টেনে টিকার মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে বিতর্ক

অনলাইন ডেস্ক
2022-12-24 14:33:36
টেনে টিকার মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে বিতর্ক

এ ধরনের টিকা প্রয়োগে বহু ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরির আশঙ্কা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন

ফাইজারের টিকার মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার সময় তিন মাস বাড়িয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও টিকাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি কমিটির অনুমোদন এবং পরামর্শেই তারা এটা করেছে বলে জানানো হয়েছে।

তবে টেনে টিকার মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। এভাবে মেয়াদ বাড়ানোর ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বেশ কয়েকজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তাদের মতে, চিঠি দিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ টিকার মেয়াদ বাড়ানোর নজির নেই। এমনটা হয়ে থাকলে এটা অগ্রহণযোগ্য। তা ছাড়া এ ধরনের টিকা প্রয়োগে বহু ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।

২০ নভেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক চিঠিতে বলেছে, ফাইজারের যে টিকার মেয়াদ ৩০-১১-২০২২ লেখা আছে, তা আরও তিন মাস অর্থাৎ ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে। অধিদপ্তরের তখনকার পরিচালক অধ্যাপক ডা. শামসুল হকের সই করা চিঠিতে বলা হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও উৎপাদনকারী সংস্থা ফাইজারের অনুমোদনক্রমে ফাইজার কভিড-১৯ টিকার মেয়াদ ৩০-১১-২০২২ থেকে ২৮-০২-২০২৩ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে।

দেশে ১২ বছরের বেশি বয়সীদের এখন ফাইজারের টিকা দেওয়া চলছে। এই টিকার ভায়ালে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ লেখা আছে ৩০ নভেম্বর ২০২২। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, দেশের কোথাও মেয়াদোত্তীর্ণ করোনার টিকা দেওয়া হচ্ছে না।

ফাইজারের টিকার মেয়াদোত্তীর্ণের বিষয় নিয়ে টিকাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি কমিটি ৫ সেপ্টেম্বর সভা করে। সভার কার্যবিবরণীতে টিকার মেয়াদ তিন মাস বৃদ্ধির অনুমোদন দেওয়া হয়। এদিকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ১১ নভেম্বর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে লেখা চিঠিতে জানায়, ফাইজারের টিকার মেয়াদকাল ১২ মাস।

এর তিন দিন পর কভিড-১৯ ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটির সদস্যসচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (মাতৃ, নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্য) মো. শামসুল হক সারা দেশের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়ে ফাইজারের টিকার মেয়াদ বৃদ্ধির কথা জানান।

২০ ডিসেম্বর থেকে সারা দেশে করোনা টিকার চতুর্থ ডোজ দেওয়া শুরু হয়েছে। চতুর্থ ডোজ হিসেবে মূলত ফাইজারের টিকাই দেওয়া হচ্ছে। দেশের কয়েকটি জায়গায় মেয়াদোত্তীর্ণ টিকা দেওয়া হচ্ছে বলে সাধারণ মানুষ অভিযোগ করেছেন। এই কারণে অনেকে কেন্দ্রে এসে টিকা না নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। তবে অধ্যাপক মো. শামসুল হক বলেছেন, কোথাও মেয়াদোত্তীর্ণ টিকা দেওয়া হচ্ছে না। এই টিকার মেয়াদের ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন আছে।

তবে এভাবে টিকার মেয়াদ বাড়ানোর ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে কডিভ-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘চিঠি দিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ টিকার মেয়াদ বাড়ানোর নজির নেই। এমনটা হয়ে থাকলে এটা অগ্রহণযোগ্য। ফাইজারের মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের টিকায় এমন হওয়ার কথা নয়। মেয়াদোত্তীর্ণ টিকায় যদি মানুষের কোনো অসুবিধা হয়, তাহলে কী হবে? মেয়াদোত্তীর্ণ টিকা নিয়ে মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমনটা করা ঠিক হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘মেয়াদোত্তীর্ণ টিকা ব্যবহারের ফলে বহু ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে। যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। কোনো অথরিটিই (কর্তৃপক্ষ) এটা এক্সটেন্ড করতে পারে না।’

ডব্লিউএইচওর সাবেক এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোনো ভ্যাকসিনের মেয়াদ বাড়ানোর নজির নেই। করোনার মতো ভয়ংকর ভাইরাসের ক্ষেত্রে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে সংস্থার তিনটি কমিটি থাকে, তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে, তারপর এটি কতটা গ্রহণযোগ্য, সে বিষয়ে প্রতিবেদন দেয়। এসব প্রক্রিয়া শেষ করতে দীর্ঘ সময় লাগে। কিন্তু এত অল্প সময়ে কীভাবে অনুমোদন পেয়েছে, আমাদের জানা নেই।

এ বিষয়ে ডব্লিউএইচওর সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মো. মুজাহেরুল হক বলেন, ‘সাধারণত মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়া টিকার মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষেত্রে সংস্থা অনুমোদন দেয় না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) যেসব টিকার মেয়াদ ফুরিয়েছে, তার বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। এতে তারা দেখেছে, মেয়াদ শেষ হওয়ায় টিকাগুলো ৩ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে, তাতে কোনো ধরনের ক্ষতি হবে না। তবে শর্ত থাকে যে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রেখে সঠিক সময়ে ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এসব ফল তারা নিজ দেশের সরকারের পাশাপাশি ডব্লিউএইচওর কাছেও দেয়। কিন্তু ডব্লিউএইচওর ওয়েবসাইট ঘেঁটে এমন কিছু আমি পাইনি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টিকা বা ওষুধের যে মেয়াদ লিখে দিয়েছে, তা পেরিয়ে যাওয়ার পর প্রয়োগ করা কোনোভাবেই উচিত নয়। মেয়াদোত্তীর্ণ টিকা ব্যবহারের ফলে কী ধরনের ক্ষতি হবে, সেটা পূর্বানুমান করে বলা মুশকিল। এটা নিলে কেউ মরে যাবে বা এটা কাজে লাগবে, এমনটা বলা যাবে না। তবে এটা কারোরই গ্রহণ করা উচিত নয়।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘কোনো টিকা বা ওষুধের গায়ে মেয়াদ লেখা থাকে; কারণ মেয়াদ শেষে এটা মানুষের শরীরে ব্যবহার উপযোগী না। যদি ব্যবহার করা যেত, তাহলে টিকার শিশিতে লেখা থাকত, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার তিন মাস পরেও ব্যবহার করা যাবে। মেয়াদ শেষে এটা ব্যবহারের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ টিকা ব্যবহারে অবশ্যই আশঙ্কার জায়গা রয়েছে।’

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) অন্যতম পরামর্শক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে কিছুদিন হাতে রেখে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ দেওয়া হয়। মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে বলে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচিত জনসাধারণের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট করা। গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে সবাইকে জানানো।’


আরও দেখুন: