তাহলে সন্তানও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এজন্য আমরা নিকটতাত্মীয়দের মধ্যে বিবাহ না করার পরামর্শ দিয়ে থাকি।
অনুষ্ঠানে উইলসন ডিজিজে আক্রান্ত হওয়া কয়েকজন রোগীর হাতে বিনামূল্যে ওষুধ তুলে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. দীন মোঃ নূরুল হক ।