দেশে ১৯ শতাংশ মানুষ কোমর ব্যথায় ভুগছেন
৭০ শতাংশ কোমর ব্যথা হয় দৈনন্দিন কাজ করতে গিয়ে পেশিতে টান লাগা থেকে
দেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ রিউমেটিক ফিভার বা বাতব্যথায় ভুগছেন। তাদের মধ্যে ১৯ শতাংশই লো ব্যাক পেইন বা কোমর ব্যথার রোগী।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০ সালে করা একটি জাতীয় জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। রবিবার (১২ জুন) বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘লো ব্যাক পেইন’ শীর্ষক এক সেমিনারে এই জরিপের তথ্য তুলে ধরা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল মেডিসিন, রিউমাটোলজি বিভাগ ও নিউরো সার্জারি বিভাগ যৌথভাবে এ সেমিনারের আয়োজন করে।
সেমিনারে বলা হয়, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ তার জীবনে কখনো না কখনো কোমর ব্যথায় ভোগেন। দেশে কর্মস্থল থেকে ছুটি নেওয়ার অন্যতম কারণ কোমর ব্যথা। এই কোমর ব্যথার ৭০ শতাংশই ঘটে লুম্বার স্ট্রেইন বা স্প্রেইনের কারণে। অর্থাৎ দৈনন্দিন কাজ করতে গিয়ে, ভারী কিছু তুলতে গিয়ে বা জোরে কাশি দেওয়ার কারণে পেশিতে টান লাগে এবং তা থেকে কোমর ব্যথা দেখা দেয়। ৭০ শতাংশ কোমর ব্যথা হয় দৈনন্দিন কাজ করতে গিয়ে। বিশেষ করে বেশি মোটা হলে কোমর ব্যথা বেশি হয়। বাংলাদেশে নারীদের কোমর ব্যথা বেশি।
সেমিনারে কোমর ব্যথা নিরসনে পরামর্শ তুলে ধরা হয়। বলা হয়, দেশে বেশিরভাগ কোমরের ব্যথা সাধারণ ব্যথা। কোমর ব্যথার ৯০ শতাংশ রোগী বিশ্রাম নিলে ও শারীরিক কর্মকাণ্ড করলে ভালো হয়ে যান। অধিকাংশ কোমর ব্যথা নিয়মকানুন মানার মাধ্যমে প্রতিকার করা সম্ভব। এর বাইরে চিকিৎসা ও শারীরিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেও অধিকাংশ কোমর ব্যথার প্রতিকার সম্ভব। ব্যথা নিরাময়ে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ (হরমোন জাতীয়) প্রয়োগ করা থেকেও বিরত থাকতে হবে। এই ধরনের ওষুধ শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করতে পারে।
সেমিনারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেকে হাঁটতে গেলে চলতে গেলে ব্যথা হয়, কারও পিঠে বা কোমরে ব্যথা হয়। কেউ নিচু হয়ে কিছু তুলতে গেলে এমন ব্যথা হয়, যাতে তাকে সারা দিন শুয়ে থাকতে হয়। ব্যথার কারণে অনেককে মাসখানেক শক্ত বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। চেয়ারে বসে কাজ করতে গেলে অনেকে পিঠে ব্যথা অনুভব করেন। এসব ব্যথার তিনটি কারণ, যেমন পিএলআইডি বা লাম্বার ইন্টার ভার্টিব্রাল ডিস্ক প্রল্যাপস, স্পাইনাল স্টোনোসিস, হার্নিয়েশন অব লাম্বার ডিস্কে ইনজুরি হলে লো ব্যাক পেইন বা কোমরে ব্যথা হতে পারে।
তিনি বলেন, কোমরসহ মাসলে আঘাত লাগলেও ব্যথা হতে পারে। এমন ব্যথা নিরাময়ে নিচু হয়ে ভারী কিছু না তোলা, ওজন যেন বৃদ্ধি না পায় সেদিকে খেয়াল রাখা ও শক্ত বিছানায় শোয়ার অভ্যাস করতে হবে। এসব মানলে কোমর ব্যথা থেকে মুক্তি মিলবে।
উপাচার্য আরও বলেন, কোমর ব্যথা নিরাময়ের জন্য এলোমোলোভাবে ওষধু খাওয়া যাবে না। খেয়ালখুশি মতো ব্যথার ওষুধ খেলে কিডনিসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি হতে পারে। ব্যথার ওষুধে অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। নির্দিষ্ট মাত্রায় ওষুধ ছাড়াও ব্যথা নিরাময়ে রেডিয়েশন, হিট থেরাপি দেওয়া যেতে পারে। শেষে অপারেশনের মাধ্যমে এ ব্যথা দূর করা হয়। অর্থাৎ কোমর ব্যথা নিরাময়ে শরীরচর্চা, নির্দিষ্ট মাত্রার ওষুধ প্রয়োগ এবং সর্বশেষ অপারেশন করে লো ব্যাক পেইন প্রতিকার করা যায়। তবে নিয়মকানুন মেনে ব্যথা নিরাময় বা নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। ফিজিক্যাল মেডিসিন, রিউমাটোলজি ও নিউরো সার্জারির মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজন হলে এমআরআই, সিটিস্ক্যান করে কোন ধরনের চিকিৎসা লাগবে সেটি নির্ণয় করতে হবে।
সেমিনারে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরো সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেন, রিউমাটোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আরিফুল ইসলাম, ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. তরিকুল ইসলাম মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
ডা. মোহাম্মদ হোসেন বলেন, যখন কোমরের ব্যথার সঙ্গে পায়ের ব্যথা থাকে, পায়ের শক্তি কমে যায়, প্রসাব-পায়খানা বন্ধ হয়ে যায়, তখন এটাকে আমরা রেড ব্লাক সাইন বলি। এমন হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কোমরের ব্যথার অধিকাংশই ডিস্ক প্রল্যাপসই হয়ে থাকে। এছাড়াও কোমরে আঘাত পাওয়া, টিউমার বা বয়স্ক লোকদের কোমরে পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে কোমরে ব্যথা হতে পার। কোমর ব্যথা নির্ণয়ের জন্য রেডিওলজি বিভাগে এমআরআই, সিটি স্ক্যান করে যদি দেখা যায়, নার্ভে ও স্পাইনাল কর্ডে চাপ দিয়ে আছে তাহলে বিএসএমএমইউয়ের নিউরোস্পাইনাল সার্জারি বিভাগে যোগাযোগ করতে হবে। মেরুদণ্ডের যেকোনো ধরনের অপারেশনের জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বিএসএমএমইউতে এলেই এর সমাধান করা সম্ভব।
ডা. আরিফুল ইসলাম বলেন, ৭০ শতাংশ কোমর ব্যথা হয় দৈনন্দিন কাজ করতে গিয়ে পেশিতে টান লাগা থেকে। ১০ শতাংশ কোমর ব্যথা হয় বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাড়ের কিছু পরিবর্তন থেকে। ৪ শতাংশ কোমর ব্যথা হয় ‘হার্নিয়েটেড ডিস্ক’-এর কারণে। অর্থাৎ দুই মেরুদণ্ডের মাঝখানে যে ডিস্ক থাকে, সেই ডিস্ক দুই মেরুদণ্ডের মাঝখান থেকে বের হয়ে এসে নার্ভের ওপর চাপ দিলে কোমর ব্যথায় আক্রান্ত হয় মানুষ। ৪ শতাংশ কোমর ব্যথা হয় হাড়ের ভঙ্গুরতার প্রবণতা বৃদ্ধি পেলে। সাধারণত বয়স বেশি, অতীতে বাতরোগে ভুগেছেন বা জেনেটিক কারণে মানুষের মধ্যে হাড় ভাঙার প্রবণতা দেখা দেয়।
তিনি আরও বলেন, কোমর ব্যথার জন্য যারা চিকিৎসকের কাছে আসেন, তাদের মাত্র ১ শতাংশ সিরিয়াস কারণে আসেন। এসব রোগীকে তাড়াতাড়ি ডায়াগনোসিস করে চিকিৎসা দিতে হবে। এসব রোগীর ক্ষেত্রে দেরি করা যাবে না।
সেমিনারের প্যানেল এক্সপার্ট হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (অ্যাকাডেমিক) অধ্যাপক ডা. এ কে এম মোশররফ হোসেন, ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আবু সালেক, নিউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আবু নাসার রিজভী ও সেন্ট্রাল সাব-কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. বেলায়েত হোসেন সিদ্দিক।