অক্সফোর্ডের গবেষক বাংলাদেশি ডা. জাকিউল হাসান
অক্সফোর্ডের গবেষকদের মধ্যে বাংলাদেশের ডা. জাকিউল হাসান
মেডিকেল ভর্তি কোচিং করতে গিয়ে ভালো একজন বন্ধু পেয়ে যান জাকিউল হাসান। পড়াশোনা থেকে ব্যক্তিজীবন—কত কিছু নিয়েই না আলোচনা করতেন তাঁরা। দেখতে দেখতে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা হয়ে গেল। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) পড়ার সুযোগ পেলেন জাকিউল। আর বন্ধুটি ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে। দুজন হয়ে গেলেন দুই শহরের বাসিন্দা। দিনে দিনে পড়াশোনার চাপ বাড়ল। তারপর যোগাযোগও অনিয়মিত হয়ে পড়ল। একটা সময় সেই যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেল।
২০১২ সালে হঠাৎ কাকতালীয়ভাবে সেই বন্ধুর খোঁজ পেলেন জাকিউল। জাকিউল তত দিনে ইন্টার্ন শেষ করে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি) যোগ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) অর্থায়নে সংক্রামক রোগের ওপর দুই বছরের ফেলোশিপ করার সুযোগও পেয়েছেন। মার্কিন গবেষক অধ্যাপক ড. স্টিভ লুবি এবং ড. এমিলি গার্লির নেতৃত্বে একটি দল তখন নিপাহ ভাইরাসসহ নতুন সংক্রামক রোগ নিয়ে গবেষণা করছিল। সেই দলে যোগ দিলেন জাকিউল। দলটি ফরিদপুর মেডিকেলে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত একজন রোগীর মৃত্যু নিয়ে গবেষণা করছিল। এই রোগী ছিলেন একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক। নিপাহ আক্রান্ত তিন শিশুকে সেবা দিতে গিয়ে ২০১০ সালে এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মারা যান তিনি। নিপাহ ভাইরাস যে এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তিতে ছড়াতে পারে, সেটাও এই প্রথম জানতে পারেন জাকিউল। এরপর মৃত চিকিৎসক সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে গিয়ে ভেতরটা কেঁপে উঠল। রোগী আর কেউ নন, জাকিউলের কোচিং জীবনের সেই বন্ধু।
বন্ধুর অকাল মৃত্যু তাঁর মধ্যে গভীর বেদনার সৃষ্টি করল। অনুভব করলেন, এই ভাইরাস নিয়ে গবেষণা যদি সফল হয়, যদি ওষুধ বা প্রতিষেধক আবিষ্কারে কাজ করা যায়, তাহলে অনেক মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব।
তিনি বলছিলেন, ‘সংক্রামক ব্যাধির ঝুঁকি কমাতে এবং এ থেকে মানুষকে রক্ষা করতে গবেষণার কাজে বরাবরই আগ্রহ ছিল। তবে বন্ধুর অকাল মৃত্যুর খবর আমাকে এ কাজে আরও আগ্রহী করে।’ ২০১২ সালে নিপাহ গবেষক দলের তত্ত্বাবধানে প্রথম গবেষণার কাজ শুরু করেন। দেখেন কীভাবে এই ভাইরাস হাসপাতালে রোগী এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের সংক্রমিত করে। তাঁর সে গবেষণাপত্রটি পরে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় সিডিসি আয়োজিত ইমারজিং সংক্রামক ব্যাধি সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয়। মর্যাদাপূর্ণ এই সম্মেলন গবেষণাপত্র উপস্থাপনের সময় নিপাহ সংক্রমিত হয়ে বন্ধুকে হারানোর গল্পটাও বলেছিলেন জাকিউল। তাঁর সে গল্প শুনে দেশি-বিদেশি গবেষকেরাও বেদনাবিধুর হয়ে পড়েন।
নিপাহ ভাইরাস নিয়ে তাঁর গবেষণাটি শেষ হয় তিন বছর পর। পরে সিডিসির ইমারজিং ইনফেকশাস ডিজিজেস জার্নালে সেটি প্রকাশিত হয়।
২০১৯ সাল পর্যন্ত জাকিউল আইসিডিডিআরবির ইমারজিং ইনফেকশন প্রোগ্রামের অধীন গবেষণার কাজ চালিয়ে যান। জাকিউল বলেন, ‘আমার গবেষক হিসেবে গড়ে ওঠার যে স্বপ্ন, সেখানে আইসিডিডিআরবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এখানেই বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের অধীন সংক্রামক রোগ গবেষণায় আমার হাতেখড়ি। এই সময় আমি হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল, ইম্পিরিয়াল কলেজ লন্ডন এবং ইউরোপিয়ান সেন্টারে ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোলসহ সংক্রামক রোগের ওপর আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছি; স্বর্ণপদকসহ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছি।’
অক্সফোর্ডে করোনা নিয়ে গবেষণা
২০২০ সালে যুক্তরাজ্য সরকারের মর্যাদাপূর্ণ চিভনিং স্কলারশিপ পেয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতামূলক একটি মাস্টার্স কোর্সে পড়ার সুযোগ পান জাকিউল। এ সময় ক্লাসে প্রখ্যাত দুজন গবেষকের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। একজন করোনার টিকা গবেষণার নেতৃত্ব দেওয়া অধ্যাপক সারা গিলবার্ট, অন্যজন করোনার ওষুধ গবেষণার নেতৃত্ব দেওয়া অধ্যাপক স্যার পিটার হর্বি। অক্সফোর্ডের করোনার টিকার কথা সবারই জানা। কোভিড-১৯ মহামারির ওষুধ এবং টিকা গবেষণার নেতৃত্ব দেওয়া দলের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান জাকিউল। মহামারির ভয়াবহতা ঠেকাতে এই দলের দিন–রাত কাজের একাগ্রতা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে। জাকিউল তাঁর মাস্টার্সের ডেসার্টেশন (গবেষণামূলক দীর্ঘ নিবন্ধ) এই দলের সঙ্গে করার সুযোগ পান। বিশ্বের ৬২ দেশের ১ হাজার ৫৫৯টি হাসপাতালের ৭ লাখ করোনা রোগীর মৃত্যুহার নিয়ে ছিল তাঁর মাস্টার্সের গবেষণা।
২০২১ সালে মাস্টার্স শেষ করেন তিনি। কৃতিত্বপূর্ণ ফলের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নুফিল্ড ডিপার্টমেন্ট অব মেডিসিন পুরস্কার পান। মাস্টার্স শেষ করার পর আবার দেশে ফিরে আসেন। আইসিডিডিআরবিতেই কাজ শুরু করেন। অক্সফোর্ডের গবেষক দলের সঙ্গে জাকিউলের যোগাযোগটা রয়েই যায়। সেই সম্পর্কের সূত্র ধরেই পরে দলটির সঙ্গে নিপাহ ভাইরাস গবেষণার জন্য যোগাযোগ শুরু করেন। গবেষক দলকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। এর মধ্যে ভবিষ্যতের মহামারি হুমকি শনাক্ত এবং মোকাবিলার লক্ষ্য নিয়ে অক্সফোর্ডে গড়ে ওঠে প্যানডেমিক সায়েন্সেস ইনস্টিটিউট। এই ইনস্টিটিউট নিপাহ ভাইরাসের টিকা এবং ওষুধ গবেষণায় বাংলাদেশকে সহায়তা করতে শুরু করে। সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণার কাজের সঙ্গে যুক্ত হন এই গবেষক।
নিপাহ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই
২০২২ সালে পূর্ণ বৃত্তিসহ প্যানডেমিক সায়েন্স ইনস্টিটিউটে পিএইচডি গবেষণার সুযোগ পান জাকিউল হাসান। এই গবেষণায় তাঁর তত্ত্বাবধায়ক ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক স্যার পিটার হর্বি। কীভাবে প্রাণঘাতী নিপাহ ভাইরাসের জন্য একটি কার্যকর ওষুধ পাওয়া যায় আর আক্রান্তদের মৃত্যুহার কীভাবে কমানো যায়, এই ছিল জাকিউলের গবেষণার বিষয়। সফল হলে এটি যেমন আক্রান্ত রোগীদের জীবন বাঁচাতে সহায়তা করবে, তেমনি ভবিষ্যতের অতিমারির জন্য প্রস্তুত থাকতেও সহায়তা করবে। বর্তমানে নিপাহ ভাইরাস নিয়ে যে কাজ হচ্ছে, তার একটি দিক হচ্ছে টিকা তৈরি, আরেকটি দিক হচ্ছে ওষুধ আবিষ্কার। তাঁর কাজ মূলত ওষুধ তৈরিতেই বেশি ভূমিকা রাখবে। এই ওষুধ নিয়ে কাজ করা গবেষক দলের অন্যতম সমন্বয়কও জাকিউল।
গত সপ্তাহে বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজ জার্নালে জাকিউলের প্রথম পিএইচডি গবেষণাপত্র প্রকাশ পেয়েছে। যেখানে নিপাহ ভাইরাস মোকাবিলায় ওষুধ গবেষণা, উৎপাদন এবং আক্রান্তদের কাছে পৌঁছানোর একটি বিস্তৃত কাঠামো প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকাভুক্ত প্রাণঘাতী সংক্রামক ব্যাধিগুলোর একটি নিপাহ ভাইরাস। জাতিসংঘের এই সংস্থার আশঙ্কা, ভবিষ্যতে মহামারি আকার ধারণ করতে পারে নিপাহ ভাইরাস। এ জন্য ওষুধ এবং টিকা প্রস্তুত করা খুব জরুরি। এমন শঙ্কার মধ্যে আশার খবর, প্যানডেমিক সায়েন্স ইনস্টিটিউট করোনার টিকার উদ্ভাবক অধ্যাপক সারা গিলবার্টের নেতৃত্বে নিপাহ ভাইরাসের একটি নতুন টিকা প্রস্তুত করেছে। এখন অক্সফোর্ডে মানবদেহে এর পরীক্ষা শুরু হয়েছে। নিরাপদ এবং কার্যকর প্রমাণিত হলে এটি মারাত্মক নিপাহ ভাইরাস রোগ মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।
বড় বড় রোগের গবেষণা ধনী দেশগুলোয় হয়। এসব রোগের প্রতিষেধক এবং চিকিৎসা আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও এগিয়ে থাকে এসব দেশ। অনেক ক্ষেত্রে দরিদ্র দেশগুলোর নাগালের বাইরে থেকে যায় এসব প্রতিষেধক। জাকিউলের চেষ্টা, রোগের চিকিৎসায় প্রতিষেধকের সমবণ্টন যেন হয়। সেখানে যেন ন্যায্যতা থাকে। তরুণ এই গবেষক বলছিলেন, ‘আমার স্বপ্ন নিপাহসহ আরও যেসব মরণঘাতী সংক্রামক রোগ আছে, সেসব মোকাবিলায় আমাদের গবেষণার সক্ষমতা অর্জন। যাতে ভবিষ্যতে আমরা করোনা মহামারির মতো ভয়াবহতা এড়াতে পারি। পাশাপাশি গবেষণার সুফল বণ্টন যাতে ন্যায়সংগত হয়। অতীতের মহামারিতে দেখা বৈষম্য এড়াতে পারি, তার জন্য কাজ করাই আমার লক্ষ্য।’