রাত ২টা ৩০ মিনিটে রোগীটা মারা গেল
ডা. কাজী মাজহারুল ইসলাম দোলন
রাত ২.৩০ এ রোগীটা মারা গেল।
বয়স প্রায় ৭০, সাথে শুধু স্ত্রী।
জিজ্ঞেস করলাম, বাড়িতে খবর দিয়েছেন?
রোগী তো সন্ধ্যা থেকেই খারাপ ছিলো। কেউ আসেনি?
এরপর এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি হলাম যার জন্য আমার কোন মানসিক প্রস্তুতি ছিল না--
রোগীর দুই ছেলে, বড় জন সৌদি আরব, ছোট ছেলে বাড়িতে। বড় ছেলের জোরাজুরিতেই হাসপাতালে আসা।
ছোট ছেলের আপত্তি অগ্রাহ্য করে কেন হাসপাতালে আনা হলো, এই অপরাধে বৃদ্ধ বাবাকে একবারও দেখতে আসেনি সে।
উল্টো তাকে বাবার খারাপ অবস্থা জানানো হলে তার ভাষ্য ছিলো-
"আমি তো হাসপাতালে নিতে বলি নাই, সৌদি থিকা আইসা বাপেরে দেইখা যাইতে কও"!
জিজ্ঞেস করলাম, আত্মীয় স্বজন?
জানালো কেউ আসবে না, যখন তাদের প্রয়োজন ছিল তখন এসেছে।
এখন লাশ নিতে আসলে যদি দুই পয়সা খরচ করতে হয়!
রাত ২.৩০ এ এই ষাটোর্ধ্ব নারী তার সদ্য প্রয়াত স্বামীকে নিয়ে একটি উপজেলা হাসপাতালের ওয়ার্ডে, সাথে নেই কোন চেনা মুখ!
কল্পনা করতেও বোধহয় কষ্ট হয়!
আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কয়টা বাজে?
আজান দিতে আর কতক্ষণ?
আমি বললাম বেশিক্ষণ না, দুই-আড়াই ঘণ্টা!
ভদ্রমহিলা আমার হাত ধরে ফেললেন-
"আমারে হাসপাতাল থেকে বাইর করে দিয়েন না, সকাল হইলেই ভ্যান নিয়া চইলা যামু"!
শোকার্ত নারীটি যেন ঠিকমতো শোক প্রকাশ করারও সুযোগ পাচ্ছে না। একবার লাশের কাপড় ঠিক করছে, কিছুক্ষণ দোয়া পড়ছে, কিছুক্ষণ আস্তে আস্তে কান্না করছে। আবার একা একা এই লাশ বাড়ি পর্যন্ত কিভাবে নিয়ে যাবে সেটাও বোধহয় আনমনে ভাবছে।
আমি শুধু তার মাথায় হাত রেখে আস্তে করে বলতে পারলাম, "থাকেন। কোন সমস্যা নাই"।
ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে ৭০ বছরের বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম জীবন ঠিক কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে।
শেষ পরিণতি হিসেবে মৃত্যুর পর লাশটা নেওয়ার মানুষটাও নেই।
আহারে জীবন!
এই জীবন নিয়ে আবার কত বড়াই!
অথচ ঠিকমতো দাফন-কাফন পাবো কিনা তারই কোন নিশ্চয়তা নেই!