ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৭৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ

ডক্টর টিভি রিপোর্ট
2023-07-10 10:19:41
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৭৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ

ঢাকা মেডিকেল কলেজ

আজ ঐতিহাসিক ১০ জুলাই। ১৯৪৬ সালের আজকের এই দিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। 

দেশের চিকিৎসাবিদ্যার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানে থেকে এমবিবিএস ডিগ্রির পাশাপাশি স্নাতকোত্তর পর্যায়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের  উচ্চতর বিভিন্ন ডিগ্রি দেওয়া হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার বছরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সিল তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের কাছে ঢাকায় একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের প্রস্তাব পেশ করে। কিন্তু যুদ্ধের ডামাডোলে হারিয়ে যাওয়া প্রস্তাবটি ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষে আলোর মুখ দেখে। 

ব্রিটিশ সরকার উপমহাদেশের ঢাকা, করাচী ও মাদ্রাজে তিনটি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ উপলক্ষে ঢাকার তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. মেজর ডব্লিউ জে ভারজিনের নেতৃত্বে স্থানীয় বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। তাদের প্রস্তাবনার ভিত্তিতে ১৯৪৬ এর ১০ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ চালু হয়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ গঠনের প্রাক্কালে স্থাপিত কমিটির প্রধান ডব্লিউ জে ভারজিনের উপরেই ন্যস্ত হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের পরিচালনার গুরুদায়িত্ব। শুরুতে এনাটমি ও ফিজিওলজি ডিপার্টমেন্ট না থাকায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে ক্লাস করতে হত। একমাস পর এনাটমি বিভাগের অধ্যাপক পশুপতি বসু এবং ফিজিওলজি বিভাগে অধ্যাপক হীরালাল সাহা শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর হাসপাতালে ২২ নং ওয়ার্ডে ক্লাস শুরু হয়। তখন ছিল না কোন লেকচার গ্যালারি বা ডিসেকশান হল। ১৯৫৫ সালে কলেজ ভবন স্থাপনের পর সেই অভাব পূরণ হয়।

একটি মাত্র ভবন নিয়ে পথচলা শুরু করা ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নিজস্ব প্রায় ২৫ একর জমিতে বর্তমানে রয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। আছে কলেজ ভবন, অডিটোরিয়াম, পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্র, ছাত্র ও ছাত্রী হোস্টেল, বার্ন ইউনিট ইত্যাদি। 

শুরুতে হাসপাতাল ভবনেই প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস হলেও ১৯৫৫ সালে একাডেমিক কার্যক্রমের জন্য বর্তমান কলেজ ভবনটি নির্মিত হয়। এতে বেসিক সাবজেক্টগুলোর জন্য স্থান বরাদ্দের পাশাপাশি আরও কিছু স্থাপনা রয়েছে। 
প্রথম থেকে একই কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকলেও ১৯৭৫ সালে প্রশাসনিক সুবিধার্থে কলেজ ও হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ পৃথক করা হয়। কলেজের দায়িত্বভার অর্পিত হয় অধ্যক্ষের উপর এবং হাসপাতাল পরিচালনার ভার পরিচালকের উপর।

২৮টি বিভিন্ন বিভাগ এবং হাসপাতালে ৪২টি ওয়ার্ডে ২৩৪ জন ডাক্তার, ২০০ জন ইন্টার্নি ডাক্তার, ৫৬০ জন নার্স এবং ১১০০ জন অন্যান্য কর্মচারী নিয়োজিত আছেন রোগীদের সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে।   

দেশের সর্ববৃহৎ এ হাসপাতালের ধারণক্ষমতা ২৩০০। তবে এটি প্রতিদিন প্রায় ৩৫০০ রোগীকে অন্তঃবিভাগে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে৷ এছাড়া এই হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী নানা জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হচ্ছেন। ইতিমধ্যে হাসপাতালটিকে ৫০০০ শয্যার হাসপাতালে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।  

কলেজে আন্ডারগ্র‍্যাজুয়েট এমবিবিএস ও পোস্টগ্র‍্যাজুয়েট পাঠক্রম চালু আছে। বর্তমানে আন্ডারগ্র‍্যাজুয়েট কার্যক্রম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পোস্টগ্র‍্যাজুয়েট কার্যক্রম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত। সাধারণ ও কোটা মিলিয়ে এমবিবিএস কোর্সে ২০২১ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ২৩০ জন ছাত্রছাত্রী ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। ছাত্র-ছাত্রীরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভর্তি হয়। ২০২০ সাল থেকে ১২৮ জন বিদেশী ছাত্রছাত্রী ঢাকা মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত আছে। ২০১২ সালের পরিবর্তিত পাঠক্রম অনুযায়ী চারটি পেশাগত পরীক্ষার বাধা পেরিয়ে একজন শিক্ষার্থী এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন লাভ করতে একবছর মেয়াদী ইন্টার্নশিপের  প্রয়োজন হয়।

বর্তমানে ৪২টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স (এমডি, এমএস, এম ফিল, ডিপ্লোমা) চালু আছে। এছাড়া বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস এন্ড সার্জনস এর বিভিন্ন বিষয়ের ফেলোশিপ কোর্স এ কলেজে চালু আছে।

মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকাঃ

১৯৭১ সালের মহা মুক্তিযুদ্ধে এই কলেজ থেকে পাশ করা চিকিৎসক, তৎকালীন ছাত্র, কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারী উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। এদের অনেকেই অস্ত্রহাতে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। আবার কেউ কেউ হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধা এবং অসহায় বাঙালিদের চিকিৎসা করেছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা অনেক চিকিৎসক ভারতে গিয়ে বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। 

ডা. মো. ফজলে রাব্বি, ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরীর মতো মুক্তিযুদ্ধে শহীদ অনেক চিকিৎসক এই ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন।

ব্যবস্থাপনাঃ

হাসপাতালের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকেন হাসপাতালের পরিচালক। উপ পরিচালক ও সহকারী পরিচালকগণ এ ব্যাপারে তার সহায়ক হন। হাসপাতালের পরামর্শক, আবাসিক চিকিৎসক, রেজিস্ট্রার, সহকারী রেজিস্ট্রার, মেডিকেল অফিসার, ইন্টার্নসহ, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ও কর্মচারীগণ পরিচালকের নিকট দায়বদ্ধ থাকেন। এছাড়াও ঢাকা মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন বিভাগের অধ্যাপক, সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপকবৃন্দ সংশ্লিষ্ট বিভাগের শীর্ষ আধিকারিক হিসেবে চিকিৎসা কার্যক্রমের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকেন।

ছাত্রাবাসঃ

তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদার ছাত্রদের আবাসনের ব্যবস্থা করেন। এ সময় মুসলমান ছাত্ররা সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে, হিন্দু ছাত্ররা ঢাকা হলে (বর্তমানে ড. মুহম্মদ শহীদুলাহ্ হল), খ্রিস্টান ছাত্ররা সদরঘাটের ব্যাপ্টিস্ট মিশনে থাকত। আর ছাত্রীরা থাকত নার্সিং হোস্টেলে। ১৯৪৭ সালে বর্তমান নার্সিং ইনস্টিটিউটের স্থানে নিজস্ব ছাত্রী হোস্টেল স্থাপিত হয়। প্রথমে ১১টি, পরে আরো দুই দফায় ৬টি ও ৩টি মোট ২০টি ব্যারাক নির্মিত হয়।

বর্তমানে যে ছাত্রী হলটি ‘ডা. মিলন হল’ নামে পরিচিত, তা ১৯৯২ সালের পূর্বে ডাঃ আলীম চৌধুরী হলেরই অংশ ছিল। এ হলে রয়েছে ১১৬টি রুম।
 
ছাত্রদের বকশীবাজার মোড়ের বর্তমান হলটি নির্মিত হয় ১৯৫০ থেকে ১৯৫৫ সালে। ১৯৭২ সালে যার নামকরণ করা হয় শহীদ ডাঃ ফজলে রাব্বির নামে। এই হলে একটি মূল ভবন ও ৩টি ব্লকসহ মোট রুম এর সংখ্যা ২২৫- যা এমবিবিএস প্রথম বর্ষ থেকে পঞ্চম বর্ষ পর্যন্ত ছাত্রদের জন্য সংরক্ষিত।

১৯৭৪-৭৫ সালে ইন্টার্নি ডাক্তারদের জন্য শহীদ ডাঃ ফজলে রাব্বি হলের পাশে পৃথক হোস্টেল প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এর নামকরণ করা হয় ‘শহীদ ডাঃ মিলন ইন্টার্নি হোস্টেল’। এর পূর্বে ইন্টার্নি ডাক্তাররা চাঁনখারপুলের কাছে ওল্ড পিজি হোস্টেলে থাকতেন।

ঢাকা মেডিকেলের ব্যাচের নামকরণে কেন K ব্যবহার করা হয়?

১৯৪৬ সালে সকল বর্ষেই শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। তবে প্রথমমবর্ষ ব্যতীত অন্য সব বর্ষে ছাত্ররা আসে মূলত কলকাতা মেডিকেল কলেজ হতে মাইগ্রেশন করে।
১ম বর্ষের নামকরণ করা হয় কে-৫, একই ভাবে ২য় বর্ষের কে-৪, ৩য় বর্ষকে কে-৩, ৪র্থ বর্ষকে কে-২ এবং ৫ম বর্ষকে কে-১ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই ধারাবাহিকতায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রতিটি ব্যাচের নামেই সংযুক্ত রয়েছে K।

এই K এর উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। কারও কারও মতে K এর উৎপত্তি কলকাতা থেকে। তবে ২০০১ এর আগ পর্যন্ত কলকাতাকে ইংরেজিতে Calcutta লেখা হত।

আবার কারও মতে ভারতীয় উপমহাদেশের একাদশ মেডিকেল কলেজ হিসেবে ইংরেজি বর্ণমালার একাদশ বর্ণ K নির্বাচন করা হয়েছে।


আরও দেখুন: