মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন চিকিৎসক-নার্স

ডক্টর টিভি রিপোর্ট
2023-09-10 12:40:46
মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন চিকিৎসক-নার্স

ট্রেনের কামরাকে অপারেশন থিয়েটার বানিয়ে ফেললেন চিকিৎসক ও নার্স

ট্রেনের কামরাকে অপারেশন থিয়েটার বানিয়ে ফেললেন চিকিৎসক ও নার্স। সম্প্রতি (৩ সেপ্টেম্বর, রোববার রাতে) ঢাকা-চিলাহাটীগামী আন্তঃনগর চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনে এ ঘটনা ঘটে। ট্রেনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়া নারীর মৃত বাচ্চা প্রসব করান ট্রেনযাত্রী চিকিৎসক ও নার্সরা। সূত্র : কালেরকণ্ঠ।  

ট্রেনের টিটিই আমিরুল হক জাহেদী জানান, ট্রেনটি ঢাকা থেকে চিলাহাটী যাওয়ার পথে রাত ৮টার দিকে গাজীপুরের মহেড়া স্টেশন পার হচ্ছিল। টিকিট চেক করতে জ নম্বর কোচে যাওয়ার পর এক যাত্রী জানান, ঘ নম্বর কোচে একজন গর্ভবতী মহিলা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

সঙ্গে সঙ্গে আমার পেছনে থাকা গার্ড সিফাত হোসেনকে জানাই দ্রুত পিএ অপারেটরকে ট্রেনের মাইকে একটা ঘোষণা করতে যে ‘ট্রেনের মধ্যে যদি কোন ডাক্তার থাকেন তাহলে জরুরি ভিত্তিতে ঘ কোচে তাকে বিশেষ প্রয়োজন, একজন গর্ভবতী নারী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

মাইকিং করার পর একজন যাত্রী ডাক্তার জ কোচ থেকে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি হলেন ঢাকার ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সানাউল্লাহ। এরপর চ কোচ থেকে রংপুর কমিউনিটি হাসপাতালের ইন্টার্ন ডা. আফসানা ইসলাম রোজা আসেন। মাইকিং শুনে দুজন নার্সও দ্রুত ঘ কোচে আসেন।

এরপর চিকিৎসক ওই অসুস্থ নারীর রক্তপাত দেখে জরুরিভাবে হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। এর মধ্যে ৯৯৯-এ কল দিলেন এক যাত্রী। সিদ্ধান্ত হলো, টাঙ্গাইল স্টেশনে ট্রেন থামানো হবে। ৯৯৯ থেকে অ্যাম্বুল্যান্সের নম্বর দেওয়া হলো। অ্যাম্বুল্যান্সের চালকের সঙ্গে কথা বলে তাকে প্রস্তুত থাকতে বলা হলো। 

এদিকে অসুস্থ নারীর রক্তপাত তখনও হচ্ছিল। গর্ভে থাকা চার মাসের নবজাতক গর্ভেই মারা গেল। ডা. সানাউল হকের নির্দেশনামাফিক চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যান শিক্ষানবিশ নারী চিকিৎসক ও দু’জন নার্স। ঘ কোচের নারী যাত্রীরা নিজেদের কাছে থাকা কাপড় দিয়ে ঘিরে রেখেছিলেন পুরো জায়গাটা। তিন আসনের চেয়ারের সারিটা যেন সেই মুহূর্তে হয়ে যায় অপারেশন থিয়েটার।

এদিকে ওই নারীর স্বামী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। একজন যাত্রী জানান, তার পকেটে মাত্র ১২০০ টাকার মতো আছে। তাৎক্ষণিক সব যাত্রী যে যার মতো টাকা সংগ্রহ করা শুরু করলেন। প্রায় পাঁচ হাজারের মতো টাকা রোগীর স্বামীর হাতে তুলে দেওয়া হলো।

টিটিই আমিরুল হক জাহেদী বলেন, আল্লাহর রহমতে ওই নারীর মৃত বাচ্চাটিকে বের করে ফেলা হলো ডাক্তার-নার্সের প্রচেষ্টায়। রক্তপাত বন্ধে ট্রেনের যাত্রীরা কাপড়, স্যালাইন, হেক্সিসল, ডেটলসহ অন্যান্য জিনিস দিয়ে চিকিৎসক-নার্সকে সহযোগিতা করেন। রক্তপাত বন্ধের পর রোগী আশঙ্কামুক্ত বলে সবাইকে আশ্বস্ত করেন ডা. সানাউল্লাহ। এ কারণে রোগীকে আর হাসপাতালে নেয়ার প্রয়োজন হয়নি।

এরপর ডা. সানাউল্লাহ রোগীর জন্য প্রেসক্রিপশন লিখে দেন। ঈশ্বরদীর টিটিই আব্দুল আলীম বিশ্বাস মিঠুকে ফোন করে এ বিষয়টি বিস্তারিত জানানো হয়। তখন মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যেও  প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ কেনার ব্যবস্থা করেন। পরে ট্রেনটি ঈশ্বরদী স্টেশনে থামলে সংগৃহীত ওষুধ চিকিৎসকের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়। তিনি রোগীর স্বামীকে ওষুধ খাওয়ানোর নিয়ম বুঝিয়ে দেন।

পরে রাত সাড়ে ৩টা নাগাদ ওই নারী ও তার স্বামী দিনাজপুরের ফুলবাড়ী স্টেশনে নামেন। আর চিকিৎসক সানাউল্লাহ সারাটা রাত, সারাটা পথ ওই রোগীর পাশে বসেছিলেন। চিকিৎসকের সঙ্গে সহযোগিতা করেন শিক্ষানবিস চিকিৎসক আফসানা ইসলাম রোজা, নার্স ফারজানা আক্তার, মুন্নি খাতুন, নার্সিং ইন্সট্রাক্টর রেবেকা সুলতানা, খাদিজা খাতুন নিশা, রুমি ইসলাম। এভাবেই একদল মানবিক মানুষের সহযোগিতায় বেঁচে যান একজন নারী।

এ বিষয়ে টিটিই আমিরুল হক জাহেদী বলেন, ‘আমার চাকরিজীবনে ট্রেনের মধ্যে বেশ কিছু মানবিক ঘটনা দেখেছি। তবে এই ঘটনাটি অভূতপূর্ব। ট্রেনের মাইকে ঘোষণা শুনে ডাক্তার, নার্সসহ অন্যরা যেভাবে একজন অসুস্থ নারীর পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন তা অনন্য। স্যালুট জানাই ওই মানবিক মানুষদের।’

এ বিষয়ে ডা. সানাউল্লাহ বলেন, আমার বাড়ি দিনাজপুরে। গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলাম। ট্রেনের মধ্যে মাইকে ঘোষণা শুনে একজন চিকিৎসক হিসেবে বসে থাকতে পারিনি। যদিও ট্রেনের মধ্যে কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ঢাল-তলোয়ার কিছু ছিল না, যে কারণে চ্যালেঞ্জ ছিল। তার মধ্যেই সবার সহযোগিতায় নারীর প্রসব করানো সম্ভব হয় এবং তিনি বেঁচে যান। বড় কোনো বিপদ হয়নি। আমরা প্রথমে টাঙ্গাইল স্টেশনে অ্যাম্বুল্যান্সে হাসপাতালে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম তিনি স্বাভাবিক আছেন। এ যেন সিনেমার কাহিনির মতো। আমার জীবনে একটি অনন্য ঘটনার সাক্ষী হলাম।


আরও দেখুন: