স্বাস্থ্যসেবায় লাকসাম একটি মডেল উপজেলা

ডক্টর টিভি রিপোর্ট
2022-09-18 15:31:19
স্বাস্থ্যসেবায় লাকসাম একটি মডেল উপজেলা

লাকসাম উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নাজিয়া আলমকে সম্মাননাপত্র তুলে দিচ্ছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম

স্বাস্থ্যসেবার দিক থেকে লাকসাম একটি মডেল উপজেলা। স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে সেবা নিচ্ছেন। ২৪ ঘন্টা চিকিৎসকের উপস্থিতিতে জরুরি চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে। ডক্টর টিভি’র সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন লাকসাম উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নাজিয়া আলম। সাক্ষাৎকার গ্রহন করেছেন সিনিয়র প্রতিবেদক ইলিয়াস হোসেন। পাঠকদের জন্য তার চুম্বক অংশটি তুলে ধরা হলো। 

 

ডক্টর টিভি : আপনার উপজেলার স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কিছু বলুন

ডা. নাজিয়া আলম : আমি মনে করি, স্বাস্থ্যসেবার দিক থেকে লাকসাম একটি মডেল উপজেলা। স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে সেবা নিচ্ছেন। ২৪ ঘন্টা চিকিৎসকের উপস্থিতিতে জরুরি চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে। ছোট-বড় মিলিয়ে নানা জটিল রোগের অস্ত্রোপচার হচ্ছে। নিয়মিত নরমাল ডেলিভারি হচ্ছে। যা অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি। শুধুমাত্র কোয়ানটিটি নয়, কোয়ালিটি স্বাস্থ্যসেবা দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। আর কোয়ালিটি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ প্রতিদিন বহিঃবিভাগে নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠির একটি বিরাট অংশ বিভিন্ন অসংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত। তাদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে বহিঃবিভাগে একটি কর্ণার স্থাপন করা হয়েছে। যা এনসিডি কর্ণার নামে পরিচিত। মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে বিভিন্ন স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম চলমান আছে। সবমিলিয়ে অতীতের যেকোন সময়ের চাইতে লাকসাম উপজেলায় গুণগত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সম্মানিত মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম এমপি মহোদয়ের আন্তরিক প্রচেষ্ঠায় হাসপাতালটি সম্প্রতি ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।  

 

ডক্টর টিভি : আপনি দায়িত্ব নেওয়ার নতুন কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?

ডা. নাজিয়া আলম : দায়িত্ব নেয়ার পর গৃহীত উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপসমূহ : :

১. করোনা মোকাবেলা ও ভ্যাকসিন প্রদান :

আমি করোনা মহামারীর মধ্যে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে লাকসাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগদান করি। তাই আমার প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিলো লাকসাম উপজেলার করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা। একইসঙ্গে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষকে করোনা টিকার আওতায় নিয়ে আসা। দুই ক্ষেত্রেই আমি তথা লাকসাম উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সফল বলে বিশ্বাস করি।

২. জবাবদিহিতামূলক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা :

আমি আমার দপ্তরকে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছি। দালালদের দৌরাত্ম্য নির্মূল করেছি। সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকল্পে কার্যকর ও সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম জোরদার করেছি। আর এ সকল কাজে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি তথা স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সম্মানিত মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম এমপি মহোদয়, উপজেলা প্রশাসন এবং সুশীল সমাজের সহযোগিতা না পেলে আমার একার পক্ষে সম্ভব হতো না।

৩. হাসপাতালের ওটি কমপ্লেক্সকে সচল করেছি। ফলে নিয়মিত সিজারিয়ান সেকশন ও এপেন্ডিসকটমির মতো মেজর অপারেশন আমাদের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হচ্ছে।

৪. মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারির সংখ্যা এবং মেয়েদের জরায়ুমুখের ক্যান্সার সনাক্তকরণের ‘ভায়া পরীক্ষা’র সংখ্যা বৃদ্ধি করেছি।

৫. করোনা রোগীদের চিকিৎসায় স্থাপিত ‘করোনা আইসোলেশন’ ইউনিটের শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করেছি। বর্ধিত শয্যাগুলোতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন সংযোজন করেছি।

৬. অসংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদী রোগের চিকিৎসায় এনসিডি কর্ণার স্থাপন করেছি।

৭. মাঠ পর্যায়ে ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে সচল করেছি ও নিয়মিত পরিদর্শনের আওতায় রেখেছি। স্থানীয় সরকার বিভাগ ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহযোগিতায় কোঁয়ার কমিউনিটি ক্লিনিকটি পুনঃনির্মাণ করেছি। মামিশ্বর ও পৈশাগী কমিউনিটি ক্লিনিকটি সংস্কার করেছি।

৮. কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে উপজেলার মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত স্কুল হেলথ প্রোগ্রাম চালু রেখেছি।

৯. সেবার মান বাড়ানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় জনপ্রতিনিধি, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জনসাধারণের সাথে মতবিনিময় করেছি।

১০. উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের ‘সিটিজেন চার্টার’ সম্বলিত বিলবোর্ড উপজেলার বিভিন্ন দৃশ্যমান স্থানে স্থাপন করেছি।

 

ডক্টর টিভি : এই এলাকার স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে কোন কোন বিষয় বিশেষ জরুরি?

ডা. নাজিয়া আলম : এই এলাকার স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে সবার আগে প্রয়োজন সরকারি হাসপাতালে এসে চিকিৎসা সেবা নেয়ার বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা পরিহার করে ইতিবাচক মানসিকতা ধারণ করা। সরকার সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতকে প্রায়োরিটি দিয়ে সবার জন্য চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ লাকসাম অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে ডাইন্যামিক। চিকিৎসক-নার্স সহ সকল স্টাফ অনেক আন্তরিক। জনসাধারণ হাসপাতালে এসে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করলেই সরকারের এই উদ্যোগ পূর্ণতা পাবে। জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করার এই নৈতিক দায়িত্ব উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ, জনপ্রতিনিধি সাংবাদিকসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের।

 

ডক্টর টিভি : সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে এই এলাকার মানুষের মনোভাব কেমন?

ডা. নাজিয়া আলম : সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে এলাকার মানুষের মনোভাব অবশ্যই ইতিবাচক। যার প্রমাণ স্বরূপ- অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অধিক সংখ্যক রোগী বহিঃবিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রয়োজনীয় প্যাথলজি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ল্যাবে করাচ্ছেন। অধিক সংখ্যক গর্ভবতী মা নরমাল ও সিজারিয়ান সেকশনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। ক্ষেত্রবিশেষে কোন কোন রোগী ২/৩ সপ্তাহ হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা সেবা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। এই সব কিছুই মানুষের ইতিবাচক মানসিকতার পরিচয় বহন করে।

 

ডক্টর টিভি : আপনার হাসপাতালে কতটি পদ রয়েছে, এর মধ্যে খালি আছে কতগুলো? শূন্যপদের চিকিৎসকদের অভাব কিভাবে পূরণ করছেন?

ডা. নাজিয়া আলম : হাসপাতালে বিভিন্ন ক্যাটাগরির কর্মকর্তা-কর্মচারির পদবিন্যাস রয়েছে। তবে সুনির্দিষ্টভাবে আবাসিক মেডিকেল অফিসারসহ মোট মেডিকেল অফিসারের পদ রয়েছে ১৩টি। এরমধ্যে ২টি পদ শূন্য রয়েছে। ডেন্টাল সার্জনের একটি পদ রয়েছে। এছাড়াও জুনিয়র কনসালটেন্টের ১১টি পদ রয়েছে। যার মধ্যে ৫টি পদ শূন্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষ সংযুক্তিতে ৪২ তম বিসিএস-এ উত্তীর্ণ ৯ জন মেডিকেল অফিসার লাকসাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগদান করেছেন। যারা শূন্য পদের চিকিৎসকদের অভাব পূরণ করছেন।

 

ডক্টর টিভি : আপনার হাসপাতালে সাপে কাটা রোগী ও কুকুরে কামড়ানো রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ সুবিধা কেমন?

ডা. নাজিয়া আলম : হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। বিষধর সাপ হলে এন্টিভেনম ইনজেকশন দেয়া হয় এবং উচ্চতর সেবা কেন্দ্রে রেফার করা হয়।

কুকুরে কামড়ানো রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসাও হাসপাতালে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে কুকুরে কামড়ানো এবং হাসপাতালে নিয়ে আসার মধ্যবর্তী সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে বিলম্ব হলে অথবা বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দিলে, কুকুরটি যদি জলাতঙ্কের জীবাণু বহন করে, তবে এক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কা প্রায় শতভাগ। তাই কুকুর কামড়ানোর পর রোগীকে দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। হাসপাতালে নিয়ে আসলে রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। এর অংশ হিসেবে র‌্যাবিস ভ্যাকসিন ও ইমিউনোগ্লোবিন দেয়া হয়। তবে এই ভ্যাকসিনটি সরকারিভাবে সরবরাহ না থাকায়- রোগীকে তা বাজার থেকে কিনতে হয়।

 

ডক্টর টিভি : আপনার হাসপাতালে কোন রোগী বেশি আসে?

ডা. নাজিয়া আলম : হাসপাতালে চর্মরোগী বেশি আসেন। এছাড়াও অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগী এবং গর্ভবতী মা ও শিশু রোগীরা অনেক আসেন। আমাদের সৌভাগ্য- এসব রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য মেডিসিন ও সার্জারি ও গাইনী রোগে অভিজ্ঞ জুনিয়র কনসালটেন্ট আছেন ১ জন করে। শিশুরোগে অভিজ্ঞ জুনিয়র কনসালট্যান্ট আছেন ২ জন। এছাড়া মেডিকেল অফিসারদের মধ্যে ১ জন করে গাইনী ও চর্মরোগে অভিজ্ঞ আছেন।

 

ডক্টর টিভি : দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখনও কোনো ধরনের প্রতিকূলতার সম্মূখীন হয়েছেন কিনা? হয়ে থাকলে কীভাবে তা মোকাবেলা করেছেন?

ডা. নাজিয়া আলম : দেখুন, কাজ করতে গেলে প্রতিবন্ধকতা আসবেই। কাজের সমালোচনাও থাকবে। কিন্তু আপনি যদি সত্য ও ন্যায় পথে থাকেন, তাহলে যেকোন প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে পারবেন। আমি কাজ পাগল মানুষ, কাজ দিয়েই মানুষের মন জয় করে থাকি। আর কাজের সমালোচনায় আমি আরও ভাল কাজ করার অনুপ্রেরণা পাই। কারণ আমি বিশ্বাস করি, কাজ করতে করতেই সমালোচনাগুলো আলোচনায় পরিণত হবে।

 

ডক্টর টিভি : দেশের চিকিৎসকদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ কী?

ডা. নাজিয়া আলম : আমি নিজেকে ত্রুটিমুক্ত মানুষ মনে করি না। আমি এখনো প্রতিনিয়ত শিখছি। তবে, আমি মনে করি, ন্যায়পরায়নতা, সততা, কর্মনিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা ও নিজ নিজ বিষয়ে দক্ষতা একজন মানুষকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে। দেশের চিকিৎসকদের প্রতি আমাদের আশা, আমরা সবাই সুনাগরিক ও সুচিকিৎসক হিসেবে গড়ে উঠতে সচেষ্ট হবো।


আরও দেখুন: