কিডনি রোগ মহামারীর আকার ধারণ করতে পারে: বিএসএমএমইউ ভিসি
‘সুস্থ কিডনি সবার জন্য/ বৃদ্ধি পাচ্ছে ন্যায়সঙ্গত সেবার সমান সুযোগ আর নিরাপদ ও সর্বোত্তম ঔষধের অনুশীলন’ প্রতিপাদ্য নিয়ে বিএসএমএমইউয়ে বিশ্ব কিডনি দিবস -২০২৪ পালিত
দেশে কিডনি রোগী বৃদ্ধির হার এতই ব্যাপক যে অদূর ভবিষ্যতে এটা মহামারীর আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। তাঁর ভাষায়, বাংলাদেশে ১০ বৎসর পূর্বে কিডনী রোগীর সংখ্যা ছিল ৮০ লক্ষ থেকে ১ কোটি আর বর্তমানে এর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ কোটি। বৃদ্ধির হার এতই ব্যাপক যে অদূর ভবিষ্যতে এটা মহামারীর আকার ধারণ করতে পারে।
‘সুস্থ কিডনি সবার জন্য/ বৃদ্ধি পাচ্ছে ন্যায়সঙ্গত সেবার সমান সুযোগ আর নিরাপদ ও সর্বোত্তম ঔষধের অনুশীলন’ প্রতিপাদ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ডা. মিল্টন হলে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেন কিডনি বিভাগ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ভিসি অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। সভাপতিত্ব করেন কিডনি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম। বক্তব্য রাখেন ইউরোলোজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. তৌহিদ মো. সাইফুল ইসলাম দিপু, কিডনি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এএইচ এম হামিদ আহমেদ, অধ্যাপক ডা. কেবিএম হাদিউজ্জামান, সহযোগী অধ্যাপক ডা. ওমর ফারুক প্রমুখ।
অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে কম বেশী কিডনী রোগীর সংখ্যা ২.৫ কোটি (প্রায়)। এদের মধ্যে আকস্মিক কিডনী রোগীর সংখ্যা ২৫-৩০ হাজার এবং দীর্ঘ স্থায়ী কিডনী রোগীর সংখ্যা ৩৫-৪০ হাজার। বাংলাদেশে কিডনি রোগের চিকিৎসক রয়েছে ৩০০ জন।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ২টি কিডনীর প্রতিটিতে প্রায় ১০-১২ লক্ষ ছাকনি রয়েছে। মানুষ জন্ম গ্রহন করার ৬ সপ্তাহের মধ্যেই কিডনীর ছাকনি বা ফিল্টার মেমব্রেন পুরোপুরি তৈরী হয়ে যায়। অর্থাৎ কিডনী পুরোদমে কাজ শুরু করতে পারে এবং প্রতি ২৪ ঘন্টায় ২০০ লিটার রক্ত পরিশোধিত করে। এই পরিশোধিত রক্তের মধ্যে ১-৩ লিটার শরীরের বর্জ্য পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়া হয়। সুতরাং কোন কারণবশতঃ যদি এ ধরনের ফিল্টার বাঁধাপ্রাপ্ত হয় তখন আকষ্মিক বা দীর্ঘস্থায়ী কিডনী রোগ হতে পারে। কিডনীর কার্যকারিতা যাচাই করার জন্য রক্তে ক্রিয়েটিনিন নামক জৈব পদার্থ পরিমাপ করা যায় যার মাধ্যমে কিডনী কতটুকু কাজ করছে তা বোঝা যায়। একজন সুস্থ পুরুষ লোকের শরীরে ক্রিয়েটিনিন সাধারণভাবে ১.১ মিঃগ্রাঃ% এবং মহিলার ১.০ মিঃগ্রাঃ ১% হিসাবে স্বাভাবিক ধরা হয়। যদি এই ক্রিয়েটিনিন স্বাভাবিক এর উপরে ৩ মাস বা ততোধিক স্থায়ী থাকে তখন তাকে দীর্ঘস্থায়ী কিডনী রোগী হিসাবে সনাক্ত করা হয়। রক্তে ক্রিয়েটিনিন ছাড়াও প্রস্রাবে নির্দিষ্ট মাত্রার অধিক প্রোটিন বা এলবুমিন থাকলে দীর্ঘস্থায়ী কিডনী রোগ আছে বলে ধরা হয়। বাংলাদেশে এক সমীক্ষায় (৩ হাজার প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের উপর) দেখা গেছে যে, প্রায় শতকরা ১৮ ভাগ মানুষ দীর্ঘস্থায়ী কিডনী রোগে আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে ১১%, অস্ট্রেলিয়ায় ১৬% এবং আইসল্যান্ডে ১০% মানুষ দীর্ঘস্থায়ী কিডনী রোগে আক্রান্ত।
আকষ্মিক কিডনী রোগঃ হঠাৎ করে কোন কারণে যখন কিডনী তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তখন তাকে আকস্মিক কিডনী রোগ বলে। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কিডনীকে পুনরায় পূর্বের কর্মক্ষম অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় ।
আকস্মিক কিডনী রোগের কারণঃ ডায়ারিয়া, রক্তক্ষরণ, কিডনী প্রদাহ, তীব্র সংক্রমণ, আকষ্মিক হৃদরোগ, কিডনীর ক্ষতিকারক কিছু ঔষধ, মুত্রনালীর প্রতিবন্ধকতা।
লক্ষণ সমূহঃ প্রস্রাব কমে যাবে/বন্ধ হয়ে যাবে, শরীরে পানি আসবে ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিবে। এ অবস্থায় প্রয়োজনে ডায়ালাইসিস দেয়া লাগতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি কিডনী রোগঃ যখন কিডনীর কার্যকারিতা ৩ মাস বা ততোধিক সময় পর্যন্ত লোপ পেয়ে থাকে তখন তাকে দীর্ঘমেয়াদি কিডনী রোগ বলা হয়।
দীর্ঘমেয়াদি কিডনী রোগের কারণঃ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, নেফ্রাইটিস ও অন্যান্য। লক্ষণ সমূহঃ হলো বমি বমি ভাব, ক্ষুধা মন্দা, প্রথম দিকে ঘন ঘন প্রস্রাব, পরবর্তীতে কমে যাওয়া, ক্রমান্বয়ে দুর্বলতা বৃদ্ধি পাওয়া, রক্ত স্বল্পতা, ও শ্বাস কষ্ট ।
প্রতিরোধ করতে হলে ওজন নিয়ন্ত্রণ, ধূমপান পরিহার ও নিয়মিত ব্যায়াম, নিয়ন্ত্রিত প্রোটিনযুক্ত খাবার, ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, রক্তে চর্বির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ, ডায়ালাইসিস, কিডনী সংযোজন ইত্যাদি।
ডায়ালাইসিস ও কিডনী সংযোজন বিষয়ে বলা হয়, বর্তমান বিশ্বে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করে একজন রোগী ৫ থেকে ১৫ বছর এবং সফল কিডনী সংযোজনের মাধ্যমে ১০-১৫ বছর স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। নিয়মিত ডায়ালাইসিস বলতে সপ্তাহে ৩ বার ৪ ঘন্টা করে হেমোডায়ালাইসিস মেশিন এর মাধ্যমে চিকিৎসা করা বোঝায়। ঠিক তেমনি নিকট আত্মীয়ের কিডনী নিয়ে কিডনীপ্রতিস্থাপনকে কিডনী সংযোজন বুঝানো হয়। অবশ্য উন্নত বিশ্বে মৃত ব্যক্তির কিডনী নিয়ে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কিডনী সংযোজন করা হয়ে থাকে। নিকট আত্মীয় বলতে মা-বাবা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়েকে বুঝায়। অবশ্য স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে কিডনী সংযোজনের কোন বাধা নেই। কন্টিনিউয়াস এমুলেটরী পেরিটনিয়াল ডায়ালাইসিস এক ধরনের ডায়ালাইসিস যাতে রোগীর পেটের ভিতরে স্থায়ীভাবে একটি ক্যাথেটার সংযোজনের মাধ্যমে পেরিটনিয়াল ফ্লুইড ব্যবহার করে করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে ইহা হেমোডায়ালাইসিস এর চেয়ে অধিকতর সুবিধাজনক, যেমন বাসায় বসে করা যায়। যাদের হেমোডায়ালাইসিস দেয়া সম্ভব নয়, তাদের জন্য এটি একটি উৎকৃষ্ট পদ্ধতি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশে সিএপিডি এর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলছে।
অকেজো কিডনী রোগীর চিকিৎসা সম্পর্কে বলা হয়, ডায়ালাইসিস ও কিডনী সংযোজন ব্যয়বহুল চিকিৎসা পদ্ধতি। একজন কিডনী অকেজো রোগী যদি নিয়মিত হিমোডায়ালাইসিস করে তাহলে মাসে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়। সিএপিডি করলে মাসে খরচ হয় প্রায় ৪০ হাজার টাকা। উভয়ক্ষেত্রেই অন্যান্য ঔষধ খেতে হয়। কিডনী ট্রান্সপ্লান্ট অপারেশনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ঔষধ ও হাসপাতালে থাকা বাবদ ৩-৪ লাখ টাকা খরচ হয়। অপারেশনের পর ঔষধ বাবদ ১ম বছরে খরচ হয় প্রায় ১-১.৫ লাখ এবং পরবর্তীতে প্রতি বছর খরচ হয় ৫০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা এবং এই সমস্ত ঔষধ সারাজীবন নিয়মিত খেতে হয়।