‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ডকে মাথায় রেখেই মেডিকেল কারিকুলাম তৈরি হয়’
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের (শজিমেক) অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. রেজাউল আলম জুয়েল
আন্তর্জাতিক মানদণ্ডকে মাথায় রেখেই দেশে মেডিকেলের কারিকুলাম তৈরি করা হয় বলে জানিয়েছেন শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের (শজিমেক) অধ্যক্ষ ও প্রখ্যাত অর্থপেডিক সার্জন অধ্যাপক ডা. রেজাউল আলম জুয়েল। সম্প্রতি ডক্টর টিভির সঙ্গে একান্ত আলাপে এ তথ্য জানান তিনি। আলাপে মেডিকেল শিক্ষার সম্ভাবনা, সীমাবদ্ধতাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন এই চিকিৎসক গড়ার কারিগর। বলেন, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলো।
চিকিৎসা শিক্ষা আধুনিকায়ন প্রসঙ্গঃ
চিকিৎসা শিক্ষা আধুনিকায়ন সম্পর্কে শজিমেকের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. রেজাউল আলম জুয়েল বলেন, আমাদের মেডিকেল শিক্ষা ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড এর। এই কারিকুলাম প্রস্তুত করে বিএমডিসি। যা প্রতি ৫ বছর পর পর আপডেট করা হয়। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর এবং সেন্টার ফর মেডিকেল এডুকেশন – এদের সহায়তা নিয়েই বিএমডিসি কাজটা করে থাকে। পৃথিবীর উন্নত দেশের মেডিকেল শিক্ষা, কারিকুলাম দেখেই আমাদের কারিকুলাম তৈরি করা হয়।
বিনয়ী ও মানবিক ডাক্তার তৈরিতে বিশেষ কারিকুলাম যুক্তঃ
কথার ধারাবাহিকতায় অধ্যাপক ডা. রেজাউল আলম জুয়েল জানান, সম্প্রতি ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ থেকে মেডিকেল কারিকুলাম অনেক আপডেট হয়েছে। এতে নতুন অনেক বিষয় যুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে ইন্টিগ্রেটেড টিচিং ও জেনেরিক টপিকস। এমবিবিএস এর প্রতিটি ফেজেই বিষয়গুলোর ওপর পাঠ দেয়া হবে।
তিনি আবেগী ভাষায় বলেন, একজন এমবিবিএস স্টুডেন্ট ৪টি প্রফ পাস করলো। এরপর বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন নিয়ে প্র্যাকটিসের সুযোগ পেতে পারে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই একজন ভাল ডাক্তার হয়ে যাবে- বিষয়টা কিন্তু সে রকম নয়। সার্টিফিকেট অর্জনের পাশাপাশি- মানুষ হিসেবে বেশকিছু মানবিক বিষয় তাকে অর্জন করা দরকার। যেহেতু মানুষ নিয়ে আমাদের ডিল করতে হয়। এজন্য একজন চিকিৎসককে অবশ্যই ভদ্র, বিনয়ী, সৎ, মানুষের প্রতি নিবেদিত ও আন্তরিক ইত্যাদি অনেকগুলি মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন হতে হবে।
এক কথায়- রাষ্ট্রীয় ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে যেভাবে মানুষের সাথে সদয় হওয়া দরকার, একজন পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসক হতে গেলে সেসব মানবিক গুণাবলী অর্জন করতে হবে। এবারের কারিকুলামে সবগুলো বিষয় আনা হয়েছে। যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডকে মাথায় রেখেই ঠিক করা হয়েছে।
হাসপাতালে অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে বিশেষ পাঠঃ
শজিমেকের অধ্যক্ষ বলেন, মেডিকেলের নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের আচরণগত বিষয় শেখানো হবে। এরফলে তারা জানতে পারবেন ডক্টর-রোগী সম্পর্ক কেমন হবে, কিংবা অন্যান্য স্টাফের সাথে ডক্টরের সম্পর্ক কেমন হবে। যদিও এ বিষয়গুলো এতদিন ইনফরমালি শেখানো হতো। এখন মেডিকেলের অন্যান্য লেখাপড়ার পাশাপাশি এ বিষয়গুলোও প্রথম থেকেই তাদের জানানো হবে। এর ফলে চিকিৎসক হিসেবে যখন বের হবেন- তখন তারা মানসিকভাবেও প্রস্তুত থাকবেন। ফলে রোগী ব্যবস্থাপনায় তাদের বাড়তি কষ্ট বা অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না বলে বিশ্বাস করি।
মেডিকেল কলেজের অভিভাবক হিসেবে কতটা সন্তুষ্টঃ
নিজেকে শতভাগ সন্তুষ্ট বলবো না। চেষ্টা সত্ত্বেও কিছু না কিছু ঘাটতি তো আছেই। যেমনঃ বেসিক সাবজেক্টে শিক্ষক ঘাটতি রয়ে গেছে। এটা সারাদেশের মেডিকেল কলেজের বাস্তবতা। তাছাড়া স্টাফ সংকট আছে। হোস্টেলগুলোর সুবিধা ও নিরাপত্তা বাড়াতে আমাদের যে পরিমাণ স্টাফ দরকার তা নেই, এখানে বিশাল সঙ্কট রয়ে গেছে। তবে, এটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।
সামগ্রিকভাবে আমাদের অবকাঠামোও বর্ধিত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ বর্তমানে আমাদের ১৮০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। অথচ অবকাঠামো এখনো অনেক ক্ষেত্রে ৫০ জনেরই রয়ে গেছে। বিশেষ করে টিউটোরিয়ালের মত গ্রুপভিত্তিক ক্লাসগুলোতে স্থান সংকুলান করতে সমস্যা হয়।
এদেশে মেডিকেল শিক্ষার ইতিহাসঃ
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের এখানে আধুনিক অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার ইতিহাস বেশি দিনের না। ১৯৪৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের যাত্রা।
আমি বিশ্বাস করি, আমরা ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করেই আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বা স্বাস্থ্য শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে পেরেছি। প্রমাণ হিসেবে, আমাদের অনেক সহপাঠী পৃথিবীর অন্যান্য দেশে গিয়ে সুনামের সাথে নিজ নিজ অবস্থান তৈরি করেছেন। তেমনিভাবে আমরা যারা শিক্ষক হয়েছি, তারাও কিন্তু নিজেদের মানকে উন্নত করতে চেষ্টা চালাচ্ছি। সে জন্যই বলবো, আমাদের মেডিকেল শিক্ষার মানকে সবসময়ই একটা আন্তর্জাতিক মানে রাখতে পেরেছি। বিশেষ করে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আমাদের মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যখাত অনেক উন্নত হয়েছে।
শজিমেকের আধুনিকায়নঃ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসকে অনেক আপডেট করা সম্ভব হয়েছে। ১৩টি নতুন সাবজেক্ট চালু হয়েছে। এখানে শুধু এমবিবিএস ডিগ্রিই দেয়া হচ্ছে না, বরং এমডি মেডিসিন, এমফিল ফিজিওলজিসহ ৮টি বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কোর্স চালু আছে।
সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ভালো ডাক্তার তৈরির উদ্যোগঃ
মেডিকেল শিক্ষা কেবল বই পড়ে হয় না। একটা ভাল হাসপাতাল ছাড়া ভালো ডাক্তার তৈরি করা সম্ভব না। রোগীদের অবস্থা দেখে-শুনে বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে তবেই একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী ভালো ডাক্তার হতে পারেন। রোগী না থাকলে ভালো চিকিৎসক গড়ে উঠবে না। এ জন্য মেডিকেল কলেজে নতুন নতুন সাবজেক্ট খোলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক এসেছেন, বিভাগগুলোতে রোগী ভর্তি হচ্ছে। এককথায়, একজন পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসক হিসেবে গড়ে উঠতে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা দরকার, তা প্রায় পরিপূর্ণভাবেই পাচ্ছে।
আশার কথা হচ্ছে, আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য হোস্টেল সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। অডিটোরিয়ামের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। খেলাধুলার জন্য ফুটবল মাঠ, বাস্কেট বল ও ব্যাডমিন্টন গ্রাউন্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পড়ালেখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য আমারা এক্সট্রা কারিকুলাম সুবিধা দিতে সচেষ্ট আছি। এটা অতি জরুরি বলে বিশ্বাস করি। কারণ, মেডিকেল শিক্ষা অনেক বড় কারিকুলাম। ইন্টারমিডিয়েট লাইফ যে পরিমাণ পড়ালেখার চাপ ছিল, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পড়ালেখা করতে হয় তাদের। শুরুতে অনেকে ভেঙে পড়ে। এটা আমাদের সময়েও হয়েছে।
ক্যাম্পাসে যেন শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম করতে পারে, তার ব্যবস্থা রেখেছি। বিশেষ দিবস উপলক্ষে আমরা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করি। শিক্ষার্থীরা সন্ধানী, মেডিসিন ক্লাব, ডিবেটিং সোসাইটি সহ বিভিন্ন ভলান্টারি সংগঠনের কাজেও জড়িত। এসব কর্মকান্ড মানসিক চাপ সামলাতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।
নিজের পরিচয় পড়ালেখা সম্পর্কে যা জানানঃ
অধ্যাপক ডা. রেজাউল আলম জুয়েল। জন্ম ১৯৬৭ সালে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার দহিলা গ্রামে। প্রাথমিকের পাঠ গ্রামের স্কুলে, দহিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৮৩ সালে এসএসসি পাস করেন শিবগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। ৫ বিষয়ে লেটার মার্কসহ ৭৩৬ নাম্বার পান। উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে ভাল ও বাংলাদেশের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৮৫-তে এইচএসসি পাস করেন। ২ বিষয়ে লেটার মার্কসসহ ৭৩৩ মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯৮৬ সেশনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৯২-তে এমবিবিএস কমপ্লিট করেন। ১৯৯৩ সালে ইন্টার্নশিপ সম্পন্ন করেন।
এরপর বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেন। ১৫তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন ১৯৯৫ এর ১৫ ই নভেম্বরে। শুরুতে বিভিন্ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ইউনিয়ন সাব সেন্টার ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ করেন। এরপর মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে। পরবর্তীতে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের যাত্রা শুরু হলে সেখানে ইএমও হিসেবে যোগদান করেন।
২০০২ সালে বরগুনা সদর হাসপাতালে বদলী হয়ে হন। অল্পদিনের ব্যবধানে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। বছরখানেক পর ২০০৩-০৪ সেশনে অর্থপেডিক্সে এমএস কোর্সে ভর্তির সুযোগ পান। এমএস ডিগ্রির প্রথম পর্ব শেষ করার পর রংপুর মেডিকেল কলেজের অর্থপেডিক বিভাগে সহকারি রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগদান করেন। এরপর এমএস কোর্স সম্পন্ন করতে ফের নিটোরে যান। ২০০৭ সালে এমএস কোর্স সম্পন্ন করেন। এরপর বগুড়া সদরের মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে সহকারী রেজিস্ট্রার অর্থ-সার্জারি হিসেবে যোগ দেন।
২০০৯ সালে জুনিয়র কনসালটেন্ট হিসেবে আদমদীঘী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জুনিয়র কনসালটেন্ট (অর্থপেডিক সার্জন) হিসেবে পদায়িত হন। একই বছরে সহকারী অধ্যাপক (চলতি দায়িত্ব) হিসেবে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে যোগ দেন। ২০১৫ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। এরপর ২০২০ সাল থেকে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
নিজ কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ২৭ বছরের চাকরি জীবনে চিকিৎসক হিসেবে সব ধরনের অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পেয়েছি। চাকরির বিভিন্নধাপে চিকিৎসক, শিক্ষক ও প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি ও করছি।