‘স্বাস্থ্যসেবার মান আরও অনেক উন্নত করতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ’
স্বনামধন্য চিকিৎসকদের সঙ্গে বগুড়ার ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ আশরাফুল ইসলাম
দায়িত্ব গ্রহনের পর থেকে প্রতিনিয়ত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেবার মান উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। নদী ভাঙন কবলিত এলাকাটির স্বাস্থ্যসেবার মান আরও অনেক উন্নত করতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। যাতে উপজেলার একজন মানুষকেও স্বাস্থ্যসেবার জন্য দূরদূরান্তের হাসপাতালে ছুটে যেতে না হয়। ডক্টর টিভিকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব আশার কথা শুনিয়েছেন বগুড়ার ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোঃ আশরাফুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন সিনিয়র প্রতিবেদক ইলিয়াস হোসেন। পাঠকদের জন্য তার চুম্বক অংশটি তুলে ধরা হলো।
ডক্টর টিভি : আপনার উপজেলার স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কিছু বলুন
ডা. মো. আশরাফুল ইসলাম : আমার ধুনট উপজেলায় ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল রয়েছে। যেখানে আমি প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে কর্মরত আছি। সাড়ে তিন লক্ষের অধিক জনসংখ্যার এই উপজেলাটি বগুড়া শহর থেকে যথেষ্ট দূরবর্তী। পাশ দিয়ে যমুনা নদী বয়ে গেছে। উপজেলার কয়েকটা ইউনিয়ন যমুনা নদী ভাঙনে জর্জরিত। এখানকার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপর তারা স্বাস্থ্যসেবার জন্য পুরোপুরি নির্ভরশীল। প্রসূতি স্বাস্থ্য সেবা, শিশু স্বাস্থ্যসেবা, কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা, টিকাদান কার্যক্রম, গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা সহ মোটামুটিভাবে অধিকাংশ স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সুযোগ আমাদের হাসপাতালে রয়েছে।
ডক্টর টিভি : আপনি দায়িত্ব নেওয়ার নতুন কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
ডা. মোঃ আশরাফুল ইসলাম : আমি গত ৩০ ডিসেম্বর ২০২১ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করি। এরপর হাসপাতাল ও হাসপাতাল চত্বরের পরিচ্ছন্নতার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করি। হাসপাতাল চত্বরে পরিত্যক্ত, নোংরা এবং জঙ্গল স্বরূপ জায়গা পরিষ্কার করে বাগান নির্মাণের কাজ শুরু করি।
হাসপাতালের নিরাপত্তার স্বার্থে কর্মকর্তা কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিলো সিসি ক্যামেরা। পুরো হাসপাতালে মোট ১০টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেছি।
ইসিজি এবং আল্ট্রাসনোগ্রাফির ব্যবস্থা ছিলো না। আমার উদ্যোগে এই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালু হয়েছে।
প্রসূতি সেবায় নরমাল ডেলিভারির সংখ্যা ছিলো বিগত বৎসরে মাত্র ১১৯ টি। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর চলতি বছরের প্রথম আট মাসেই নরমাল ডেলিভারির সংখ্যা ২২২টি।
ইউনিয়ন পর্যায়ে কোভিড টিকাদান কর্মসূচি আরো বেগবান এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ভ্রাম্যমাণ টিকাদান কর্মসূচি আয়োজন করেছি।
সুবিধাবঞ্চিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় গিয়ে বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা প্রদান কর্মসূচী পালন করেছি।
এতিম শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এতিমখানা ও মাদ্রাসায় বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচী পালন করেছি।
আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর বহির্বিভাগে সেবাগ্রহণকারী রোগীর পরিমান ২/৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
অন্তঃবিভাগে ভর্তি রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে বেড অকুপেন্সী হার ছিলো ৬৯%। বর্তমানে সেই হার ৯৫% এরও উপরে।
রোগীসেবা বৃদ্ধির কারণে সরকারি কোষাগারে জমাকৃত ইউজার ফি’র পরিমান বিগত বৎসরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে ধারণ করতে বহির্বিভাগে "স্বাধীনতার দেয়াল" নামে স্মৃতি স্মারক স্থাপন করেছি। যেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে।
অন্তঃবিভাগে রোগীদের পুরোনো ভাঙা বেডগুলো পরিবর্তন করে আধুনিক নতুন ৩০টি বেড প্রদান করা হয়েছে। ওয়ার্ডে প্রায় ১০টি ফ্যান দীর্ঘদিন নষ্ট ছিলো। ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেগুলো রিপ্লেস করার ব্যবস্থা করেছি।
ভর্তি রোগীদের খাবারের মান বিশেষভাবে উন্নত করা হয়েছে। জাতীয় দিবসগুলোতে মুখরোচক উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। যেটা আমি নিজে তদারকি করি।
বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের উৎসাহিত এবং কাজে অধিকতর মনোযোগী হবার জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্বাস্থ্যসেবায় অবদানের জন্য নিয়মিত তাদেরকে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করেছি।
অনেক পশ্চাৎপদ এবং অবহেলিত একটি উপজেলার দায়িত্ব গ্রহণের পর বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবার মান অনেকাংশে উন্নত করতে পেরেছি। আরো অনেক কিছু করার সুযোগ রয়েছে। আমি আশাবাদী- আমার দায়িত্বশীল চিকিৎসকবৃন্দ, উদ্যমী নার্সিং কর্মকর্তাবৃন্দ সহ সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমরা স্বাস্থ্যসেবার মান আরো অনেক উন্নত করতে পারবো. ইনশাআল্লাহ।
ডক্টর টিভি : এই এলাকার স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে কোন কোন বিষয় বিশেষ জরুরি?
ডা. মোঃ আশরাফুল ইসলাম : এই এলাকার মানুষের শতভাগ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে অপারেশন থিয়েটারের যন্ত্রপাতি এবং ডিজিটাল এক্সরে মেশিন অনতিবিলম্বে স্থাপন করা জরুরি। মেডিসিন, সার্জারি, ইএনটি, চর্ম-যৌন বিশেষজ্ঞ কনসালটেন্ট পদায়ন খুবই জরুরি। আমার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও প্রত্যাশা- যেন একজন মানুষকেও স্বাস্থ্যসেবার জন্য দূরদূরান্তের হাসপাতালে ছুটে যেতে না হয়।
ডক্টর টিভি : সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে এই এলাকার মানুষের মনোভাব কেমন?
ডা. মোঃ আশরাফুল ইসলাম : আলহামদুলিল্লাহ। বর্তমানে উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ আমাদের সেবার মান নিয়ে যথেষ্ট পরিমানে সন্তুষ্ট। তবুও আরও অনেক জায়গায় উন্নতির সুযোগ রয়েছে। আমি এবং আমার টিম সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সাথে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
ডক্টর টিভি : আপনার হাসপাতালে কতটি পদ রয়েছে, এর মধ্যে পদ খালি আছে কতটুকু? শূন্যপদের চিকিৎসকদের অভাব কিভাবে পূরণ করছেন?
ডা. মোঃ আশরাফুল ইসলাম : আমাদের জনবলের যথেষ্ট পরিমান সংকট রয়েছে। বিশেষ করে ৩য় এবং ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীর সংকট তীব্র। ৪র্থ শ্রেণীর ২৫টি পদের মধ্যে ১৭টি পদই শূন্য। ৩য় শ্রেণিরও একই অবস্থা। মেডিক্যাল অফিসার এবং নার্সিং কর্মকর্তাদের সংখ্যা আপাতত সন্তোষজনক হলেও মেডিসিন, সার্জারী, ইএনটি, চর্ম ও যৌন কনসালটেন্ট পদায়ন অবিলম্বে জরুরি।
ডক্টর টিভি : আপনার হাসপাতালে সাপে কাটা রোগী ও কুকুরে কামড়ানো রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ সুবিধা কেমন?
ডা. মোঃ আশরাফুল ইসলাম : সাপে কাটা রোগীদের জন্য এ্যান্টি ভেনম আছে কিন্তু যেহেতু ইনটেনসিভ মনিটরিং এর জন্য স্পেশালাইজড ব্যবস্থা নেই। সেজন্য এই সেবাটি প্রদান করা কঠিন এবং রোগীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কুকুরে কামড়ানো রোগীর ভ্যাক্সিন এই মুহূর্তে হাসপাতালে নেই। আমরা আনার চেষ্টা করছি।
ডক্টর টিভি : আপনার হাসপাতালে কোন রোগী বেশি আসে?
ডা. মোঃ আশরাফুল ইসলাম : আমার হাসপাতালে মোটামুটি সব ধরনের রোগীই আসে। তবে প্রসূতি নারী, শিশু, সড়ক দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আহত রোগীর সংখ্যা বেশি।
ডক্টর টিভি : দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখনও কোনো ধরনের প্রতিকূলতার সম্মূখীন হয়েছেন কিনা? হয়ে থাকলে কীভাবে তা মোকাবেলা করেছেন?
ডা. মোঃ আশরাফুল ইসলাম : আমার সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারীরা আমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। এছাড়া মাননীয় সংসদ সদস্য, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সকলের নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা পেয়েছি এখন পর্যন্ত। এজন্য আমার এখন পর্যন্ত তেমন কোন প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়নি। তবে সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে আনসার নিয়োগ কিংবা স্বাস্থ্য পুলিশ নিয়োগ এখন সময়ের দাবি। আমার হাসপাতালটি ১৯৬৬ সালের তৈরি। তাই অবকাঠামো খুবই ভঙ্গুর এবং মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। রোগীদের এবং কর্মকর্তা কর্মচারীদের জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে অবিলম্বে এই হাসপাতালটি পুনর্নির্মাণ একান্ত জরুরি।
ডক্টর টিভি : দেশের চিকিৎসকদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ কী?
ডা. মোঃ আশরাফুল ইসলাম : আমাদের প্রাণের বাংলাদেশের মত ঘনবসতিপূর্ণ দেশে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সকল চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিভাগের সকল পর্যায়ের কর্মচারী যারা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তাদের প্রতি অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা এবং স্যালুট জানাই। আপনাদের কল্যাণের স্বার্থে আমৃত্যু কাজ করে যেতে চাই। আপনাদের নিঃস্বার্থ সহযোগিতায় আমাদের সবটুকু অর্জন, আপনাদের অবদানেই দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এগিয়ে যাচ্ছে। আপনাদের সবাইকে শ্রদ্ধাভরে স্যালুট জানাই।
ডক্টর টিভি : আপনার জন্ম বেড়ে ওঠা, পরিবার, শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন সম্পর্কে জানতে চাই
ডা. মোঃ আশরাফুল ইসলাম : আমার জন্ম ১৯৮৮ সালে ঢাকার তেজগাঁও নাখালপাড়ায়, সেখানেই বেড়ে ওঠা। তেজগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছি ২০১২ সালে। ৩৩তম বিসিএস এর মাধ্যমে সরকারি চাকুরীতে যোগদান করি ২০১৪ সালে। মেডিসিন বিষয়ে এফসিপিএস ট্রেনিং সম্পন্ন করেছি। ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করিনি এখনো। ৬ষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত।
বাংলাদেশ মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশন বগুড়া শাখার কার্যনির্বাহী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি ২০১৭ সাল থেকে। সম্প্রতি ইউএইচএফপিও ফোরামের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বিভাগীয় সম্পাদক (রাজশাহী বিভাগ) হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি।