ইউরোপ-আমেরিকার রোগ আইবিডি এখন বাংলাদেশে

ইলিয়াস হোসেন :
2023-05-18 23:24:43
ইউরোপ-আমেরিকার রোগ আইবিডি এখন বাংলাদেশে

পরিপাকতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহজনিত রোগ আইবিডি সম্পর্কে কথা বলছেন বিশিষ্ট গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট ডা. আশিকুর রহমান

পশ্চিমা ইউরোপ-আমেরিকার রোগ নামে পরিচিত আইবিডি হচ্ছে- পরিপাকতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহজনিত রোগ। যেটাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজিজ তথা আইবিডি বলা হয়। রোগটির কারণ এখন পর্যন্ত পুরোপুরি জানাতে সক্ষম হননি চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। তবে কিছু জিনগত ও পরিবেশগত বিষয়কে এ জন্য দায়ী বলে মনে করেন তারা। পশ্চিমা বিশ্বের রোগটি বর্তমানে আমাদের দেশেও দেখা দিয়েছে। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সঠিক সময়ে আইবিডির চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে, তা ক্যানসারে পরিণত হতে পারে। 

১৯ মে আইবিডি দিবস উপলক্ষে ডক্টর টিভি অনলাইনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন বিশিষ্ট মেডিসিন, লিভার ও গ্যাসট্রোএন্টারোলজিস্ট ডা. আশিকুর রহমান। এই রোগ কারো হলে সারা জীবন ধরে তা বয়ে বেড়াতে হয় বলে জানান তিনি। 

ডা. আশিকুর রহমান বলেন, পেটের প্রদাহজনিত রোগ বা আইবিডি দু’ভাবে প্রকাশ পেতে পারে। একটি হলো আলসারেটিভ কোলাইটিস, অন্যটি ক্রনস ডিজিজ।

আলসারেটিভ কোলাইটিস সম্পর্কে তিনি বলেন, এটি প্রধানত বৃহদন্ত্রে প্রদাহ বা আলসার তৈরি করে। এতে আক্রান্ত রোগীরা সাধারণত: দীর্ঘদিনের রক্ত আমাশয় নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন। সাথে মাঝে মাঝে পেট ব্যাথার কথাও বলেন। তাদের রক্তশূন্যতাও থাকে। এটি জটিল আকার ধারণ করলে জ্বর ও পেট ফুলে যাওয়ার সমস্যা দেখা দেয়। অনেকের পেট ফুটা হয়ে যেতে পারে। তখন রোগটি অনেক জটিল আকার ধারণ করে।   

ক্রনস ডিজিজ সম্পর্কে ডা, আশিক বলেন, এটিও অনেক জটিল রোগ। এরফলে মুখ থেকে পায়ুপথ পর্যন্ত পরিপাকতন্ত্রের যেকোনো অংশ আক্রান্ত হতে পারে। রোগীর মুখে ঘা হতে পারে। আবার ক্ষুদ্রান্ত্র বা বৃহদান্ত্রকেও আক্রান্ত করতে পারে। এতে পেটে ব্যথা হতে পারে, দীর্ঘদিনের পাতলা পায়খানা ও কোষ্ঠকাঠিন্য, ওজন কমে যায়, হজম ক্ষমতা কমে যায়, ভিটামিন ও পুষ্টির অভাব দেখা দেয়, রক্তশূন্যতার সৃষ্টি হয়। ক্ষুদ্রান্ত্র বা বৃহদান্ত্রে আলসার সৃষ্টি হলে পেট ফুলে ওঠে। অনেক সময় আলসার থেকে পায়ুপথ বা অন্ত্রে ফিস্টুলা তৈরি হয়ে যায়। অর্থাৎ এই রোগের প্রকাশ ঘটে পেট ব্যথা শুরুর মধ্যদিয়ে। এক পর্যায়ে তা অন্ত্র চিকন হয়ে পেট ফুলে জটিল আকার ধারণ। 

ক্রনস ডিজিজের ফলে অন্ত্রের বাইরেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা হতে পারে। শরীরের চামড়া বা ত্বকে ঘা হতে পারে। রোগীর চোখ লাল হয়ে যায়।     

আইবিডি রোগের ইতিহাস সম্পর্কে ডা. আশিক বলেন, এক সময় কেবল ইউরোপ আমিকার দেশগুলোতে আইবিডিতে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যেত। এখন এশিয়ার দেশগুলোতেও এটি ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতের পর বাংলাদেশেও আইবিডি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষই এতে আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে তরুণদের আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক বেশি। 

এর কারণ সম্পর্কে ডা. আশিক বলেন, আইবিডির প্রকৃত কারণ এখনো জানতে পারেননি চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। তবে, বংশগত বা জেনেটিক কারণে কেউ কেউ এ রোগে ভুগতে পারেন।পাশ্চাত্যের খাদ্যাভ্যাস তথা- ভাজাপোড়া, উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার, জাঙ্কফুড, ফাস্টফুড, ধূমপান, মদ্যপান আইবিডিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বলে মনে করছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। সিজারে জন্ম নেয়া শিশুদের পরবর্তীতে আইবিডি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। মায়ের দুধ খাওয়া কমে যাওয়ার ফলেও এ সমস্যা বাড়ছে। ধূমপানকেও এ জন্য দায়ি করা হয়। দীর্ঘদিন ব্যাথানাশক ওষুধ খাওয়ার ফলে আইবিডিতে আক্রান্ত হতে পারেন। অন্ত্রের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলেও এ সমস্যা হতে পারে। এক কথায়- পশ্চিমা লাইফস্টাইল বাড়ার সাথে সাথে আমাদের দেশেও আইবিডি রোগ বাড়ছে। 

আইবিডির চিকিৎসা ও প্রতিরোধ সম্পর্কে ডা. আশিক বলেন, সম্পূর্ণ নিরাময় না হলেও আগেভাগে রোগ শনাক্ত ও সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে আইবিডি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আর অবহেলা ডেকে আনতে পারে ক্যানসার।

এ বিষয়ে মেডিসিন, লিভার ও গ্যাসট্রোএন্টারোলজিস্ট ডা. আশিকুর রহমান বলেন, আইবিডি রোগটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য না। এ কারণে কারো মধ্যে রোগটির যেকোন ধরণ শনাক্ত হলেই তা নিয়ন্ত্রণের টার্গেট নেন চিকিৎসকেরা। এ জন্য রোগীদের ওষুধ দেয়ার পাশাপাশি জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেয়া হয়। চিকিৎসকের ফলোআপে থেকে নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। যাতে করে- এটি বেড়ে কিছুতেই যেন জটিল আকার ধারণ না করে। আইবিডি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করার মধ্যেই আসল সাফল্য। তবে রোগটি সম্পূর্ণ নিরাময় না হওয়ার কারণে সারা জীবন এর ব্যয়ভার বহন করতে হয়। 

আবার ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে চিকিৎসাসেবা না নিলে খাদ্যনালি চিকন হওয়া, খাদ্যনালি ফুটো হয়ে যাওয়া এমনকি ক্যানসারের মত জটিলতা তৈরি করতে পারে। তখন রোগীর  রক্তবমি ও পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়ার মতো জটিল উপসর্গ দেখা দেয়। এই জটিল উপসর্গ দেখা দেয়ার পরও রোগী যদি অবহেলা করেন, তাহলে রোগীর প্রথমে রক্তশূন্যতা দেখা দেবে। যা পরবর্তীতে রোগীর জীবনকে সংকটাপন্ন করতে পারে।

ক্রনস ডিজিজের মারাত্মক পর্যায়ে রোগীর পায়খানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকে না। এতে ক্ষেত্রবিশেষে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে বলে জানান তিনি।

তিনি আরও জানান, আইবিডি নির্ণয় ও চিকিৎসার সুযোগ সারাদেশে নেই। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে এটা শনাক্ত করার পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ নেই। দেশের পুরোনো মেডিকেল কলেজ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এর ব্যবস্থা আছে।  

আইবিডির ঝুঁকি এড়াতে শাকসবজি, ফলমূল, সুষম খাবার ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে বসবাস, নিয়মিত ব্যায়ামের পরামর্শ দেন তিনি। পাশপাশি এ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন এই বিশেষজ্ঞ।


আরও দেখুন: