সাপে কাটা রোগী চিকিৎসার পথিকৃৎ ডা. ফয়েজ

অনলাইন ডেস্ক
2022-09-24 16:07:24
সাপে কাটা রোগী চিকিৎসার পথিকৃৎ ডা. ফয়েজ

অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ

অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। প্রখ্যাত এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মানুষের শরীরের ওপর সাপের বিষের প্রভাব নিয়ে লন্ডনে পিএইচডি করেছেন।

পিএইচডি শেষে ১৯৯৩ সালে দেশে ফিরে মেডিসিনের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেই থেকে যেখানেই দায়িত্ব পেয়েছেন, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছেন।

অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজের কর্ম তৎপরতা স্মরণ করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন তারই এক শিষ্য প্রকৌশলী সুজয় দাস। এখানে সেটি তুলে ধরা হলো—

আমি কখনো কাজেকর্মে চট্টগ্রাম গেলে সেখানকার একটা জায়গায় যাবার চেষ্টা করি। সেটা হলো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সেখানকার চিকিৎসকরদের মধ্যে আমার অনেক ঘনিষ্ঠ ভাই-ব্রাদাররা আছেন। সুতরাং তাদের কাছে তো যেতেই হয়।

এই হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো। এখানের মেডিসিন বিভাগও ভালো। মেডিসিন-সংক্রান্ত সকল সমস্যার চিকিৎসাই হয়। কিন্তু একটা বিষয়ে এই বিভাগ একেবারেই দেশসেরা এবং এই বিষয়টায় এই বিভাগ বাংলাদেশে বলতে গেলে পথিকৃৎ।

তো কি সেটা? সেটা হলো সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা। খুব ডেডিকেশনের সাথে সাপে কাটা রোগীদের ফ্যান্টাস্টিক চিকিৎসা হয় এখানে। ‘১৬ নম্বর ওয়ার্ড’ নামে একটা বিখ্যাত ওয়ার্ডই আছে এই হাসপাতালে, যেটা সাপে কাটা রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড।

সর্পদংশনে মৃতপ্রায় কিংবা যায় যায় অবস্থার রোগীদের বাঁচিয়ে তোলার বহু সফল গল্প আছে এই ওয়ার্ড ঘিরে। সংকটাপন্ন রোগীর মাথার পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চিকিৎসকদের বসে থাকার গল্পও আছে এই ওয়ার্ড ঘিরে।

তো এই গল্পের সূচনা কোথায় হয়েছিল? বাংলাদেশে একজন বিখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আছেন, তার নাম অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ। মানুষের শরীরের ওপর সাপের বিষের প্রভাব নিয়ে তিনি লন্ডনে পিএইচডি করেন। পিএইচডি শেষে ১৯৯৩ সালে তিনি দেশে ফিরে মেডিসিনের একজন সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

শুরু হলো নতুন এক গল্প। ফয়েজ স্যারের হাত ধরেই সেখানে যাত্রা শুরু করল সাপে কাটা রোগীদের অর্গানাইজড চিকিৎসা। ১৯৯৩ সালের আগস্ট মাসের এক সকালে সাপে কাটা এক রোগী আসেন ফয়েজ স্যারের কাছে। সেই রোগী ছিলেন নারী এবং তিনি ছিলেন নয় মাসের গর্ভবতী। রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে সেই গর্ভবতী নারী বিষধর সাপের কামড় খান এবং এরপর অবহেলা ও স্থানীয় ওঝাদের অপচিকিৎসায় তার প্রাণ যখন যায় যায় তখন তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।

সেই মুমূর্ষু রোগীকে ফয়েজ স্যার ও তার টিম প্রায় ১৮ ঘণ্টার একাগ্র চেষ্টায় বাঁচিয়ে তোলেন। এই রোগীকে দিয়ে শুরু। তারপর ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৩ সাল এই দশ বছরে ফয়েজ স্যার ও তার স্নেক বাইট মেডিকেল টিম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বাঁচিয়ে তুলেছেন কয়েকশ’ সাপে কাটা রোগীকে।

এরপর ফয়েজ স্যার পর্যায়ক্রমে ছিলেন ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের (মিটফোর্ড) মেডিসিনের অধ্যাপক, ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। তিনি যেখানেই গেছেন সেখানেই সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন।

সেই সাথে তিনি সর্পদংশনের ওপর দেশজুড়ে একদল চিকিৎসককে ডেডিকেটেড গবেষক হিসেবে গড়ে তুলেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক থাকা অবস্থায় তিনি অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রণয়ন করেছিলেন ন্যাশনাল গাইডলাইন।

সারা দেশে এখন সেই গাইডলাইন অনুযায়ীই সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসা চলে। ফলে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষের জীবন বাঁচে। এই গাইডলাইনটি বাংলাদেশের পাশাপাশি এখন পৃথিবীর আরও অনেক দেশই ফলো করে। এটি একটি ফ্যান্টাস্টিক ও লাইফ সেভিং গাইডলাইন।

এছাড়া জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে ফয়েজ স্যার সাপ, সর্পদংশন ও সর্পদংশনের চিকিৎসার ওপর বাংলায় একটি বইও লিখেছেন।

১৯৯৩ সাল থেকে শুরু করা ফয়েজ স্যারের ইনিশিয়েটিভের কারণে আজ সমগ্র বাংলাদেশেই সাপে কাটা রোগীদের খুব চমৎকার চিকিৎসাব্যবস্থা বিদ্যমান। দেশের সকল সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও জেলা সদর হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীদের জন্য সরকারের তরফে এন্টিভেনোম ইঞ্জেকশন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে।

এই বছরের মাঝামাঝিতে দেশের প্রায় সকল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও সরকারের পক্ষ থেকে এন্টিভেনোম ইঞ্জেকশন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সাপের বিষ নিয়ে গবেষণার জন্য এবং দেশেই সাপের বিষের এন্টিভেনোম ইঞ্জেকশন বানানোর জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে গড়ে উঠেছে ভেনোম রিসার্চ সেন্টার।

এই সেন্টারটা প্রতিষ্ঠায়ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন ফয়েজ স্যার। দেশে এখন সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসা দেবার জন্য যে ক’জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন, তারা প্রত্যেকেই ফয়েজ স্যারের ছাত্র-শিষ্য। শ্রদ্ধেয় ফয়েজ স্যার খুব একাগ্রচিত্তে ও নিভৃতে সাপে কাটা রোগীদের জীবন বাঁচানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।

সর্পদংশনের চিকিৎসাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার জন্য গত কয়েক দশক ধরেই তিনি নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তার এই উদ্যোগ, পরিশ্রম, গবেষণা আর চেষ্টার কারণে এই দেশে বহু লোকের জীবন বেঁচে গেছে।

আজও কোনো নিভৃত এলাকায় কাউকে সাপে কাটলে অধ্যাপক ফয়েজ স্যার অনলাইনে ও ফোনে যুক্ত হয়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে প্রয়োজনে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন। আমি ইঞ্জিনিয়ার হলেও মেডিকেল লাইনের বিভিন্ন পড়াশোনার কারণে আমিও অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ স্যারের শিষ্য হয়ে গেছি এবং নানান সময়ে তার কাছ থেকে স্নেহ ও দিকনির্দেশনা পেয়েছি। আমার এই লেখাটার মাধ্যমে আমি আজ শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ স্যারের প্রতি আমার প্রণতি জানিয়ে গেলাম।


আরও দেখুন: