হার না মানা এক স্বাস্থ্য কর্মকর্তার গল্প
ডা. জাফরিন জাহেদ জিতি
আন্তরিকতাপূর্ণ চিকিৎসা সেবার কারণে উপজেলার ৬ লক্ষাধিক মানুষের ভরসার নাম গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। বিশেষ করে ২৪ ঘণ্টা স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা রাখায় দেশের অন্যতম আদর্শ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি সুনাম কুড়িয়েছে। এখন আশপাশের উপজেলা থেকেও রোগী আসেন। এসব কিছু সম্ভব হয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জাফরিন জাহেদ জিতির হার না মানা মানসিকতায়। সহকর্মীদের নিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করে চলেছেন তিনি।
ডক্টর টিভির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ডা. জাফরিন জাহেদ জিতি বলেন, ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের পাশে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সহজ যোগাযোগের কারণে হাসপাতালটির গুরুত্ব অনেক। কয়েক বছর আগেই এটিকে ৫০ থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় হাসপাতালের পুরনো ভবন ভেঙে চলছে নতুন ভবন নির্মাণ। ভাঙা-গড়ার মধ্যে হাসপাতালের কার্যক্রম সচল রাখা ছিল অনেক চ্যালেঞ্জের। কারণ, পুরনো ভবন ভেঙে ফেলায় রোগীদের ভর্তি রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন ডা. জাফরিন জাহেদ জিতি। তখন মাত্র ৮-১০ রোগী ভর্তি থাকতো। হাসপাতাল ভবন ভাঙার পর আউটডোরেও রোগী আসা কমে যায়।
রোগীদের হাসপাতালমুখী করতে সহকর্মী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহায়তায় নানা উদ্যোগ নেন ডা. জাফরিন। অকেজো ও বাক্সবন্দি যন্ত্রপাতি সচলে ব্যবস্থা করেন। স্বাভাবিক প্রসবের কক্ষ উন্নত করেন। প্রসব সেবা আরও সহজে কমিউনিটি ক্লিনিককে কাজে লাগান। স্বাস্থ্যকর্মীদের সহায়তায় উপজেলার গর্ভবতী নারীদের তালিকা করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং স্বাভাবিক প্রসবের জন্য হাসপাতালে আসার গুরুত্ব বোঝান। স্বাভাবিক প্রসব সহজে আলাদা কক্ষে বিশেষ শরীরচর্চার ব্যবস্থা করেন। স্বাভাবিক প্রসবে সমস্যা দেখা দিলে জরুরি ভিত্তিতে সিজারের ব্যবস্থাও রাখা হয়।
ডা. জাফরিন বলেন, স্বাভাবিক প্রসব প্রক্রিয়ায় অবশ্যই সিজারিয়ান সেকশন রাখতে হবে। কারণ চিকিৎসক অনেক সময় চেষ্টার পরও পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে থাকে না। তখন জীবন রক্ষায় সিজারিয়ান সেকশনে যেতে হয়।
ডা. জাফরিনের প্রচেষ্টায় এখানে আগের চেয়ে ১২ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে স্বাভাবিক প্রসব। সঙ্গে ডেলিভারির পর মা ও শিশুর সেবা বৃদ্ধিসহ ২৪ ঘণ্টা জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। অন্যান্য উপজেলা থেকে জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া মেশিন এনে মাইনর ও মেজর সার্জারি করা হচ্ছে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
হাসপাতালের স্টাফদের ইসিজি ও জরুরি লাইফ সেভিং ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। এতে রোগীরা আরও উন্নত সেবা পাচ্ছেন। জরুরি বিভাগ ও চিকিৎসকদের কক্ষ নতুন করে সাজানো হয়েছে বলে জানান ডা. জাফরিন।
হাসপাতালে ব্লাড ট্রান্সফিউশন ইউনিট, উপজেলা হেলথ কেয়ারের সহযোগিতায় ল্যাবরেটরি সার্ভিস উন্নত ছাড়াও ধোপা কার্যক্রম উন্নত করা হয়ে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা, ওষুধ ও কেবিনের ব্যবস্থা রয়েছে। ভর্তি রোগীদের জন্য উন্নত পথ্য ছাড়াও নতুন এনসিডি কক্ষ চালুর পর রোগীরা সেখানে উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের সেবা নিতে পারছেন। নিরাপদ পানি নিশ্চিতে হাসপাতালের বিভিন্ন স্থানে নলকূপ ও ফিল্টার স্থাপন করেছেন।
হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বহুলাংশে বাড়িয়েছেন। হাসপাতালের রান্নাঘর উন্নত করেছেন। কমিউনিটি ক্লিনিক, উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রসমূহ এবং ইপিআই সেন্টারসমূহে সুপারভিশন ও মনিটরিং জোরদার করেছেন। কভিড-১৯, ইপিআইসহ সব টিকা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। ডি এস এফ কার্ডের ব্যাপারে স্বচ্ছতা এনেছেন।
হাসপাতালের ভাঙা প্রাচীর মেরামত ও পতিত জমি পরিষ্কার করে রাসায়নিকমুক্ত দৃষ্টিনন্দন সবজি বাগান করেছেন। বাগান হতে হাসপাতালের কর্মকর্তা কর্মচারীরা নিজের হাতে ফসল তুলে নেন। এ জন্য উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এবং হাসপাতালের কর্মচারীদের নিজস্ব চেষ্টা ও উদ্যোগে এটা সম্ভব হয়েছে বলে জানান ডা. জাফরিন। এ ছাড়া নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় হাসপাতালে ফুলের বাগান তৈরি করেছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জাফরিনের নেতৃত্বে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি এভাবেই প্রতিনিয়ত সরকারি স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধিতে নতুন নতুন ভূমিকা রেখে চলেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ডা. জাফরিন বলেন, মহাসড়কের পাশে অবস্থিত হওয়ার কারণে এখানে প্রায়ই দুর্ঘটনার রোগী আসেন। রোগীদের স্বার্থে অবিলম্বে একজন অর্থপেডিক্সের কনসালট্যান্ট পদায়ন করার দাবি জানান তিনি। হাসপাতালটিতে স্বাভাবিক প্রসব বেশি হয় বলে প্রতিনিয়তই শিশু রোগী এখানে ভর্তি থাকে। মেডিসিন ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া হলে আরও উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো।
ছোট বড় সব অর্জনে সার্বিক সহায়তার জন্য গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ধন্যবাদ জানান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। তার ভাষায়, ১০০ শয্যার কাজ চলমান অবস্থায় হাসপাতালের প্রতিটি কার্যক্রম চালু রাখতে পারা সবার সাহায্য ছাড়া কোনোক্রমেই সম্ভব ছিল না। বর্তমানে গড়ে ৬০-৬৫ রোগী ভর্তি থাকছেন। আউটডোরেও প্রতিনিয়ত ৬০০-৭০০ রোগী ভিড় করছেন।
সর্বপরি একজন স্বাস্থ্য প্রশাসক হিসেবে প্রান্তিক জনগণের স্বাস্থ্যসেবায় ভূমিকা রাখার সুযোগ পেয়ে অত্যন্ত পরিতৃপ্ত বলে জানান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জাফরিন জাহেদ জিতি।