শেখ হাসিনা কিডনি সুরক্ষা বীমা চালুর দাবি জানালেন অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ

ডক্টর টিভি রিপোর্ট
2024-03-09 18:28:37
শেখ হাসিনা কিডনি সুরক্ষা বীমা চালুর দাবি জানালেন অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ

ক্যাম্পস আয়োজিত ১৯তম গোলটেবিল বৈঠকে মূলপ্রবন্ধ পাঠ করেন আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কিডনি রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ

শীঘ্রই দেশে শেখ হাসিনা কিডনি সুরক্ষা বীমা চালু করার দাবি জানিয়েছেন কিডনি এওয়ারনেস মনিটরিং এন্ড প্রিভেনশন সোসাইটির (ক্যাম্পস) চেয়ারম্যান এবং আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কিডনি রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ। এরফলে কিডনি রোগীদের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হবে এবং সবাইকে চিকিৎসার আওতায় আনা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। 

শনিবার (৯ মার্চ) জাতীয় প্রেসক্লাবে ক্যাম্পস আয়োজিত ১৯তম গোলটেবিল বৈঠকে মূলপ্রবন্ধে এসব কথা বলেন তিনি। এবারের বৈঠকে মূল আলোচ্য বিষয় ছিল- ‘সবার জন্য কিডনি স্বাস্থ্য কিডনি চিকিৎসায় সমঅধিকার, অর্জনে করণীয়’।

কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুসারে, ২০৪০ সালের মধ্যে ৫০ লাখের বেশি কিডনি বিকল রোগী সংকটাপন্ন অবস্থায় চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করবে। বর্তমানে ৮৫ কোটির অধিক লোক দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। দুঃখজনক হলেও সত্য এরমধ্যে ৭৫ কোটি রোগী জানে না যে, মরণঘাতী কিডনি রোগ নীরবে তাদের কিডনি নষ্ট করে চলেছে। প্রতি বছর ১ কোটি ৩০ লাখ লোক আকস্মিক কিডনি বিকল রোগে আক্রান্ত হয়। এই রোগীদের ৮৫ ভাগই আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে। উন্নত দেশে কিডনি বিকলের চিকিৎসা করতে গিয়ে সরকার হিমশিম খাচ্ছে।

মূলপ্রবন্ধে অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ বলেন, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগীর হার শতকরা ১৬ থেকে ১৮ ভাগ। এর শেষ ধাপ হলো কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া। একবার কিডনি বিকল হয়ে গেলে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় কিডনি সংযোজন অথবা ডায়ালাইসিস। কিন্তু এই চিকিৎসা এতটাই ব্যয়বহুল যে, শতকরা ৯০ ভাগ কিডনি বিকলরোগী তা বহন করতে পারে না। তারা বিনা চিকিৎসায় কিংবা স্বল্প চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করেন। পক্ষান্তরে, কিডনি রোগের ব্যাপকতা, ভয়াবহতা, পরিণতি ও কারণ সম্পর্কে সচেতন হয়ে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব। 

সুস্থ জীবন ধারার প্রধান সোপান সম্পর্কে তিনি জানান,  ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম করা, পরিমিত স্বাস্থ্যসম্মত বা সুষম খাবার গ্রহণ, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, ধূমপান পরিহার করা, পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পান করা, তীব্র মাত্রার ব্যাথার ঔষধ পরিহার করা। তাছাড়া যারা ঝুঁকিতে আছেন যেমন যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ওজন বেশী, বংশে কিডনি রোগ আছে, যারা ধূমপায়ী, যারা তীব্র মাত্রার ব্যাথার ঔষধ খেয়েছেন, যাদের পূর্বে কোন কিডনি রোগের ঝুঁকি আছে তাদের বছরে অন্তত ২ বার প্রস্রাব ও রক্তে ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করে নেয়া উচিৎ। কেননা প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগ সনাক্ত করতে পারলে চিকিৎসার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে জানান অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ। 

তিনি আরও বলেন, কিডনি বিকলের চিকিৎসা সর্বাধিক ব্যয়বহুল। ফলে চিকিৎসা করতে গিয়ে পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। উন্নত দেশগুলোতে ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজন স্বাস্থ্য বীমার মাধ্যমে হয়। রোগীর পকেট থেকে দিতে হয় না। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আংশিক খরচ সরকার বহন করে থাকে।

তিনি ক্যাম্পসের স্লোগান ‘‘কিডনি রোগ জীবননাশা-প্রতিরোধই বাঁচার আশা’’ ঘরে ঘরে পৌছে দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। যাতে কিডনি রোগ প্রাথমিক অবস্থায় সনাক্ত করে চিকিৎসার মাধ্যমে মরণব্যাধি কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।  

বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, কিডনি সহ অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত দরিদ্র, সুযোগ বঞ্চিত  রোগীদের জন্য চিকিৎসা প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যবীমা চালু করা যেতে পারে। বাইরের অনেক দেশে তা আছে। যদিও আমাদের দেশে কিছু সীমাবদ্ধতা ও রয়েছে।

তিনি ক্যাম্পস এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদের প্রস্তাবিত “শেখ হাসিনা কিডনি সুরক্ষা বীমা” প্রকল্পকে ভাল আইডিয়া বলে মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলার প্রতিশ্রুতি দেন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ। 

তিনি বলেন, সরকার গণমানুষের কল্যাণে অব্যাহতভাবে নানাবিধ কর্মসূচী গ্রহন করে যাচ্ছে। যেমন- বিনামূল্যে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ইনস্যুলিন সরবরাহ ও উচ্চ রক্ত চাপের ২/১টি ঔষধ বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। 

অধ্যাপক ডা. এ বিএম আবদুল্লাহ আরও বলেন, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ থেকে কিডনির সমস্যা হওয়ার আশংকা প্রবল। সবগুলোই নীরব ঘাতক। অথচ একটু সচেতন হলেই রোগগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব।

প্রতিরোধ করেই রোগ কমিয়ে আনার উপর গুরুত্বারোপ করেন জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ। তিনি বলেন, মানুষ হয়ত কথা শুনতে বা মানতে চায় না, তবে কিভাবে বললে শুনবে সেই প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। ফলে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে আর রোগের হার কমে আসবে।

তিনি বলেন, তামাকের ব্যাবসা বা চাষ যারা করে তারা সমাজের শত্রু, তবে তারা অনেক চতূরতার সাথে মানুষকে এ ক্ষতিকর জিনিসটির প্রতি আকৃষ্ট করে থাকে। 

অধ্যাপক ডা. আজাদ বলেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা বীমার পাশাপাশি কমপ্রিহেনসিভ হেলথ কেয়ারের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ নিশ্চিত করারও পরামর্শ দেন তিনি।

অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, দেশে কিডনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, ডায়ালাইসিস সেন্টার সহ কিডনি চিকিৎসার সুযোগ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই যৎসামান্য তাই দেশের কিডনি চিকিৎসার চিত্র খুবই হতাশাব্যঞ্জক। যদি দেশে একসাথে ৪০ থেকে ৫০ হাজার রোগীর কিডনি বিকল হয়ে যায়, তখন যে দূর্যোগ তৈরি হবে- তা সামাল দেয়ার সামর্থ কোথায়? এটিকে মাথায় রেখে প্রস্তুতি গ্রহন করতে হবে।

তিনি বলেন, দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা প্রাপ্তিতে সমঅধিকারের কথা ইউনিভারসাল হেলথ কাভারেজ এর প্রিনসিপালে উল্লেখ আছে। স্বস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচীতে কার্ডের মাধ্যমে সেবা দেয়ার অধিকতর সুযোগ সৃষ্টি হবে।

তিনি জোড় দিয়ে বলেন, কিডনি চিকিৎসা সম্প্রসারণর ডায়ালাইসিস সেন্টার বৃদ্ধি খুবই জরুরি। তাই হাসপাতাল বা ক্লিনিক এর সাথে নয় বরং পৃথক হেমো-ডায়ালাইসিস সেন্টারের লাইসেন্স প্রদানের ব্যাপারে নীতি প্রনয়ন করতে হবে। কারণ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে কমিউনিটি ডায়ালাইসিস সুবিধা বিদ্যমান।

কিডনি রোগকে ‘নীরব দুর্যোগ’ বলে উল্লেখ করে কিডনি ফাউন্ডেশন এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন উর রশিদ বলেন, এ রোগের জটিলতা ও চিকিৎসা ব্যয়ের আধিক্য বিবেচনায় প্রতিরোধকেই একমাত্র অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।

গাজী আশরাফ হোসেন বলেন, বিশেষ করে বাচ্চাদের এবং যুব সমাজের মাঝে যাতে কিডনি রোগ প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য নিয়মিত খেলাধুলা, নিয়মিত হাঁটা ও ব্যয়াম করার ব্যবস্থা নিতে হবে। কঠিনভাবে তাদের ফাষ্টফুড, জাঙ্কফুড, অলসতার প্রবণতা থেকে মুক্ত করতে হবে।

ক্যাম্পস এর নির্বাহী পরিচালক রেজওয়ান সালেহীন বলেন, ক্যাম্পস কিডনি রোগ প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত সচেতনতার বাণী প্রচার করে যাচ্ছে। আমরা যদি কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলি তা হলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই সরকারী ও বেসরকারী পর্যায় থেকে যদি সকলে এগিয়ে আসেন তা হলে এই রোগ নিরাময় করা অনেকটাই সহজ হবে। গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত সকল আলোচকদের তাদের মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য ক্যাম্পস এর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন তিনি।

এ গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা অভিমত ব্যাক্ত করেন যে, চিকিৎসা করে নয় বরং প্রতিরোধ করেই এ রোগের প্রাদূর্ভাব প্রশমন করতে হবে আর এ জন্য সচেতনতাই একমাত্র উপায়। কিডনি রোগ প্রতিরোধে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে ক্যাম্পস এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রশংসা করেন এবং বিত্তবানদের এমন মহৎ কাজে সহযোগীতার আহবান জানান।

এ ছাড়াও গোলটেবিল বৈঠকে দেশের সরকারী পর্যায়ের নীতি নির্ধারক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিল্পী, শিক্ষাবিদ, ক্রীড়াবিদসহ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।


আরও দেখুন: