খাবার লবণে ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিক!

অনলাইন ডেস্ক
2022-10-18 19:57:39
খাবার লবণে ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিক!

খাদ্য লবন

বহুলভাবে বাজারজাতকৃত ৫টি ব্র্যান্ডের খাবার লবণে মাইক্রোপ্লাস্টিক উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য ও সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের একদল গবেষক।  

জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ গবেষণা কর্ম পরিচালনা করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য ও সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন একই বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আস-আদ উজ্জামান নুর এবং পার্থ বণিক।

গবেষকগণ ৫টি ব্র্যান্ডের লবণের ১৫টি নমুনা ও কক্সবাজারে অবস্থিত ১৫টি লবণ উৎপাদনকারী খামার থেকে অপরিশোধিত ৪৫টি নমুনা সংগ্রহ করে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসরণ করে পরীক্ষা করেন।

পরীক্ষায় দেখা যায়, বাজারজাতকৃত পরিশোধিত লবণের প্রতি কেজিতে ১৫৭ টি ও অপরিশোধিত লবণে ১৯৫ টি মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। যেটা অন্যান্য দেশের তুলনায় ২-৩ গুণ বেশি। বেশিরভাগ মাইক্রোপ্লাস্টিক ০.৫ মি.মি’র নিচে, স্বচ্ছ ও তন্তুময়। রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এতে ৫ ধরনের পলিমার রয়েছেI

গবেষকরা বলেন, প্লাস্টিকের পলিমারগুলো মূলত পলিইথিলিন, পলিপ্রপিলিন, পলিইথিলিন টেরিপথালেট, পলিস্টাইরিন ও নাইলন প্রকৃতির। যার মধ্যে টেরেপথালেটস এর পরিমাণ বেশি। দূষনসূচক অনুযায়ী পরিশোধিত লবণে উপস্থিত মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত যা নির্দেশ করে যে এই পলিমারগুলো মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এতে প্রমাণিত হয় যে, লবণ পরিশোধন প্রক্রিয়ায় মাইক্রোপ্লাস্টিক অপসারিত হচ্ছে না এবং এই পদ্ধতি নিয়ে আরও বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োজন।

বর্তমানে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ গবেষকদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়িয়ে পরেছে পৃথিবীর সর্বত্র। ফলে মানুষসহ অন্যান্য অনেক জীবদেহে এর উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি মাতৃদুধেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যায়I

মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে গবেষকেরা বলেন, জনসাধারণের ছুড়ে ফেলা প্লাস্টিকবর্জ্য কোনো না কোনোভাবে সমুদ্রে গিয়ে জমা হয়। সময়ের সঙ্গে এই প্লাস্টিকবর্জ্য সমুদ্রের ঢেউ, সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির জারণ বিক্রিয়ার প্রভাবে, কিংবা জীববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় ভেঙে গিয়ে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয় যা মাইক্রোপ্লাস্টিক নামে বহুল পরিচিত। মাইক্রোপ্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিকগুলো উপলব্ধি করে এই বিষয়ে বিভিন্ন দেশ ব্যাপক গবেষণা সম্পন্ন করলেও আমাদের দেশে গবেষণার সংখ্যা খুবই নগণ্য।

কম উৎপাদন খরচ, ব্যবহারের সুবিধা, হালকা কিন্তু মজবুত হওয়ায় বিশ্বে নিত্য ব্যবহার্য বিভিন্ন তৌজসপত্র থেকে শুরু করে শিল্পদ্রব্য, ফার্মাসিউটিক্যাল ও অন্যান্য উপাদান তৈরিতে প্লাস্টিকের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বাড়ছে। শুধু ২০২১ সালেই পৃথিবীতে প্রায় ৩৬৭ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়েছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবেশের বিভিন্ন বাস্তুসংস্থানে পাওয়া যায়, এমনকি গভীর সামুদ্রিক পলি ও এভারেস্টের চূড়াতেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের সন্ধান পাওয়া গেছে।

গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে জানা যায় মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ সামুদ্রিক পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান ও খাদ্য সুরক্ষার মারাত্মক হুমকির কারণ। মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণের বিস্তার ইতোমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন পরিবেশে পাওয়া গেছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা থেকে পলিব্রোমিনেটেড ডি-ফেনাইল ইথার (পিবিডিই), বিসফেনল এ, ফ্যালেটসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়। এগুলো নানাবিধ ক্যানসার এবং প্রজননজনিত রোগের কারণ হতে পারে। এই বিপজ্জনক পদার্থগুলো খাদ্যশৃঙ্খলের বিভিন্ন স্তরে যেমন জুপ্ল্যাঙ্কটন, ঝিনুক, কৃমি, ক্রাস্টেসিয়ান, প্রবাল, মাছ এবং সামুদ্রিক পাখিতে জমা হতে পারে বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেহেতু প্লাস্টিক সহজ পাচ্য না, তাই প্রাণীদের ক্ষুধামন্দার সৃষ্টি হয় এবং একসময় না খেয়ে মারা পড়ে। এতে বিভিন্ন প্রাণীর বিলুপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে।

এ ছাড়াও এই ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা থেকে পরিবেশে কিছু ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয় যা পরিবেশের বাস্তুসংস্থানের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করে।

গবেষকেরা জানান, যেহেতু মাইক্রোপ্লাস্টিকের পুনঃচক্রায়ন খুবই দীর্ঘ বা হয় না সেহেতু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এই দূষণবাস্তুসংস্থান ও খাদ্যচক্রের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। যেহেতু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ নিয়ে খুবই অল্প গবেষণা হয়েছে, তাই এই বিষয়ে আরও ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন। শুধু সামুদ্রিক পরিবেশেই নয়, অভ্যন্তরীণ মিঠা পানির জলাশয়েও মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি ও এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন।


আরও দেখুন: