বাংলাদেশে থাকলেও মনটা পড়ে আছে গাজায়: বিবিসি বাংলাকে দুই ফিলিস্তিনী মেডিকেল শিক্ষার্থী
বাংলাদেশের অধ্যয়নরত গাজার দুই মেডিকেল শিক্ষার্থী
সত্যি বলতে শারীরিক আমি বাংলাদেশে থাকলেও মনটা পড়ে আছে ফিলিস্তিনের গাজায়। বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত ফিলিস্তিনের গাজার অধিবাসী ইব্রাহিম সেলিম কিশকো। তিনি জানান, বাবা-মাসহ তার পরিবার-পরিজন গাজায় বসবাস করতেন। ৩০ অক্টোবরের ইসরাইলি হামলায় তার বেশ কয়েকজন স্বজন নিহত হন। এরমধ্যে গাজার সঙ্গে কোনভাবেই সংযোগ করতে পারছেন না।
বলেন, আমার এক প্রতিবেশির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া পোস্ট থেকে জানতে পারি যে, আমরা যেখানে থাকতাম সেই এলাকায় বোমা হামলা হয়েছে। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, এটা কি আমাদের বাড়ির ওখানে? আমি তখন প্রচন্ড এক ধাক্কা খেয়েছি। খবর না জেনে একদিন কাটানোও আমার জন্য কঠিন ছিল। এমনকি হামলায় কে কে মারা গেছেন- সেটা ভেবে সারারাত ঘুমাতে পারি নাই।
আরেক ফিলিস্তিনী শিক্ষার্থী ইসহাক নামুরা। তিনি পড়ালেখা করছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে। তাঁর পরিবারও থাকতো গাজার পশ্চিম উপত্যকায়। বিবিসি বাংলাকে বলেন, যুদ্ধ শুরু প্রথম কয়েকদিন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে টেবিলে বসেছি। কিন্তু কোন কিছুই পড়তে পারিনি। আমি কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। যখনই মোবাইল ফোনের রিংটনের শব্দ শুনেছি, ছুটে গিয়েছি। কারণ আমি জানি না, ওপাশ থেকে কি খবর আসবে?
যোগাযোগ কঠিন হওয়ায় সপ্তাহে একদিন পরিবারের সাথে যোগযোগ করতে পারেন ইব্রাহীম। এখন পর্যন্ত তারা ভাল আছেন। কিন্তু আপনারা জানেন, সেখানকার পরিস্থিতি এখন অনেক খারাপ। এমনকি যারা মোটামুটি নিরাপদে আছেন তারাও পুরোপুরি ভাল নেই। কারণ বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে জরুরি খাবারটাও তারা সহজে পাচ্ছেন না।
অপর মেডিকেল শিক্ষার্থী ইসহাক বলেন, আমি আসলে কিছু ঠিকমত করতে পারছিলাম না। একদম মূল যে কাজ, তা-ও না। পানি পান করতে গেলেও- ওখানে যারা পানি পাচ্ছেন না, তাদের কথা মনে হয়েছে। এমনকি বাইরে গেলেও মনে হয়েছে- আমি এখানে নিশ্চিন্তায় বাইরে যেতে পারছি। অথচ, তারা নিজ বাড়িতে থেকেও প্রাণের ভয়ে আছেন। এই বিষয়গুলো আমাকে খুব আহত করেছে। অনেক সময় আমি এসব সহ্য করতে পারিনি। আমি বসে বসে শুধু ফোনে খবর দেখেছি, আর কেঁদেছি।
ইব্রাহীম কিশকো বলেন, কখনো কখনো পরিবারের সবাইকে ছেড়ে এখানে আমার একাকী নিরাপদ থাকাটাকে অপরাধ বলে মনে হয়। মনে হয়, আমার তো মাথার ওপর ছাদ আছে। নিয়ম করে খাবার খাচ্ছি। এই ভাবনাগুলো আমার খাওয়াকেও কঠিন করে তোলে। আমার খাবারের জন্য ক্ষুধা, কিংবা ঘুমানোর ইচ্ছাও জাগে না। আমি শুধু কল্পনা করেছি যে, আমি সেখানে আছি। এক কথায় আমার নিজেকে, কল্পনায় গাজাতে আর বাস্তবে ঢাকায় মিলাতে খুব কঠিন হয়ে গেছে। এ কারণে আমার অপরাধবোধ জন্ম নিচ্ছে। কারণ আমি এখানে নিরাপদে আছি। অথচ, আমার পরিবার নিরাপদে নেই। আর আমরা তাদের জন্য কোন কিছুই করতে পারছি না।
ইব্রাহীম কিশকো আরও বলেন, পরিকল্পনা ছিল- আমি পরীক্ষা দিচ্ছি। পরীক্ষা শেষ হলেই গাজায় ফিরবো। আমার দেশে যাব। পরিবারের সঙ্গে দেখা করবো। আমি এসবই পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম। আমি সেখানে আমার সব বন্ধুদের সাথে কথা বলে রেখেছিলাম। যুদ্ধের কারণে এখন সবকিছু উলোট-পালট হয়ে গেছে। আমি সেখানে আর যেতে পারবো না। আমার মনে হয়, আমি যেন এখানে আটকে গেছি। আমার পুরো এলাকা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন আমি সেখানে গেলে আমার বাড়িটাও চিনতে পারবো না। গাজার প্রায় ৭০ শতাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।
এই মুহুর্তে আমাদের পরিবার হামলার মধ্যে রয়েছে। তাই আমাদের পক্ষে দূর থেকে যা করা সম্ভব তাই করছি। কেবল ডাক্তার হয়ে ফিরতে পারলেই আমার পরিবার, স্বজন, গাজা ও ফিলিস্তিনের জন্য কিছু করতে পারবো বলে জানান ইব্রাহীম কিশকো।