‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ডকে মাথায় রেখেই মেডিকেলের কারিকুলাম তৈরি হয়’

ইলিয়াস হোসেন :
2022-12-05 15:20:00
‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ডকে মাথায় রেখেই মেডিকেলের কারিকুলাম তৈরি হয়’

শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের (শজিমেক) অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. রেজাউল আলম জুয়েল

আন্তর্জাতিক মানদণ্ডকে মাথায় রেখেই দেশে মেডিকেলের কারিকুলাম তৈরি করা হয় বলে জানিয়েছেন শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের (শজিমেক) অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. রেজাউল আলম জুয়েল। সম্প্রতি ডক্টর টিভির সঙ্গে একান্ত আলাপে এ তথ্য জানান তিনি। আলাপে মেডিকেল শিক্ষার সম্ভাবনা, সীমাবদ্ধতাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন এই চিকিৎসক গড়ার কারিগর। বলেন, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলো। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর এবং সেন্টার ফর মেডিকেল এডুকেশন – এদের সহায়তা নিয়েই বিএমডিসি এ কাজটা করে থাকে।

চিকিৎসা শিক্ষা আধুনিকায়ন প্রসঙ্গ :

চিকিৎসা শিক্ষা আধুনিকায়ন সম্পর্কে শজিমেকের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. রেজাউল আলম জুয়েল বলেন, আমাদের মেডিকেল শিক্ষা ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড এর। এই কারিকুলাম প্রস্তুত করে বিএমডিসি। যা প্রতি ৫ বছর পর পর আপডেট করা হয়। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর এবং সেন্টার ফর মেডিকেল এডুকেশন – এদের সহায়তা নিয়েই বিএমডিসি কাজটা করে থাকে। পৃথিবীর উন্নত দেশের মেডিকেল শিক্ষা, কারিকুলাম দেখেই আমাদের কারিকুলাম তৈরি করে থাকেন। 

বিনয়ী ও মানবিক ডাক্তার তৈরিতে বিশেষ কারিকুলাম যুক্ত :

কথার ধারাবাহিকতায় অধ্যাপক ডা. রেজাউল আলম জুয়েল জানান, রিসেন্টলি ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ থেকে মেডিকেল কারিকুলাম অনেক আপডেট হয়েছে। এতে নতুন অনেক বিষয় যুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে ইন্টিগ্রেট টিচিং ও জেনেরিক টপিং। এমবিবিএস এর প্রতিটি ফেজেই বিষয়গুলোর ওপর পাঠ দেয়া হবে।

তিনি আবেগী ভাষায় বলেন, একজন এমবিবিএস স্টুডেন্ট ৪টি প্রফ পাস করলো। এরপর বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন নিয়ে ডাক্তারি করার সুযোগ পেল। এর সঙ্গে সঙ্গেই সে একজন ভাল ডাক্তার হয়ে গেল- বিষয়টা কিন্তু সে রকম নয়। এসব সার্টিফিকেট অর্জনের পাশাপাশি, মানুষ হিসেবে বেশকিছু মানবিক বিষয় তাকে অর্জন করা দরকার। যেহেতু মানুষ নিয়ে আমাদের ড্রিল করতে হয়। একজন চিকিৎসককে অবশ্যই ভদ্র, বিনয়ী, সৎ, মানুষের প্রতি নিবেদিত ও  আন্তরিক ইত্যাদি অনেকগুলি মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন হতে হয়। এক কথায়- রাষ্ট্রীয় ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে যেভাবে মানুষের সাথে সদয় হওয়া দরকার, একজন পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসক হতে গেলে সেসব মানবিক গুণাবলী অর্জন করতে হয়। এবারের কারিকুলামে সবগুলো বিষয় আনা হয়েছে। সেই জিনিসগুলোর উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডকে মাথায় রেখেই মেডিকেল কারিকুলাম করা হয়েছে।

হাসপাতালে অনাকাঙ্খিতত ঘটনা এড়াতে বিশেষ পাঠ :

শজিমেকের অধ্যক্ষ বলেন, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বিহেভেরিয়াল চেঞ্জ কারিকুলাম (বিসিসি) এই বিষয়ে নতুন কারিকুলামে সংযোজন করা হয়েছে। এই জিনিসগুলো ৪টা ফেজেই আসবে। ৫ বছর ধরেই তাদেরকে এটা শিক্ষা দেয়া হবে। ডক্টর-রোগী সম্পর্কটা আসলে কেমন হবে, অন্যান্য স্টাফের সাথে ডক্টরের সম্পর্কটা কেমন হবে- এই নতুন কারিকুলামে ফরমালি শেখানো হবে। এতদিন যা ইনফরমালি ছিলো। রিসেন্ট যেই কারিকুলাম, সেখানে যেহেতু এই টপিকগুলো আছে, এ কারণে আমরা ফার্স্টইয়ার থেকেই তাদের বিষয়গুলো শেখাতে পারবো। মেডিকেলের অন্যান্য লেখাপড়ার পাশাপাশি আচরণগত বিষয়গুলোও প্রথম থেকেই তাদের মাথায় ঢুকবে এবং চিকিৎসক হিসেবে যখন বের হবে- তখন আমি বিশ্বাস করি যে, মানসিকভাবে তারা প্রস্তুত থাকবে। ফলে রোগী ও স্বজনদের সাথে চিকিৎসকদের সামলাতে তাদের বাড়তি কষ্ট বা অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না। এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ভবিষ্যতে আর না-ও ঘটতে পারে।

মেডিকেল কলেজের অভিভাবক হিসেবে কতটা সন্তুষ্ট:

নিজেকে শতভাগ সেটিসফাইড বলবো না। চেষ্টা সত্ত্বেও কিছু না কিছু ঘাটতি তো আছেই। যেমন : বেসিক সাবজেক্টে শিক্ষক ঘাটতি রয়ে গেছে। এটা সারাদেশের মেডিকেল কলেজের বাস্তবতা। তাছাড়া স্টাফ সংকট আছে। হোস্টেলগুলোর সুবিধা ও নিরাপত্তা বাড়াতে আমাদের যে পরিমাণ স্টাফ দরকার তা নেই। এখানে বিশাল সঙ্কট রয়ে গেছে। তবে, এটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। মন্ত্রণালয় থেকে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোক নেয়ার অনুমোদন দিয়েছে। আশা করছি, অচিরেই এ সমস্যা আর থাকবে না।

সামগ্রিকভাবে আমাদের ইনফ্রাস্টাকচারও বর্ধিত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ বর্তমানে  আমাদের ১৮০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। অথচ অবকাঠামো এখনো ৫০ জনেরই রয়ে গেছে। বিশেষ করে টিউটোরিয়ালগুলো যেখানে ভাগ করে করে গ্রুপওয়াইজ ক্লাস করানো হয়, সেসব ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যা হয়।

 

২৭ বছরের চাকরি জীবনে চিকিৎসক হিসেবে সব ধরনের অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পেয়েছি। চাকরির বিভিন্নধাপে চিকিৎসক, শিক্ষক ও প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি বা করছি।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের এখানে আধুনিক অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার ইতিহাস বেশি দিনের না। ১৯৪৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের যাত্রা। ৭৪ বছরের ইতিহাস।
আমি বিশ্বাস করি, আমরা ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করেই আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বা স্বাস্থ্য শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে পেরেছি। প্রমাণ হিসেবে, আমাদের অনেক সহপাঠি পৃথিবীর অন্যান্য দেশে গিয়ে সুনামের সাথে নিজ নিজ অবস্থান তৈরি করেছে। তেমনিভাবে আমরা যারা শিক্ষক হয়েছি, তারাও কিন্তু নিজেদের মানকে উন্নত করতে পেরেছি। সে জন্যই বলবো আমরা আমাদের মেডিকেল শিক্ষার মানকে সবসময়ই একটা আন্তর্জাতিক মানে ধরে রাখতে পেরেছি। বিশেষ করে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সাল থেকে ক্ষমতায় আসার পর আমরা আমাদের মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যখাততে অনেক উন্নত করতে পেরেছি।

শজিমেকের আধুনিকায়ন : 

প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেলকেও অনেক আপডেট করতে পেরেছি। আমরা ১৭টি নতুন সাবজেক্ট খুলতে পেরেছি। শুধু এমবিবিএস ডিগ্রিই দিচ্ছি না, আমাদের ৮টি বিষয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্স চালু করেছি। এমডি মেডিসিন, এমফিল ফিজিওলজিসহ কয়েকটি বিষয়ে ডিপ্লোমা কোর্স চালু করেছি।

মেডিকেল শিক্ষা কেবল বই পড়ে হয় না। একটা ভাল হাসপাতাল ছাড়া ভাল ডাক্তার হিসেবে গড়ে সম্ভব না। রোগীদের অবস্থা দেখে, শুনে বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে তবেই একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী ভাল ডাক্তারি বিদ্যা অর্জন করতে পারে। রোগী না থাকলে ভাল চিকিৎসক গড়ে উঠবে না। আমরা আমাদের মেডিকেল কলেজে নতুন নতুন সাবজেক্ট খুলতে পেরেছি, ঐ বিষয়ের শিক্ষক এসেছেন, ঐ বিভাগে রোগী ভর্তি হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা তাদেরকে বাস্তবে দেখতে পারছে। এভাবেই, সামগ্রিকভাবে একজন পুর্ণাঙ্গ চিকিৎসক গড়ে উঠতে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা দরকার। তা মোটামুটি পরিপূর্ণভাবেই আমরা দিতে পারছি। তবে, এটা বলবো না যে, আমরা শতভাগ সুযোগ-সুবিধা দিতে পারছি। আমাদের বেশকিছু দুর্বলতা আছে।
প্রতিষ্ঠার সময়ে প্রতি সেশনে মাত্র ৫০ জন ছাত্র ভর্তির অনুমোদন ছিল। অবকাঠামো ও সুযোগ সুবিধাও সে রকমই এখানে রয়েছে। বর্তমানে প্রতি সেশনে ১৮০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। কিন্তু সুযোগ সুবিধা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আগের মতই রয়ে গেছে।

তবে, আশার কথা হচ্ছে, আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা হোস্টেল সুবিধা নিশ্চিত করতে পেরেছি। অডিটোরিয়ামের কাজ শেষ পর্যায়ে। শহীদ মিনার নির্মাণ করতে পেরেছি। খেলাধুলার জন্য বাস্কেট বল গ্রাউন্ড, ব্যাডমিন্টন গ্রাউন্ড করেছি। তাদের পড়ালেখার পাশাপাশি এক্সট্রা অর্ডিনারি কারিকুলাম সুবিধা দিতে সচেষ্ট আছি। এটা এজন্য জরুরি কারণ, মেডিকেল শিক্ষা অনেক বড় কারিকুলাম। ইন্টারমিডিয়েট লাইফ যে পরিমাণ পড়ালেখার চাপ ছিল, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পড়ালেখা করতে হয় তাদের। শুরুতে অনেকে ভেঙে পড়ে। এটা আমাদের সময়েও হয়েছে।

চাপ সামলাতে পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম যাতে করতে পারে, তার ব্যবস্থা রেখেছি। বিশেষ দিবস উপলক্ষে আমরা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করি। শিক্ষার্থীরা সন্ধানী মেডিসিন ক্লাবসহ বিভিন্ন ভলান্টারি সংগঠনের কাজেও তারা জড়িত। এসব কর্মকান্ড মানসিক চাপ সামলাতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।

নিজের পরিচয় সম্পর্কে যা জানান : 

ডা. রেজাউল আলম জুয়েল। জন্ম ১৯৬৭ সালে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার দহিলা গ্রামে। প্রাথমিকের পাঠ গ্রামের স্কুলে। দহিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৮৩ সালে এসএসসি পাস করেন শিবগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। ৫ বিষয়ে লেটার মার্কসহ ৭৩৬ নাম্বার পান। এইচএসসি পাস করেন ১৯৮৫তে- উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে ভাল ও বাংলাদেশের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী কলেজ থেকে। ২ বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর রাজশাী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন ৮৬ সেশনে। ১৯৯৩তে এমবিবিএস কমপ্লিট করেন।  এরপর ১৯৯৫ সালে ২ বছরের ইন্টার্নশিপ সম্পন্ন করেন। 

একই বছর বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেন। ১৫তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরিতে জয়েন করেন। শুরুতে বিভিন্ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ইউনিয়ন সাব সেন্টার ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ করেন। এরপর মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করেন বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে। পরবর্তীতে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের যাত্রা শুরু হলে সেখানে ইএমও হিসেবে যোগদান করেন। 

২০০২ সালে বরগুনা সদর হাসপাতালে বদলী হয়ে হন। অল্পদিনের ব্যবধানে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে বদলী হন। একবছর পর অর্থপেডিক্সে এমএস কোর্সে ভর্তির সুযোগ পান। ২০০৩-০৪ সেশনে ভর্তি হন। এমএস ডিগ্রির প্রথম ফেজ শেষ করার পর রংপুর মেডিকেল কলেজের অর্থপেডিক বিভাগে সহকারি রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগদান করেন। এরপর এমএস কোর্স সম্পন্ন করতে ফের নিটোরে যান। ২০০৭ সালে এমএস কোর্স সম্পন্ন করেন। এরপর বগুড়া সদরের মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে সহকারী রেজিস্ট্রার সার্জারি হিসেবে যোগ দেন। 

২০০৯ সালে জুনিয়র কনসালটেন্ট হিসেবে আদমদীঘী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জুনিয়র কনসালটেন্ট (অর্থপেডিক সার্জন) হিসেবে পদায়িত হন।

২০১১ তে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে যোগ দেন। ২০১৫ তে সহযোগী অধ্যাপক হন। এরপর ২০২০ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। 


আরও দেখুন: