গ্রামেও সিজার বেড়েছে ২৭ শতাংশ
অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের হার ২০০৪ সালে ছিল ৩ দশমিক ৯৯। ২০১৭-২০১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ২২
দেশে অস্ত্রোপচারে (সি-সেকশন) শিশু জন্ম বেড়ে চলেছে। গত ১৪ বছরে এভাবে শিশু জন্মের হার বেড়েছে আট গুণের বেশি। শিশু জন্মের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ অস্ত্রোপচার অপ্রয়োজনীয়। এতে হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে চার গুণ বেশি খরচ হচ্ছে।
সি-সেকশন নিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বুধবার (২৮ সেপ্টেম্বর) উপস্থাপিত প্রতিবেদেন সি-সেকশনে শিশু জন্মের হার বৃদ্ধির পেছনে অন্তঃসত্ত্বা নারী ও তার পরিবারের সদস্যদের স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে ধৈর্য না ধরা, স্বাভাবিক প্রসবে চিকিৎসকদের বেশি সময় দেওয়ার আগ্রহ না থাকা, পরিবারগুলোর আর্থিক সচ্ছলতা, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
শুধু শহরে নয়, গ্রামেও শিশু জন্মে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার (সি-সেকশন) বাড়ছে। গবেষণায় ২০০৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০৪ সালে গ্রামে যেখানে সিজারের মাধ্যমে শিশু জন্মের হার ছিল ২ শতাংশ, ২০১৮ সাল শেষে তা ২৯ শতাংশে পৌঁছেছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্মদানে সবচেয়ে বেশি খরচ সিলেটে এবং সবচেয়ে কম খরচ বরিশালে। সিলেটে খরচ হয় ৩০ হাজার ৫৫৭ টাকা, রাজশাহীতে খরচ হয় ১৫ হাজার ৭০৫ টাকা। সরকারি হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় সিলেটেই ১৭ হাজার ৮৩৭ টাকা। আর সবচেয়ে কম খরচ হয় রংপুরে ৭ হাজার ৩১ টাকা।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ‘মেসিভ বোম অব সি-সেকশন ডেলিভারি ইন বাংলাদেশ: আ হাউজহোল্ড লেভেল অ্যানালাইসিস ২০০৪-২০১৮’ শীর্ষক গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন পপুলেশন স্টাডিজ ডিভিশন ও বিআইডিএসের গবেষণা ফেলো ড. আব্দুর রাজ্জাক সরকার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে অপ্রয়োজনীয় সি-সেকশন হয়েছে ৮ লাখ ৬০ হাজার। প্রতি ১০টি সি-সেকশনের অন্তত ছয়টি অপ্রয়োজনীয় ছিল। সি-সেকশন বাড়ার ফলে অনেক পরিবারকে বাড়তি টাকা গুণতে হচ্ছে। বাড়িতে স্বাভাবিক প্রসবে ১ হাজার ৩০০ টাকা, ধাত্রী-সহায়তার স্বাভাবিক প্রসবে সাড়ে ৫ হাজার টাকার বেশি এবং সি-সেকশনে ২০ হাজার টাকার বেশি খরচ হচ্ছে।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) ২০০৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে অস্ত্রোপচার করা নারীদের থেকে তথ্য নেয়। ২৭ হাজার ৩২৮ নারীর ওপর এই গবেষণা চালানো হয়। এতে অন্তর্ভুক্ত নারীদের বয়স ১৫ থেকে ৪৯ বছর।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের আটটি বিভাগের মধ্যে ডেলিভারিতে সরকারি হাসপাতালে ঢাকায় ১৩ হাজার ৩৮৩ টাকা, চট্টগ্রামে ১৫ হাজার ৮৩১, বরিশালে ১৬ হাজার ৮৪৬, খুলনায় ১১ হাজার ৮৯৩, রাজশাহীতে ১০ হাজার ৯৪১, সিলেটে ১৭ হাজার ৮৩৭, রংপুরে ৭ হাজার ৩১ ও ময়মনসিংহে ১১ হাজার ৫১৬ টাকা খরচ হয়।
বেসরকারি হাসপাতালে ঢাকায় ২৩ হাজার ১৬৮, চট্টগ্রামে ২৫ হাজার ৫০৭, বরিশালে ২৮ হাজার ৯৫৯, খুলনায় ১৫ হাজার ৭২৯, রাজশাহীতে ১৫ হাজার ৭০৫, সিলেটে ৩০ হাজার ৫৫৭, রংপুরে ১৮ হাজার ২৩০ ও ময়মনসিংহে ১৯ হাজার ৯৭৩ টাকা খরচ হয়।
এনজিও’র হাসপাতালগুলোতে ঢাকায় ২০ হাজার ৪৯৮, চট্টগ্রামে ১৫ হাজার ২৬৯, বরিশালে ১৫ হাজার ৮২৩, খুলনায় ১৪ হাজার ৭১০, রাজশাহীতে ১০ হাজার ৩৪৬, সিলেটে ২১ হাজার ৪৭৬, রংপুরে ১২ হাজার ৮১ ও ময়মনসিংহে ১৫ হাজার ৬১ টাকা খরচ হয়।
এই অস্ত্রোপচারের হার ২০০৪ সালে ছিল ৩ দশমিক ৯৯ ভাগ। সেখান থেকে ২০১৭-২০১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ২২ ভাগে।
অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরিন হক বলেন, গ্রামেও সি-সেকশন বেড়ে যাচ্ছে। এর কারণ চিকিৎসকদের চাপ। তাদের চাপে পড়েই পরিবারগুলো সি-সেকশনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্তদের সংখ্যা বেশি।
তিনি আরও বলেন, ‘আগে আমাদের দেশের ধাত্রীপ্রথা ছিল। সেটা হারিয়ে গেছে। সন্তান জন্ম নেওয়ার লক্ষণগুলো এসব ধাত্রীই ভালোভাবে ধরতে পারেন, চিহ্নিত করতে পারেন। এখন চিকিৎসককে অগ্রিম টাকা দিতে হয়। না হলে তারা আসতে চান না।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা হচ্ছে, অপারেশন ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এই হার ২০১৭-১৮ সালে ৩৩ শতাংশ ছিল। একই সময়ে ভারতে ২২ শতাংশ, পাকিস্তানে ২২ শতাংশ, নেপালে ১৬ ও মিয়ানমারে ১৭ শতাংশ ছিল।
বছরভিত্তিক হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশে ২০০৩-০৪ সালে ৫ হাজার ৪১৩ জনের মধ্যে ২১৬ জন অর্থাৎ ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ ছিল। ২০০৭ সালে ছিল ৪ হাজার ৯০৩ জনের মধ্যে ৪২২ জন অর্থাৎ ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। ২০১১ সালে ছিল ৭ হাজার ৩৪১ জনের মধ্যে ১ হাজার ১০৮ জন অর্থাৎ ১৫ দশমিক ০৯ শতাংশ।
২০১৪ সালে বাংলাদেশে ৪ হাজার ৬২৬ জনের মধ্যে ১ হাজার ১২২ জন অর্থাৎ ২৪ দশমিক ২৫ শতাংশ ছিল। আর ২০১৭-১৮ সালে ছিল ৫ হাজার ৪৫ জনের মধ্যে ১ হাজার ৬৭৬ জন অর্থাৎ ৩৩ দশমিক ২২ শতাংশ সি-সেকশন।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা অনুযায়ী, একটি দেশে মোট শিশুর জন্মের ১৫ শতাংশের বেশি সি-সেকশন হওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশে ২০০৪ সালে সি-সেকশনের হার প্রায় ৪ শতাংশ ছিল। ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ শতাংশের বেশি। গ্রামের চেয়ে শহরের নারীদের বেশি সি-সেকশন হচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এই প্রবণতা বেশি।
বিডিএইচএস ২০১৭-১৮ প্রতিবেদন অনুসারে, শহরের ৪৪ শতাংশ ও গ্রামের ২৯ শতাংশ মায়ের সি-সেকশন হচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালে প্রসবের ৫২ শতাংশ ও সরকারি হাসপাতালে ১১ শতাংশ সি-সেকশন হচ্ছে। ২০ বছর থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে সি-সেকশনের হার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। সি-সেকশনে সন্তান জন্ম দিয়েছেন এমন মায়ের প্রায় ৬০ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায়ের বেশি পড়াশোনা করেছেন।