মডেল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা যার স্বপ্ন
ডাঃ আবদুল্লাহ-আল-আজিজ, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, আটঘরিয়া, পাবনা
সুন্দর পরিবেশে আন্তরিক সেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে মডেল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন পাবনার আটঘরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আবদুল্লাহ-আল-আজিজ। ডক্টর টিভি অনলাইনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি।
অবহেলিত আটঘরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগদানের পর থেকেই নীরবে পরিবর্তনের লড়াই শুরু করেন ডাঃ আবদুল্লাহ-আল-আজিজ। মাত্র ১৬ মাসের মধ্যেই জেলা সিভিল সার্জনের সহযোগিতা ও সহকর্মীদের আন্তরিকতায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিকে রোগীবান্ধব হাসপাতাল হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন।
তিনি বলেন, ৩৩তম বিসিএস এ উত্তীর্ণ হয়ে ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট সরকারি চাকরিতে যোগদান। এরপর থেকে মূলত ঢাকার ভেতরেই চাকরি করেছেন। ২০২২ এর ফেব্রুয়ারি মাসে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন পাবনার আটঘরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ঢাকার বাইরে প্রথম চাকরি। কিন্তু প্রথম দিন হাসপাতালে এসেই মন খারাপ হয়ে যায়। হাসপাতালের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, ঝোপঝাড়ে ভড়া আঙিনা, রোগীদের আনাগোনাও কম।
মন খারাপ হলেও, অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে মানিয়ে নেন নতুন পরিবেশের সাথে। হাসপাতালের অবকাঠামোগত সুবিধা থাকলেও তেমন ব্যস্ততা নেই। কারণ রোগী কম। আউটডোর সেবাটাই মানুষের কাছে মূখ্য। অন্তঃবিভাগে খুব একটা রোগী থাকতো না। সব দেখে শুনে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলেন। সহকর্মীদের কাছে নিজের পরিকল্পনার কথা বললেন। সবাই তাতে সানন্দে রাজিও হলেন।
জেলার সিভিল সার্জনের সঙ্গে দেখা করে সবকিছু জানালেন। সব শুনে- যে কোন ভাল কাজে সহায়তার আশ্বাস দিলেন তিনি। তারপর শুধুই এগিয়ে চলা। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তাও পেয়েছেন সর্বদা। কাজ করতে গিয়ে অহেতুক কোন ধরনের ঝামেলা হয়নি বলেও জানান ইউএইচএফপিও।
বর্তমানে ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাম, এক্স-রে সহ বেশিরভাগ টেস্ট ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হাসপাতালেই করা হচ্ছে।
জরুরি বিভাগের চিকিৎসা সেবার মান বাড়াতে জরুরী বিভাগ সংলগ্ন একটি অবজারভেশান রুম চালু করা হয়েছে।
রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্যে এখন আর জেলা সদরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না আটঘরিয়ার রোগীদের। থ্যালাসেমিয়া, রক্তশূন্যতা সহ অন্যান্য রোগে রোগীর শরীরে রক্ত দেয়ার ব্যবস্থা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়মিতভাবে হচ্ছে।
জেলার সিভিল সার্জন ডাঃ মনিসর চৌধুরীর নির্দেশনা ও পরামর্শ মাফিক বন্ধ থাকা অপারেশন থিয়েটার চালু করতে সক্ষম হন তিনি। এরপর থেকে নিয়মিতভাবে সিজারিয়ান অপারেশন সহ অন্যান্য মেজর অপারেশন সেবা দিচ্ছেন রোগীদের।
এনসিডি কর্ণার থেকে ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশনের রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসা পরামর্শ ও ওষুধ দেয়া হচ্ছে। তাছাড়াও এখন প্রতিনিয়তই নির্ধারিত বেডের অতিরিক্ত রোগী ভর্তি থাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে। আউটডোরেও রোগীদের অনেক ভিড় দেখা যায়। গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৫/৬ শ’ লোক আউটডোর থেকে সেবা পেয়ে থাকেন।
এছাড়াও ডিজিটাল পদ্ধতিতে চিকিৎসা পরামর্শ নিতে পারছেন আটঘরিয়া উপজেলাবাসী। হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন কক্ষ থেকে কমিউনিটি ক্লিনিকের জটিল রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন উপজেলার দায়িত্বশীল চিকিৎসকরা।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জনবল সম্পর্কে ডাঃ আবদুল্লাহ-আল-আজিজ জানান, ৩১ শয্যার জনবল কাঠামোতে চলছে ৫০ শয্যার হাসপাতাল। যে কারণে রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। বর্তমানে গাইনী ও এনেসথেসিওলজির কনসালট্যান্ট পদায়ন রয়েছেন। মেডিসিন, পেডিয়াট্রিক্স, সার্জারি ও অর্থোপেডিক্সের কনসালট্যান্টসহ পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ দেয়া হলে কাঙ্খিত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো বলে জানান তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে ডাঃ আবদুল্লাহ-আল-আজিজ জানান, মেডিসিনের কনসালট্যান্ট না থাকায় সাপে-কাটা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয় না। তবে, ভ্যাকসিন কুকুড়ে কামড়ানো রোগীদের সেবা দেয়া হয়।
প্রতিদিনই ঝাড়ু-মোছা দিয়ে হাসপাতাল পরিচ্ছন্ন করা হয়। ব্যবহার করা হয় এন্টিসেপ্টিক। আর প্রতিমাসে একবার পুরো হাসপাতাল ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে দেয়া হয় ভবনের পুরো টাইলস। এ জন্যে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় জনবল নিয়োগ দিয়েছেন তিনি।
হাসপাতাল আঙিনার ফাঁকা জায়গায় কর্মীদের নিয়ে বাগান করেছেন। পুকুর খনন করে সেখানে পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। হচ্ছে মাছের চাষ। উৎপাদিত ফসল ও মাছের একটা অংশ হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়। বাকিটা বিক্রি করে প্রাপ্ত টাকার হাসপাতালের রোগী কলাণ ফান্ডে জমা দেয়া হয়। যেখান থেকে দরিদ্র রোগীদের জন্য ব্যয় করা হয়।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জানান, অফিস সময়ের বাইরে হাসপাতালের আবাসিক এলাকার ডরমেটরিতেই অবস্থান করেন তিনি। সার্বক্ষণিক অবস্থান করায় যেকোন পরিস্থিতিতে হাসপাতালে চলে আসা সম্ভব হয়। এ কারণে অধীনস্থ চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজে উৎসাহ পেয়ে থাকেন বলে বিশ্বাস তাঁর।
প্রসঙ্গত: স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস ৩৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন আটঘরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আবদুল্লাহ-আল-আজিজ। জন্ম নেত্রকোনা সদর উপজেলায়।