ওষুধ শিল্পে বিনিয়োগের এখনই সময়

হাসান মাহমুদ
2022-05-22 15:29:53
ওষুধ শিল্পে বিনিয়োগের এখনই সময়

এশিয়া ফার্মা এক্সপোতে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ এশিয়ার ২০টি দেশের ৩০০ প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়

বাংলাদেশের ছোট-বড় ২৬৯টি কোম্পানি ওষুধ উৎপাদন করছে। বিদেশে বিপুল চাহিদা সত্ত্বেও নানা সীমাবদ্ধতায় দেশীয় ওষুধ শিল্পের বাজার বড় হচ্ছে না। এজন্য আমদানি নির্ভরতাকে দায়ী করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওষুধ শিল্পের বেশিরভাগ প্রযুক্তি, কাঁচামাল ও সরঞ্জাম আমদানি করতে হয়। অথচ চাইলেই এগুলো দেশে উৎপাদন করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে দেশীয় কোম্পানিগুলোকে এ শিল্পে বিনিয়োগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তারা।

রাজধানীর বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে তিন দিনব্যাপী ২০তম এশিয়া ফার্মা এক্সপোতে অংশগ্রহণকারীরা এমনটিই মনে করছেন।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ওষুধ উৎপাদন প্রযুক্তি ও কাঁচামাল সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগাযোগ বাড়াতেই ২০০৩ সাল থেকে এ মেলা হয়ে আসছে। এবার মেলায় বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ এশিয়ার ২০টি দেশের তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়।

আয়োজকরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধ এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশি ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ১৬০টির বেশি দেশে, যার বাজার মূল্য প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা। তবে গবেষণার মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ের মলিকুল আবিষ্কার করে নিজস্ব ও ব্যান্ড তৈরি করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

বিদেশিদের প্রধান আগ্রহ কাঁচামাল সরবরাহে

উদীয়মান অর্থনীতির বাংলাদেশে ওষুধ শিল্পের বড় বাজার ধরতে বিদেশি কোম্পানিগুলোর বেশি আগ্রহ প্রযুক্তি ও রাসায়নিক পণ্য সরবরাহে। মেলাকে তারা উদ্দেশ্য পূরণের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে দেখছে তারা।

ভারতের ওষুধ শিল্প প্রযুক্তি সরবারহকারী কোম্পানি কেভিনের আন্তর্জাতিক বিপণন প্রধান বিনদ পতপারদি বলেন, ‘ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশের অনেক বড় মার্কেট। তারা বিশ্বের বড় বড় দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। বাজার ধরে রাখতে চ্যালেঞ্জ মানসম্মত পণ্য তৈরি করা। আমরা সাধ্যমতো বাংলাদেশকে প্রযুক্তি সহায়তা দিচ্ছি। এদেশের বড় বড় সব ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি আমাদের প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম ব্যবহার করছে। এবারের মেলার মাধ্যমে নতুন নতুন কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হবে বলে আশা করছি।’

জেনট্রি ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী আলিয়া আক্তার বলেন, ‘আমাদের নতুন প্রযুক্তির প্রয়োজন হলে নানা জায়গায় খোঁজ করতে হয়। এরপরও সঠিক প্রযুক্তি ও পণ্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে ঘুরেফিরে এক-দুটি প্রতিষ্ঠানের ওপরই নির্ভর করতে হয়। কিন্তু মেলায় অনেক কোম্পানি অংশ নিয়েছে। যাচাই-বাছাই করে তুলনামূলক ভালো পণ্য অর্ডার করতে পারছি।’

২০০৩ সালে প্রথম এশিয়া ফার্মা এক্সপো আয়োজন করে বাংলাদেশ। এরপর থেকে দেশের ওষুধ শিল্পের উন্নয়নে এ মেলা বিশেষ অবদান রেখে চলেছে বলে মনে করেন ফার্মাসিউটিক্যালস সংশ্লিষ্টরা।

লিওন ফার্মাসিউটিক্যালসের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক আফজালুর রহমান খান বলেন, ‘কোনো প্রযুক্তি বা পণ্যের জন্য প্রথমে দেশীয় এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। মেলায় আমরা অনেক কোম্পানিকে সরাসরি একসঙ্গে পাচ্ছি, এটি অনেক বড় পাওয়া। এখানে দর কষাকষির সুযোগ রয়েছে। ফলে খরচ অনেক কমে আসে। আবার মেলায় পরিচয়ের এ সম্পর্ক পরবর্তীতে অনেক কাজে লাগে।’

স্বয়ংসম্পূর্ণ ওষুধ শিল্পের জন্য প্রায় ৩০ হাজার ধরনের চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্র প্রয়োজন। কিন্তু এসব সরঞ্জামের মাত্র ৫০০টি উৎপাদন করতে পারে বাংলাদেশ। বাকিটা আসে বিদেশি কোম্পানি থেকে। অবশ্য আশার বিষয় হলো, এখন এ খাতে দেশীয় অনেক প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে। ফলে ওষুধের অটোমেটিক প্যাকেজিং, ক্যাপসুল সেডসহ দেশেই উৎপাদন হচ্ছে নানা প্রযুক্তি ও পণ্য।

এ বিষয়ে গ্লোবাল ক্যাপসুল লিমিটেডের নির্বাহী আবির কৃষ্ণ পাল ডক্টর টিভিকে বলেন, ‘একমাত্র আমরাই এখানে ক্যাপসুল শেড উৎপাদন করছি। আমাদের শেডগুলো দেশের প্রায় সব কোম্পানিই ব্যবহার করছে। মেলার মাধ্যমে দেশের বাইরেও আমাদের ক্রেতা তৈরি হয়েছে। আমরা আমাদের পণ্যের মান ঠিক রাখতে পারলে আরও বেশি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে পণ্য দিতে পারব।’

অটোমেটিক প্যাকেজিংসহ নানা প্রযুক্তি সরবরাহ করছে বেস্ট মেশিনারিজ অ্যান্ড টেকনোলজি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাইনুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা ২৬ ধরনের মেশিন সরবারহ করছি। তাইওয়ানের পার্টনারের মাধ্যমে ৪৪টি দেশে আমরা আমাদের মেশিন সরবরাহ করছি। সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তির এসব মেশিন আমাদের দেশের ওষুধ শিল্পের অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মেশিন স্থাপন করেই আমাদের কাজ শেষ করি না। এরপরও সার্ভিসিং সেবা দিয়ে থাকি। এতে গ্রাহকরা অনেক সন্তুষ্ট। শুধু বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভর না করে দেশীয় কোম্পনিগুলোর এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসা দরকার।’

বড় চ্যালেঞ্জ আমদানি নির্ভরতা 

প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি ও পণ্যের মানোন্নয়নে অটোমেশন প্যাকেজিং অত্যন্ত গুরুতপূর্ণ। বাংলাদেশ চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপের ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন করতে সক্ষম হলেও এখন পর্যন্ত প্রথম ধাপের মোলিকুলারের ৯৮ শতাংশই আমদানি করতে হয়। এটিকেই এ শিল্পের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক কনসালট্যান্ট ও ফার্মাসিস্ট ড. আবু জাফর সাদিক।

ডক্টর টিভিকে তিনি বলেন, ‘আমাদের শিল্প যখন ছোট ছিল, তখন বিদেশি প্রযুক্তি বা রাসায়নিক আমদানি করে চলত। এখন দেশে অনেক কোম্পানি, বাজার বড় হয়েছে। ফলে বিদেশ থেকে অনেক বেশি পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। এতে বিপুল অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, উৎপাদন খরচ বেড়ে পণ্যের দামে প্রভাব ফেলছে। আমি মনে করি, দেশীয় কোম্পানিগুলোর এখন এ খাতে বিনিয়োগ করার উপযুক্ত সময়।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, মুন্সীগঞ্জে ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য যে প্ল্যান্ট করা হয়েছে, তা এখনো উৎপাদনে যায়নি। এক্ষেত্রে বড় বাধা দক্ষ জনবল। এজন্য একজন দক্ষ ফার্মাসিস্ট, কেমিস্ট, বায়োকেমিস্ট, বায়োটেকনোলজিস্ট লাগবে। এখন এসব জায়গায় মনোযোগ দেওয়ার সময় এসেছে। এজন্য প্রয়োজন উচ্চ মানের গবেষণা। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এদিকে নজর দেওয়া দরকার। গবেষণা খাতে বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে আনা দরকার।

এ বিষযে ড. আবু জাফর সাদিক বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যেসব কাঁচামাল আমরা উৎপাদন করছি তা চতুর্থ বা পঞ্চম স্তরের। এখন আমাদের প্রথম স্তরের কাঁচামাল উৎপাদনে মনোযোগ দিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালগুলোর মধ্যে সমন্বয় করা গেলে শিগগিরই প্রথম ধাপের মোলিকুলার আবিষ্কার করা সম্ভব হবে। এ মধ্যস্থতার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। একই সঙ্গে ওষুধ প্রযুক্তিখাতে বিদেশ নির্ভরতা কমিয়ে আনতে দেশি যন্ত্র ও রাসায়নিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে সরকারি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।’


আরও দেখুন: