প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা প্রাপ্তি নিশ্চিত করছে ‘সেবা প্রহর’
কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ
প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের সেবার আওতায় আনতে স্ব-উদ্যোগে ডিজিটাল পদ্ধতিতে চিকিৎসা দিচ্ছে কুমিল্লা আদর্শ সদর স্বাস্থ্য বিভাগ। বিশেষ এই পদ্ধতির নাম দেয়া হয়েছে ‘সেবা প্রহর’। এরফলে রেফারেলের মাধ্যমে অধিকতর উন্নত চিকিৎসা পাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার কমিউনিটি ক্লিনিকে আসা প্রান্তিক রোগীরা। ডক্টর টিভিকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানান কুমিল্লা আদর্শ সদরের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শামসাদ রব্বানী খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ডক্টর টিভির সিনিয়র প্রতিবেদক ইলিয়াস হোসেন। পাঠকদের জন্য কথামালার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।
ডক্টর টিভি : আপনার উপজেলার স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কিছু বলুন
ডা. শামসাদ রব্বানী খান : উপজেলা স্বাস্থ্য অফিসের আওতাধীন ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকে আগত নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুব-শিশু সকলকে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান করে থাকি।
* ইপিআই কার্যক্রমের আওতায় নির্ধারিত কেন্দ্রে শিশুদের সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক টিকা প্রদান করা হয়।
* উক্ত অফিসের আওতাধীন ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকে আগত রোগীদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি শিক্ষা প্রদান করা।
* মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদানপূর্বক দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
* কমিউনিটি স্কিল বার্থ অ্যাটেনডেন্টদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক ও নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করা।
* জাতীয় যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের আওতায় নির্ধারিত কেন্দ্রে যক্ষ্মা রোগীদের কফ সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা, জিন এক্সপার্ট মেশিনের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা এবং রোগীদের বিনামূল্যে ঔষধ সরবরাহ করা।
* মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের (ইপিআই, উঠান বৈঠক, স্বাস্থ্য শিক্ষা, কমিউনিটি ক্লিনিক) এর কার্যক্রম পরিদর্শন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা।
* উপজেলা রেপিড রেসপন্স টিমের মাধ্যমে রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় আউটব্রেক ইনভেস্টিগেশন কার্যক্রম পরিচালনা করা।
* উপজেলার বিভিন্ন খাদ্য স্থাপনা পরিদর্শন ও মান সম্পন্ন খাবার, নিরাপদ পানি এবং সুষ্ঠ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনায় ভূমিকা রাখা।
* অত্র উপজেলার আওতাধীন অসচ্ছল প্রতিবন্ধী সেবা কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রযোজ্য স্বাস্থ্য সনদ প্রদান করা।
* প্রাকৃতিক/ মানব সৃষ্ট যেকোন দুর্যোগে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকল্পে কার্যক্রম পরিচালনা করা।
* ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র থেকে রেফার্ডকৃত রোগীদের গুরুত্ব সহকারে চিকিৎসা সেবা প্রদান এবং প্রয়োজনে জেলা হাসপাতালে প্রেরণ।
ডক্টর টিভি : আপনি দায়িত্ব নেওয়ার নতুন কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
ডা. শামসাদ রব্বানী খান : ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি থেকে অদ্যাবধি কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করে চলেছি। দায়িত্ব নেবার পর অন্যান্য সকল কার্যক্রম বেগবান করার পাশাপাশি, মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম সুপারভিশন ও মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে। সুপারভাইজারদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের সহায়ক তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে কাজের মান বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তাছাড়াও, উল্লেখযোগ্য দুইটি কার্যক্রম সম্পর্কে বলতে চাই,
“সেবা প্রহর” নিরাপদ প্রসব সেবায় নতুনত্বের ছোঁয়া
স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকল্পে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আশ্রয়স্থল কমিউনিটি ক্লিনিকে আগত সেবা গ্রহিতাদের প্রায়শই একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শের প্রয়োজন হয়। এছাড়াও নারীদের বিভিন্ন স্বাস্থ্য জটিলতার উন্নত পরামর্শের জন্য সদর হাসপাতাল অথবা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে রেফার করা হয়।
কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় এই যে, দূরত্ব, আর্থ সামাজিক অবস্থা ও চিকিৎসা প্রাপ্তিতে দৌরাত্ম্য ইত্যাদি বিবেচনায় অনেকেই হাসপাতালে আসার ব্যাপারে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। এই সকল প্রেক্ষাপট বিবেচনা পূর্বক আদর্শ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য অফিস অক্টোবর ২০২১ হতে “সেবা প্রহর” নামে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যার ফলশ্রুতিতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে সরাসরি একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতে পারছেন এবং একই সাথে সিএইচসিপিগণ উন্নত চিকিৎসার জন্য সেবা গ্রহীতাদের উচ্চতর কেন্দ্রে প্রেরণের মাধ্যমে একটি কার্যকরী রেফারেল ব্যবস্থা প্রণয়নে ভূমিকা রাখছেন।
ফলাফল যা এসেছে:
• উপজেলার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ তার আবাস্থলের সন্নিকটে অবস্থিত কমিউনিটি ক্লিনিকে এসে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের সাথে সরাসরি ভিডিও কথোপকথনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবা মূলক পরামর্শ নিতে পারছেন।
• সিএইচসিপিরা ‘সেবা প্রহর’ এর মাধ্যমে সেবাপ্রাপ্ত রোগীদের পরবর্তীতে ফলো আপ করছেন। ফলশ্রুতিতে এলাকার জনগণের মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতি আস্থা ও সম্পৃক্ততা বাড়ছে।
• নারী স্বাস্থ্যের মান উন্নয়নে এই কার্যক্রম বিশেষ ভূমিকা রাখছে। কৈশোরকালীন স্বাস্থ্য সেবা সহ প্রসব পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সেবা প্রদানের মাধ্যমে নারীদের সেবা প্রদান সহজীকরন হচ্ছে।
শতভাগ প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবসেবা নিশ্চিতকরণ (১ টি ইউনিয়ন) কার্যক্রমঃ আদর্শ সদর উপজেলার কালিরবাজার ইউনিয়নকে উদ্দেশ্য করে এই কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করা হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ, পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন থেকে নতুন গর্ভবতীদের তালিকা সংগ্রহ করে একটি সমন্বিত গর্ভবতী তালিকা তৈরি করে ইউনিয়নের কমিউনিটি ক্লিনিক, পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে সরবরাহ করা হয়। পরবর্তীতে তাদের ৪ টি প্রসবপূর্ব সেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবসেবা নিশ্চিত করা-ই এই কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য। এই জন্য ঐ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বারগণ, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের স্বাস্থ্যকর্মী সবাইকে নিয়ে একটি অবহিতকরন সভা পরিচালনার মাধ্যমে এই কার্যক্রম শুরু করা হয়। প্রসবপূর্ব সেবার নির্দিষ্ট তারিখের পূর্বে স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের সেবা প্রদান কেন্দ্রের নিকটের গর্ভবতী মায়েদেরকে সরাসরি/ফোনে যোগাযোগ করেন এবং প্রসবপূর্ব সেবা নেয়ার জন্য অবগত করেন। যার মাধ্যমে গর্ভবতী মায়েদের ৪টি প্রসবপূর্ব সেবা নিশ্চিত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং তাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের জন্য পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে কাজ চলমান। এই ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি সকল স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে গর্ভবতী মায়েদের প্রসব পরবর্তী জটিলতা কমে আসবে এবং নবজাতক এর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হবে।
ডক্টর টিভি : আপনার এলাকার স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে কোন কোন বিষয় বিশেষ জরুরি?
ডা. শামসাদ রব্বানী খান : সাধারণ জনগণের মধ্যে রোগ প্রতিরোধে কার্যকরী পদক্ষেপ সমূহের সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। মাতৃ এবং শিশু স্বাস্থ্যের মান উন্নয়নে সকলের এক যোগে কাজ করতে হবে। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে ক্ষতিকর আচরণগত অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে এই সমস্ত রোগে অকালে আক্রান্ত এবং অকালে মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুল শিক্ষাথীদের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা মূলক কার্যক্রম আরও জোরদার করার মাধ্যমে একটি সুস্থ ও সবল জাতি তৈরিতে ভূমিকা রাখা সম্ভব।
ডক্টর টিভি : দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখনও কোনো ধরনের প্রতিকূলতার সম্মূখীন হয়েছেন কিনা? হয়ে থাকলে কীভাবে তা মোকাবেলা করেছেন?
ডা. শামসাদ রব্বানী খান : উল্লেখযোগ্য কোন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হইনি।
ডক্টর টিভি : দেশের চিকিৎসকদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ কী?
ডা. শামসাদ রব্বানী খান : যুগোপযোগী ও মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং চিকিৎসা গবেষণার মাধ্যমে নিজেদের দক্ষতা বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই।
ডক্টর টিভি : আপনার জন্ম বেড়ে ওঠা, পরিবার, শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন সম্পর্কে জানতে চাই
ডা. শামসাদ রব্বানী খান : জন্ম এবং শৈশব এর কিছু অংশ ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলায় কেটেছে। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বাবা-মা দুজনেই শিক্ষক ছিলেন। আমার একমাত্র বড়ভাই একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। আমার কৈশোর কেটেছে সিলেট ক্যাডেট কলেজে। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর থেকে এমবিবিএস শেষ করে সরকারী চাকুরীতে যোগদান করি। আইইডিসিআর হতে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করি। পরবর্তীতে ইউএস-সিডিসি কর্তৃক জনস্বাস্থ্য বিষয়ে গ্রাজুয়েট স্বীকৃতি অর্জন করি। সবশেষে আমি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ইউ.কে. থেকে অসংক্রামক রোগ তত্ত্ব সম্পর্কিত একটি ফেলোশিপ অর্জন করি। রোগতত্ত্ব সম্পর্কিত কিছু গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। আমার স্ত্রী একজন চিকিৎসক। তিনিও সরকারী চাকুরীতে আছেন। আমার দুই পুত্র অতি সত্ত্বর তাদের শিক্ষাজীবন শুরু করবে বলে আশা করি।
ডক্টর টিভি : কাজের স্বীকৃতি বা সম্মাননা পেয়েছেন কি?
ডা. শামসাদ রব্বানী খান : চাকুরী জীবনে এখনও পর্যন্ত কোন পুরস্কার পাইনি।