প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইনের খসড়া বাতিলের দাবি

ডক্টর টিভি রিপোর্ট
2023-07-26 12:25:41
প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইনের খসড়া বাতিলের দাবি

ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেস্পন্সিবিলিটিজ (এফডিএসআর)

প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইনের খসড়াটি বাতিল করে ‘যুগোপযোগী আইন’ প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে চিকিৎসকদের সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেস্পন্সিবিলিটিজ (এফডিএসআর)। মঙ্গলবার (২৫ জুলাই) সংগঠনটির মহাসচিব ডা. শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এ দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। 

এফডিএসআর এর মতে, স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন ২০২৩ এর খসড়ায় জনগণের মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকার ও একই সাথে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের সাথে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, নার্স ও সহায়ক কর্মীর কর্ম পরিবেশ নিরাপদ ও মানসম্পন্ন করার প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। দীর্ঘ বিবৃতিতে ১৮টি যুক্তি তুলে ধরেছে এফডিএসআর। নিচে সেগুলো তুলে ধরা হল :

১. প্রস্তাবনার কোন ধারাতেই একজন প্রান্তিক মানুষের হাসপাতাল শয্যা প্রাপ্তি নিশ্চিত করেনি, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা, ওষুধ, সঠিক পথ্যেরও নেই কোন নির্দেশনা। জরুরি স্বাস্থ্যসেবা, দুর্ঘটনা, দুর্যোগকালে, ভূমিকম্প ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়কালে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির কোনো সুরক্ষাও বিবৃত হয়নি। 

২. বিশেষায়িত সেবা প্রাপ্তির নিশ্চিয়তা বিধানে বিশেষায়িত হাসপাতালে রেফার্ড রোগীর চিকিৎসা ও সেবা প্রাপ্তির সুরক্ষাও নেই কোনো ধারায়। নেই মেডিকেল পর্যবেক্ষণের সুবিধাসহ তার পরিবহন সুরক্ষার কোনো কথা।

৩. ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রয়োগ সুবিধায় যখন সকল সেক্টরে সেবা দ্রুত সহজলভ্য হয়ে উঠেছে সেই ক্রান্তিকালে স্বাস্থ্যসেবার মতো অতি সম্ভাবনাময় সেবার ক্ষেত্রে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার একটি শব্দও নেই সমগ্র প্রস্তাবনায়, যা প্রকারান্তরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সেবা সহজীকরণের দৃঢ় অঙ্গীকারকে অসম্মানিত করার শামিল।

৪. স্মার্ট বাংলাদেশের মতো অতি যৌক্তিক উদ্যোগ, যা জনগণের স্বাস্থ্যসেবাকে এক যুগান্তকারী স্তরে উন্নীত করার সক্ষমতা রাখে, সেটিও লজ্জাজনকভাবে অবহেলিত হয়েছে এই প্রস্তাবনায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, পেপারলেস ডাটা সংরক্ষণ, আর্কাইভ, টেলিমেডিসিন—যা চিকিৎসা বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য সেবাকে এক অকল্পনীয় উচ্চমাত্রায় নিতে পারে, যা স্মার্ট বাংলাদেশ ধারণার সবচাইতে উপযোগী প্রয়োগের মাধ্যমে আগামীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করার সক্ষমতা রাখে, সেটিও চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে প্রস্তাবনায়।

৫. টিসু সংরক্ষণ, জেনেটিক উপকরণ সংরক্ষণ, পারসোনাল ডাটা সংরক্ষণ ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় আগামীর কোনো প্রাক প্রস্তুতির কোনো বিধান নেই প্রস্তাবনায়।

৬. অটিস্টিক, প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর চিকিৎসা ও সামাজিকিকরণের কোনো প্রত্যাশা বা দায়বদ্ধতা এতটুকুও উচ্চারিত হয়নি প্রস্তাবনায়।

৭. সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালসমূহের পৃথকীকরণ ও স্তরবিন্যাসের কোনো প্রক্রিয়া বিবেচনায় না নিয়েই ঢালাওভাবে অবশ্য পালনীয় শর্তের উল্লেখ রয়েছে একাধিকবার। উদাহরণস্বরূপ একজন রোগীর জন্য ১০০ বর্গফুট জায়গা নিশ্চিতকরণের বাধ্যবাধকতা রাখলে এই আইন পাসের সাথে সাথে দেশের প্রায় সকল হাসপাতাল বন্ধ করে দিতে হবে বা আইন অমান্য করে পরিচালিত হতে হবে।

৮. যথাযথ ফলো-আপ সুচিকিৎসার একটি অন্যতম অংশ, প্রস্তাবনায় রোগীর ফলোআপ সংক্রান্ত আবশ্যিকতার কোনো নির্দেশনা নেই।

৯. সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকের আবাসন, জরুরি ক্ষেত্রে পরিবহনের কোন উল্লেখ নেই, অথচ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এই দুই অপরিহার্যতা উপেক্ষা করার কোনো অবকাশ নেই।

১০. রোগীর অপেক্ষা কক্ষের মানহীনতা কিম্বা মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় এই প্রস্তাবনা যতটা সিরিয়াস ঠিক ততটাই নমনীয় হাসপাতাল আক্রমণকারী কিম্বা সেবা প্রদানকারীদের আক্রমণ বা নিগ্রহকারীদের বেলায়। তাদের অপরাধ জামিনযোগ্য ও আপোষযোগ্য করার মধ্য দিয়ে এই অপকর্মে প্রকাশ্য উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। এই আইনের উদ্দেশ্য যদি আক্রমণ কারী সন্ত্রাসীর সুরক্ষা আর সেবা প্রদানকারীর হেনস্তা হয় তাহলে ভিন্ন কথা। অথচ ভারতেই আইপিসির বিভিন্ন ধারায় সম্পদ বিনষ্টকারী বা আক্রমণকারী দুর্বৃত্তের জন্য কারাবাস ও অর্থদণ্ড উভয় প্রবিধান রাখা হয়েছে।

১১. চিকিৎসা সেবা গ্রহীতার অভিযোগ নিষ্পত্তিতে বিএমডিসিকে কোনো ক্ষমতাই দেয়া হয়নি। অথচ চিকিৎসা সংক্রান্ত অভিযোগ অতি বিশেষায়িত এক ধরনের ইস্যু যা প্রযুক্তির উন্নয়নে আরও জটিলতর হবে, ফলে প্রচলিত আদালত এই ধরনের অভিযোগ নিষ্পত্তিতে সমস্যায় পরবে। বিএমডিসির আওতায় ট্রাইব্যুনাল এই ধরনের অভিযোগের দ্রুত, সঠিক ও আইনানুগ নিষ্পত্তি করতে পারে।

১২. চিকিৎসকের কর্মস্থলে উপস্থিতি বা সপ্তাহান্তে কর্মক্ষেত্রের বাইরে অবস্থানকে ঢালাওভাবে অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করার পূর্বে, এর মানবিক সংশ্লিষ্টতার বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে।

১৩. চিকিৎসকদের গাফিলতি, মিস কনডাক্ট, ত্রুটি-বিচ্যুতিকে অজ্ঞানতা, অসম্পূর্ণ চিকিৎসা জ্ঞান, ইচ্ছাকৃত-অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি, অমিশন, কমিশন, নেগলিজেনসি ইত্যাদি বিভিন্ন স্তর বিন্যাস করে অপরাধের ও শাস্তির ধরন নির্ধারণ করতে হবে। বিএমডিসির কাছে প্রাথমিক অভিযোগ দায়ের ও তার অধিক্ষেত্রের বাইরে গেলেই শুধুমাত্র ফৌজদারি বিধি প্রয়োগ করা যাবে মর্মে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন এবং তা বলবৎ হওয়া মাত্র বিদ্যমান সকল আইন সেক্ষেত্রে অকার্যকর বিবেচিত হবে মর্মে সুনির্দিষ্ট উল্লেখ।

১৪. প্রস্তাবিত খসড়ায় চিকিৎসকদের স্বাধীন ও সৎ চিকিৎসা সেবা প্রদানের ক্ষেত্রকে আইনের একাধিক ধারার উল্লেখে এমনভাবে আতঙ্কিত করা হয়েছে যে, যেকোনো চিকিৎসক চিকিৎসা প্রদানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে না, যা প্রকারান্তরে জনগণকে প্রকৃত চিকিৎসা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করবে এবং এতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রদানের মূল লক্ষ্যই ব্যাহত হবে।

১৫. এই প্রস্তাবনায় চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ওষুধ, চিকিৎসা সামগ্রী, রোগ নির্ণায়ক পরীক্ষার কোনো দায় নির্ধারিত হয়নি, যা বিশেষ বিচ্যুতি এবং এ বিষয়ে বিশদ বিশ্লেষণ ও প্রস্তাবনা তৈরি ছাড়া সুরক্ষা নিশ্চিত করা অসম্ভব।

১৬. এই প্রস্তাবনা সেবা গ্রহীতা কিংবা সেবা প্রদানকারী কারোই সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়নি। পাশাপাশি প্রস্তাবিত দফাসমূহ এতটাই ত্রুটিপূর্ণ, অসম্পূর্ণ ও অগ্রহণযোগ্য যে, এটা সংশোধন করে এই আইনের মাধ্যমে কারোই সুরক্ষা করা অসম্ভব এবং একই সাথে বেশ কিছু ধারা সম্পূর্ণ বাতিল করে অনেকগুলো নতুন ধারা সংযুক্ত করা প্রয়োজন হবে, বিধায় এটি সম্পূর্ণ নতুনভাবে পুনঃলিখন অপরিহার্য।

১৭. বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী গ্রুপ, সংশ্লিষ্ট আইন বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে আইনের উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে নতুনভাবে খসড়া প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া ও প্রস্তাবিত খসড়া বিবেচনার সকল কার্যক্রম স্থগিত ও বাতিল করা।

১৮. আমাদের আশঙ্কা, এই প্রস্তাবনার খসড়া নিয়ে যে কোনো পদক্ষেপ চিকিৎসকদের মধ্যে ভীষণ অসন্তোষের জন্ম দিবে, যা দেশের এই ক্রান্তিকালে সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে ফলে কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী যেন এই সুযোগে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন অপরিহার্য।

প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা আইনের পরিমার্জিত খসড়া প্রণয়নের লক্ষ্যে ২৭ জুলাই (বৃহস্পতিবার) সভা ডেকেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সভাটি অনুষ্ঠিত হবে। 


আরও দেখুন: