হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে অনিয়ম-দুর্নীতির বাসা
অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অসম চুক্তিসহ নানা দুর্নীতির কারণে চিকিৎসাসেবার মান নিম্নগামী, রোগী কমে হ্রাস পেয়েছে আয়
রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাইসেন্স নিয়মিত নবায়ন করা হয় না। পরিচালকের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান।
শুধু তাই নয়, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অসম চুক্তিসহ নানা দুর্নীতির কারণে চিকিৎসাসেবার মান নিম্নগামী, রোগী কমে হ্রাস পেয়েছে আয়। ক্রমে একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল।
ট্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। রবিবার (২৫ জুন) ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন ‘হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (গবেষণা ও পলিসি) মুহাম্মদ বদিউজ্জামান ও মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।
গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন কনসালটেন্ট তাসলিমা আক্তার ও সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (গবেষণা ও পলিসি গবেষণা) মো. মাহ্ফুজুল হক। প্রতিবেদনে বলা হয়, হাসপাতালের জন্য পৃথক জনবল কাঠামো না থাকায় অপরিকল্পিত নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতিসহ হাসপাতালের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে জবাবদিহিতা নেই। একটি মানবিক সহায়তা সংস্থা এবং রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের অংশ হলেও হাসপাতালটি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সরকার কর্তৃক অনুদান এবং আয়-ব্যয়ের হিসাব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে নথিভুক্ত করেনি, যা অংশীজনদের আস্থার সংকট তৈরি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদন স্ব প্রণোদিতভাবে প্রকাশ ও প্রচার করেনি। ফলে হাসপাতাল কার্যক্রমে অস্বচ্ছতা ও অব্যবস্থাপনার সঙ্গে অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, হাসপাতালটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রূপান্তরিত হলেও প্রয়োজনীয় সব রোগের চিকিৎসা যেমন- লিভার, গলব্লাডার, পিত্তনালী ও অগ্ন্যাশয়ের অবস্থা নির্ণয়, পাথর অপসারণে ইআরসিপি যন্ত্র, এমআরআই যন্ত্র, চক্ষু ও ডেন্টাল ইউনিটে যন্ত্রপাতি, স্কিনের চিকিৎসায় লেজার যন্ত্র, মেমোগ্রাফি, বায়োপসি, টিবি পরীক্ষার যন্ত্র, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট রোগীকে শক দেওয়ার জন্য ডিফিব্রিলেটর যন্ত্র নেই। বাইপাস সার্জারি, এনজিওগ্রামসহ জটিল রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাও হাসপাতালটিতে নেই। অ্যান্ডোসকপি ও কোলোনোস্কোপি যন্ত্রটি পুরনো হওয়ায় সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। ওটিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে।
টিআইবি বলেছে, হাসপাতালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ঘাটতি রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেবিনে গুমোট গন্ধ, স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল, ফ্যান ও জানালা নিয়মিত পরিষ্কার না করা এবং রাস্তায় রাখা বর্জ্য থেকে কেবিনে দুর্গন্ধ আসাসহ বিবিধ অভিযোগ রয়েছে। কেবিনের রোগীর শয্যার চাদর প্রতিদিন বদলানো হয় না। রোগীর পক্ষ থেকে বলা হলেও পরিবর্তন করা হয় না, এমনকি ভর্তির পর ৪-১৫ দিনের মধ্যে মাত্র একদিন বিছানার চাদর পরিবর্তন করার অভিযোগ রয়েছে।
চিকিৎসাসেবায় চিকিৎসক-নার্সদের গাফিলতি সম্পর্কে অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে। যেমন- রোগীর ফাইল চেক না করে সুন্নতে খতনার রোগীর গলার টনসিল অপারেশন, কর্তব্যরত নার্স নির্ধারিত ওষুধ না দিয়ে অন্য ওষুধ দেওয়ায় রোগীর অবস্থার অবনতি ও আইসিইউতে ভর্তি, ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যু এবং হাসপাতালে বিশৃঙ্খলার অভিযোগ রয়েছে। সেবা কার্যক্রমে বিঘ্ন, চিকিৎসক ও কর্মীদের বেতন অনিয়মিত, দীর্ঘদিন গ্র্যাইচুটির অর্থ বকেয়ার ঘটনায় কর্মীদের প্রতিবাদ সমাবেশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অবরুদ্ধ করে রাখা, কখনও নার্স কর্তৃক রোগীর সঙ্গে খারাপ আচরণ ও জরুরি প্রয়োজনে নার্সকে ডেকে না পাওয়া, রোগী থেকে বখশিশ আদায়ের ঘটনায় রোগীদের মনে উদ্বেগ ও হাসপাতাল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়।
৫২৮ শয্যার হাসপাতালে ৬৫২ জনের অধিক জনবল রয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ জনের বেশি প্রশাসনিক কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাজনৈতিকভাবে নিয়োগের ফলে প্রশাসনিক কাজে প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
প্রাত্যহিক কার্যক্রম পরিচালনায় চিকিৎসক-নার্সসহ প্রয়োজনীয় জনবলের ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে, নিজস্ব পরিচ্ছন্নতাকর্মীর স্বল্পতা রয়েছে। কর্মরত মোট ৫৫ জনের মধ্যে নিজস্ব মাত্র ১৯ জন। অধ্যাপক ও জুনিয়র চিকিৎসকের স্বল্পতা, বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগের চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং সেবাগ্রহীতাদের অসন্তুষ্টি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সার্বক্ষণিক কনসালটেন্ট রয়েছে মাত্র তিনজন। সার্জারি, আইসিইউ, সিসিইউ, আলট্রাসনোগ্রাম ও রেডিওলজিতে চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে। হাসপাতালে কর্মরত কর্মীদের ২০৮ জনের সুনির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই, যারা অলস সময় ও ছুটি কাটায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিবেদেনে আরও বলা হয়েছে, হাসপাতালের আর্থিক সামর্থ্যের ঘাটতি রয়েছে। একটানা পাঁচ থেকে সাত মাসের বেতন বকেয়া থাকার নজির রয়েছে। গ্র্যাইচুটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, ওষুধ কোম্পানির কাছেসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা বকেয়া রয়েছে। অবসর নেওয়া ২৩৬ জনের এককালীন গ্র্যাইচুটির অর্থ বকেয়া, অবসরের পর গ্র্যাইচুটির টাকা এককালীন প্রদানের কথা থাকলেও না দেওয়ায় চিকিৎসক-নার্স ও কর্মীরা আদালতে মামলা করেন। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বরের তথ্যানুযায়ী, বেতন বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি টাকা, প্রভিডেন্ট ফান্ডে টাকার ঘাটতি প্রায় ৮ কোটি টাকা, হাসপাতালের কাছে ওষুধ কোম্পানির বকেয়া প্রায় ৪ কোটি টাকা, অবসরপ্রাপ্তদের গ্র্যাইচুটির প্রায় ৩১ কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাতে প্রায় ১৮ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। হাসপাতালের আয়ের সবচেয়ে বড় খাত কেবিন/সিট ভাড়া। কিন্তু রোগী কমে ৫২৮ শয্যার হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ রোগী থাকায় হাসপাতালের আয় হ্রাস পেয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি (বাণিজ্যিক) হাসপাতালের মতো হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র পেয়েছে টিআইবি। হাসপাতালটির লাইসেন্স ২০২১ সালে তিন বছরের নবায়ন একত্রে করা হয়। লাইসেন্স পুনঃনবায়ন ছাড়াই হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ২০২১-২০২২ সালের নবায়ন সম্পন্ন না করেই কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যবস্থাপনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নির্বাচন করা হয়েছে। পরিচালক পরিবর্তন হলে হাসপাতালের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে অজুহাতে ঘনঘন পরিচালক পরিবর্তন করা হয়।
হাসপাতালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগেও দলীয় প্রভাব, স্বজনপ্রীতি ও এলাকার পরিচিতি বিবেচনায় নিয়োগের প্রমাণ পেয়েছে টিআইবি। প্রতিবেদনে বলা হয়, চিকিৎসক নিয়োগে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে- চাকরিপ্রার্থীদের কাছে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ চাওয়া হয়েছে। হাসপাতাল পরিচালক ও সিনিয়র চিকিৎসকের সুপারিশে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে চিকিৎসক ও কর্মচারী নিয়োগেরও অভিযোগ রয়েছে। অদক্ষ কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া এবং নিয়োগকৃতদের সংশ্লিষ্ট বিভাগে কাজের শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকার অভিযোগসহ কার্যক্রম পরিচালনায় নিয়োজিত কর্মীদের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। পদোন্নতিতে দলীয় প্রভাবের অভিযোগ রয়েছে। কর্মীদের কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন ও পদোন্নতিতে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি বলে মনে করে টিআইবি।
হাসপাতালের সুনাম পুনরুদ্ধারে ১৪টি সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির জন্য বাস্তবসম্মত মানবসম্পদ কাঠামো প্রণয়ন, অবকাঠামোগত সংস্কার, কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, প্রশাসনিক কার্যক্রম ডিজিটালাইজ করা, অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরে বড় ধরনের দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছে, যা উদ্বেগজনক। হাসপাতাল পরিচালনায় বেশ কিছু আইন ও নীতিমালার অনুপস্থিত বা ঘাটতি আছে। এক ব্যক্তির হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকায়, পরিচালনা কার্যক্রমে তার (চেয়ারম্যানের) কর্তৃত্ব ও হস্তক্ষেপ অবারিত থাকায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত হচ্ছে না।