কোন শিক্ষিত বিবেকবান মানুষ এই কাজ করতে পারে না

ডা. মানফাতুল ইসলাম মুহিব
2022-10-20 11:53:04
কোন শিক্ষিত বিবেকবান মানুষ এই কাজ করতে পারে না

রামেক হাসপাতালে রাবির কতিপয় উশৃঙ্খল শিক্ষার্থীর হামলা ও ভাংচুর

দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষার্থীরা আজকের ঘটনার সাথে জড়িত। আপনাদের বন্ধুর অকাল মৃত্যুতে আমি দুঃখ প্রকাশ করে ও তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেই কিছু কথা বলি। আপনাদের মাথা ঠান্ডা হলে বিষয়গুলো ভেবে দেখবেন।

একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হঠাৎ করে ৪ তলা থেকে পড়ে গেলেন। কেন? এক্সিডেন্ট, সুইসাইড না হোমিসাইড এটা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা দেখলাম না!! ঠিক আছে।

রোগীর সিভিয়ার হেড ইনজুরি, প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। হেমোরেজিক শকেই আপনাদের বন্ধু মারা গেছেন।

আপনাদের এতো বড় স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে ইমার্জেন্সি বেসিসে ব্লাড বা ফ্লুইড দিয়ে নিয়ে আসতে তো পারতেন। সেখানে সময় মতো এই সামান্য পদক্ষেপ নিলে হয়তো আপনাদের বন্ধু বেঁচেও যেতে পারতো। কই কোনদিন তো দেখলাম না, আপনারা আপনাদের ভিসির বাসা ঘেরাও করে আপনাদের নিজেদের মেডিকেল সেন্টারের লিমিটেশনগুলো সংশোধনের দাবি জানালেন!! যতদূর শুনেছি, আপনাদের বন্ধুর জন্য ভার্সিটির আইসিইউ এম্বুলেন্সও ম্যানেজ করতে পারেন নাই বা পারলেও অনেক দেরিতে। আপনাদের নিজেদের ক্যাম্পাসের এই অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার জন্য কোথায় কোথায় ভাঙচুর চালালেন জানাবেন!! ঠিক আছে।

এরপর আসি আমাদের হসপিটালে। আপনাদের অভিযোগ, ইমারজেন্সিতে নাকি টাকা চাইছে, ৪৫ মিনিট দেরি করাইছে। ভাই, আপনারা শিক্ষিত মানুষ হয়ে যদি গণ্ডমূর্খের মতো কথা বলেন, তাহলে তো মুশকিল। আপনি, আমি, সাধারণ মানুষ যেই ভর্তি হোক ১৫/- দিয়ে টিকিট কেটেই ভর্তি হতে হবে। সেখানে ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার প্রাথমিকভাবে দেখে রোগীর সুচিকিৎসার জন্য উপযুক্ত ওয়ার্ডে রেফার করবেন। এটাই প্রোটোকল। আমার, আপনার- সবার এই প্রোটোকল মেনেই চিকিৎসা নিতে হবে। বাংলা সিনেমার মতো আপনি ইমারজেন্সিতে আসলেন, আর আপনাকে ওটিতে নেওয়া হলো। বিষয়টা এমন না। সবকিছুরই একটা সিস্টেম আছে। আপনার এই সিস্টেম পছন্দ না হলে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে যান। যারা এই সিস্টেম প্রবর্তন ও সংশোধনের এখতিয়ার রাখেন। তা না করে আপনারা কি করলেন? হাসপাতালে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালালেন। ভাঙচুর করলেন। আমাদের উপর চড়াও হলেন, হেনস্তা করলেন, অকথ্য ভাষায় আমাদের গালাগালি করলেন। গায়ে হাতও তুললেন!! ঠিক আছে।

এরপর আপনাদের অভিযোগ আইসিইউ নিয়ে। এবার সেখানে আসি। ইমার্জেন্সি থেকে কেন আইসিইউতে পাঠানো হলো না? আইসিইউ কারো মামা বাড়ি না যে, চাইলাম আর রোগী নিয়ে ঢুকে পড়লাম। হাসপাতালে ১ দিন এসে আইসিইউ এর বেড সম্পর্কে একটু খোঁজ খবর নিয়ে যাবেন। সব ধারণা পরিস্কার হয়ে যাবে। কতো যে মুমূর্ষু রোগী একটা আইসিইউ বেড পাওয়ার আশায় সিরিয়াল দিয়ে বসে আছে, সময় করে একদিন এসে খোঁজ নিয়ে যাবেন। তো ওই অবস্থায় রোগীর জন্য আইসিইউ সিরিয়ালের চেয়ে ওয়ার্ডে শকের ম্যানেজমেন্ট করাই নিশ্চয় রোগীর জন্য শ্রেয়। তাই প্রোটোকল অনুযায়ী রোগীকে আগে ওয়ার্ডেই পাঠানো হয়। এক্ষেত্রেও তাই করা হয়েছে। এখন যদি বলেন- কেন আইসিইউ বেড পর্যাপ্ত নয়? কেনো সিস্টেমটা ওরকম নয়- এরকম?

তাহলে আমি আগেই বলেছি, আমরা চিকিৎসক। চিকিৎসা দেওয়া আমাদের কাজ। নীতিনির্ধারন করা আমাদের কাজ নয়। আপনারা তাদের শরনাপন্য হন। আমাদের উপর কেনো আগ্রাসন চালালেন? আমরা দুর্বল, কোনো প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই, তাই? ঠিক আছে।

আপনাদের শেষ অভিযোগে আসি। ওয়ার্ডে নেওয়ার পরও নাকি কোনো ডাক্তার দেখেন নাই। কোন চিকিৎসা দেওয়া হয় নাই!! আমার আজ সেই ওয়ার্ডেই নাইট ডিউটি ছিলো। আমার সহকর্মী সেই ওয়ার্ডেই ইভিনিং ডিউটিতে ছিলো। ৮.৩০ টায় আপনারা রোগীকে নিয়ে নিউরোসার্জারী ওয়ার্ডে যান। আর ঘটনাটি জানার ১০ মিনিটের মধ্যেই আমিও উপস্থিত হয়ে পুরো বিষয়টা স্বচক্ষে দেখি। তাকে হেমোরজিক শক ম্যানেজমেন্টের জন্য হার্টসল ফ্লুইড রানিং দেওয়া ছিলো, অক্সিজেন দেওয়া ছিলো, কটসন, এড্রেনালিন ইনজেকশন দেওয়া ছিলো। ওয়ার্ডে পেসেন্ট রিসিভ করার সময়ই তার ভাইটালস পাওয়া যায় নাই। এরপরেও কর্তব্যরত ইন্টার্ণ চিকিৎসক যতটুকু করার সাধ্যমতো করেছে, আইসিইউ কলও লিখেছে। ততক্ষণে পেসেন্ট অলরেডি মারা গেছেন।

এতকিছু করার পরও আপনারা বলছেন, কোন ডাক্তারই দেখে নাই!! কোন চিকিৎসাই নাকি পায় নাই!! ইন্টার্ণ চিকিৎসক বার বার ডাক্তার পরিচয় দেওয়ার পরও আপনারা সেটি অস্বীকার করে বলেন," তুই ইন্টার্ন, তুই ডাক্তার না, তোর ডাক্তারকে ডাক "। আপনাদের প্রোফেশনে ইন্টার্ন বলতে কি বুঝায় সেটি আমার জানা নাই, তবে আমার প্রোফেশনে ইন্টার্ন ডক্টর মানে পুরোপুরিই ডাক্তার। একটু কমও না একটু বেশিও না। ডাক্তার হিসেবেই ১ বছরের ট্রেনিং পিরিয়ড। রোগীকে অত্র হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার পুরো অথোরিটি আমার আছে। জ্ঞানের ঘাটতি থাকলে পরিচিত কেউ এই প্রোফেশনে থাকলে জেনে নিবেন।

এরপর আসি, আপনারা যা করলেন সেটি স্মরণ করাই। লেডি ডক্টরকে একা পেয়ে বাজে ভাষায় গালাগালি করেন। গায়ে হাত তোলা বাদে যাবতীয় সব ভাবে তাকে হেনস্তা করতে থাকেন। আমি খবর পাওয়া মাত্রই সেখানে আসার পর আমার উপরেও চড়াও হন। এরপর ঘটনাস্থলে আমাদের সহকর্মী আর সিনিয়র ডাক্তার যারাই আপনাদের সাথে কথা বলতে এসেছেন, সবার সাথে গালিগালাজসহ চূড়ান্ত ন্যাক্কারজনক আচরণ  করেন। এমনকি গায়েও হাত তোলেন।

ইমারজেন্সি, নিউরোসার্জারী ওয়ার্ডসহ হাসপাতালের বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর করেন। ওই ওয়ার্ডে আপনার রোগী ছাড়াও আরও ১০০ জনের বেশি মুমূর্ষু রোগী আছে। পুরো হাসপাতালে ৩-৪ হাজার রোগী আছে। তাদের কথা একটি বারও ভাবলেন না। ইমার্জেন্সি বন্ধ করে রাখলেন। আপনার মতো কারো বন্ধু বা ভাই এমন মুমূর্ষু অবস্থায় এসে বিনা চিকিৎসায় মারা গেলে তার জন্য কে দায়ী থাকবে? এগুলো কোন শিক্ষিত বিবেকবান মানুষের কাজ হতে পারে না।

প্রিয়জনের অকাল মৃত্যু আমাদের কারোরই কাম্য নয়। আমরা দিন-রাত হাসপাতালে পরে থাকি আপনাদের জন্য। হিংসাত্মক মনোভাব দূরে রেখে কখনো সময় পেলে হাসপাতালে এসে দেখবেন, হাজারো লিমিটেশনের মধ্যেও আমরা কতখানি চেষ্টা করি আপনাদের সুস্থতার জন্য। চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে রোগী ঘরে ফিরলে যতোটা স্বস্তি আপনি রোগী বা রোগীর লোক হিসেবে পাবেন ততোটাই আমরা চিকিৎসক হিসেবেও পাই।

তাই অযথা অযৌক্তিক কারণে আমাদের নির্যাতন করতে আসবেন না। আমরাও মানুষ। আপনাদের আন্তরিক ব্যবহার যেমন আমাদের সুচিকিৎসা দিতে অনুপ্রেরণা যোগায়, ঠিক তেমনি আপনাদের এমন পশুত্বের পরিচয় আমাদেরও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবে।

ভালো থাকবেন রাবির ভাইয়েরা।


আরও দেখুন: